২০০০ সালে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ সম্মেলনে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ ঘোষণাপত্র পাসের পর, ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার টেকসই সুরাহা বা মোকাবেলার জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (MDGs) নামে পরিচিত আটটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আরো ১৮ টি লক্ষ্য নির্ধারন করা হয়। এসব উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০১৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য জাতিসংঘের ১৯১ টি সদস্য দেশ এবং আরোও ২২টি আন্তর্জাতিক সংস্থা একমত হয়েছিল।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা
আটটি লক্ষ্যমাত্রা
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (MDGs) নামে সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃতি পাওয়া আটটি লক্ষ্যমাত্রা গুলো হলোঃ
- চরম দারিদ্র ও ক্ষুধা নিবারণ করা
- সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন
- লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন
- শিশু মৃত্যুহার হ্রাস করা
- মায়ের স্বাস্থ্য উন্নয়ন করা
- এইচ আই ভি- এইডস, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
- টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণ
- উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক অংশিদারিত্ব সৃষ্টি
১৮টি সুনির্দিষ্ট টারগেট
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (MDGs) নামে সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃতি পাওয়া আটটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আরো ১৮টি সুনির্দিষ্ট টারগেট বা অভীষ্ট এবং ৪৮টি নির্দেশক বা সূচক নির্ধারণ করা হয়। এ ১৮টি টারগেট হলো :
- দৈনিক এক ডলারের কম আয়ের মানুষের অনুপাত অর্ধেকে নামিয়ে আনা;
- ক্ষুধার কষ্ট ভোগ করা মানুষের অনুপাত অর্ধেকে নামিয়ে আনা;
- সকল ছেলে-মেয়ে প্রাইমারি স্কুলে অন্তত পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত তাদের পড়াশোনা সম্পন্ন করতে পারে তা নিশ্চিত করা;
- সম্ভব হলে ২০০৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীগুলোতে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে শিক্ষার সকল বৈষম্য দূর করা;
- পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার দুই-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা;
- মাতৃত্বজনিত মৃত্যুহারের অনুপাত তিন-চতুর্থাংশ হ্রাস করা;
- এইচআইভি/এইডসের বিস্তার রোধ;
- ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য প্রধান রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনা;
- দেশীয় নীতিমালা ও কর্মসূচির মধ্যে টেকসই উন্নয়নের সমন্বয় করা, পরিবেশগত সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে আনা;
- নিরাপদ পানীয়জলের স্থিতিশীল সুযোগ বঞ্চিত জনগণের সংখ্যার অনুপাত অর্ধেকে নামিয়ে আনা;
- ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ১০ কোটি বস্তিবাসীর জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়নসাধন করা;
- একটি অবাধ বাণিজ্যিক ও আর্থিক ব্যবস্থার অধিকতর উন্নয়নসাধনÑ যা হবে নিয়মভিত্তিক, পূর্বাভাসযোগ্য ও বৈষম্যহীন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুশাসন, উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসের প্রতিশ্রতিও এর অন্তর্ভুক্ত;
- স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বিশেষ প্রয়োজন মোকাবেলা করা। এর মধ্যে রয়েছেÑ এদের রফতানি শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশ, মারাত্মক ঋণগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোর বর্ধিত পরিমাণ ঋণ মওকুফ, সরকারি দ্বিপক্ষীয় ঋণ বাতিল এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অঙ্গীকারবদ্ধ দেশগুলোর জন্য আরো উদারভাবে সরকারি উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করা।
- স্থলবেষ্টিত ও উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর বিশেষ প্রয়োজন মোকাবেলা করা ;
- উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর ঋণের সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ অব্যাহত রাখতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা;
- উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহযোগিতায় যুবসমাজের জন্য ভদ্রোচিত ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা;
- ঔষুধ কোম্পানিগুলোর সহযোগিতায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামর্থ্য অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সরবরাহ করা;
- বেসরকারি সহযোগিতায় নতুন প্রযুক্তিগুলো বিশেষ করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুফল সহজলভ্য করা।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ আর দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস হতে মুক্তি পাবে। ক্ষুধার কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে ৩০০ মিলিয়ন মানুষ। ৫ বছর বয়সের আগেই মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই মিলবে ৩০ মিলিয়ন শিশুর আর ২ মিলিয়ন নারী মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে। প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয়জলের ব্যবস্থা করা যাবে এবং অন্তত ৩৫০ মিলিয়ন মানুষ স্যানিটেশন সুবিধার আওতাভুক্ত হবে।
আরো পড়ুনঃ What are the Sustainable Development Goals? Do we need these?
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জন
২০১৫ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময়সীমা শেষ হয়। এই সময়ের মধ্যে বিশ্বের দেশগুলো অনেকখানি এগিয়েছে এই লক্ষ্য অর্জনে। ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অর্জন পর্যালোচনা করা যাকঃ
চরম দারিদ্র ও ক্ষুধা নিবারণ করা
দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি শক্তিশালী অর্থনীতির অপরিহার্য্য যেখানে কর্মসংস্থান ও ভাল মজুরি নিশ্চিত থাকবে। এই শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য এমন একটি সরকার প্রয়োজন যারা স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা, সুস্থ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ মানব পুঁজির নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারবে।
চরম দারিদ্র ও ক্ষুধা নিবারণের এই লক্ষমাত্রা অর্জনে ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়। এই লক্ষ্য অর্জনে সফলতাও এসেছে। ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী,
- ১৯৯০ সালে যেখানে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১.৯ বিলিয়ন, ২০১৫ সালে এসে এই সংখ্যা ৮৩৬ মিলিয়নে নেমে এসেছে। অর্থ্যাৎ, অর্ধেকেরও বেশী কমেছে।
- যেখানে ১৯৯০ সালের দিকে উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা দৈনিক ১.২৫ ডলারেরও কম খরচে দিনাতিপাত করত, ২০১৫ সালের শেষে এই অনুপাত কমে ১৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
- অপুষ্টিহীনতায় ভোগা জংনসংখ্যার পরিমান ২৩.৩ থেকে কমে ১২.৯ শতাংশে উপনীত হয়েছে।
- ১৯৯০ এর শুরুতে উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে মধ্যবিত্তরা মাত্র ১৮ সেন্ট দৈনিক পারিশ্রমিক পেত, ২০১৫ সালে এসে তাদের পারিশ্রমিক ৪ ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং কর্মজীবি মানুষের সংখ্যা তিনগুণ ছাড়িয়ে গেছে।
সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন
২০১৫ সালের মধ্যে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা ছিল সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম লক্ষ্য। কারণ, মানুষের মৌলিক গুণাবলি বিকশিত হওয়ার জন্য শিক্ষা অপরিহার্য্য। শিক্ষার পরিপূরক আর কিছু হতে পারে না। তাই শিশুরা যাতে অন্ততঃ সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয় সেই লক্ষে কাজ করা হয়।
২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী,
- উন্ননয়নশীল দেশগুলোতে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তঅর্ভুক্তির হার ৮৩ থেকে ৯১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
- স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন থেকে ৫৭ মিলিয়নে নেমে এসেছে ২০১৫ সালে। অর্থ্যাৎ, প্রায় অর্ধেক কমেছে ঝরে পড়াদের সংখ্যা।
- ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুনদের মধ্যে শিক্ষার হার ৮৩ থেকে ৯১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন
দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং গ্রামীণ উন্নয়নের স্থায়িত্বের উন্নতির লক্ষ্যে নারী ও পুরুষ উভয়ের সার্বিক ও ন্যায়সঙ্গত অংশগ্রহণের প্রচার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিঙ্গ সমতা এবং গ্রামীণ মহিলাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব নয়।
২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী,
- ১৯৯০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় ১০০ ছেলের বিপরীতে মাত্র ৭ জন মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করত। ২০১৫ সালে এসে এই অনুপাত ১০০ জন ছেলের বিপরীতে ১০৩ জন মেয়েতে উন্নীত হয়েছে।
- কৃষি কাজের বাইরে নারীরা অন্যান্য কাজে অনেক বেশী অংশগ্রহন করছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালে কৃষি বাদে অন্য কাজে নারীদের অংশগ্রহণ ৩৫ থেকে ৪১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
- ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ১৭৪ টি দেশের কমপক্ষে ৯০ শতাংশ দেশের সংসদে নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
শিশু মৃত্যুহার হ্রাস করা
সারা বিশ্বে অপুষ্টিহীনতা শিশু মৃত্যহারের অন্যতম কারণ। এই পুষ্টিহীনতায় বিশ্বে ৩৩ শতাংশেরও বেশি শিশু মারা যায়। খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিযুক্ত খাবারের নিশ্চয়তা শিশুদের এই মৃত্যুহার কমানোর প্রধান উপায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার দুই-তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্য গৃহিত হয় মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্টের জন্য।
২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী,
- ১৯৯০ থেকে ২০১ সালে এসে প্রতি ১০০০ জন শিশুর মধ্যে মৃত্যুহার ৯০ থেকে ৪৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। অত্যাধিক মাত্রায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের মধ্যে পাঁচ বছর বয়সী শিশুর মৃত্যুর সংখ্যা ১২.৭ মিলিয়ন থেকে ৬ মিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়েছে। সম্পূরক খাবার এবং বুকের দুধ ছাড়াও শিশুদের বাড়তি পুষ্টিকর খাবার প্রদান শিশুমৃত্যুর পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে।
মায়ের স্বাস্থ্য উন্নয়ন করা
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় মায়ের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের দিকে গুরুত্বারোপ করা হয়। ক্ষুধা এবং অপুষ্টির কারণে প্রায় ৮০% মায়েদের রোগ ও মৃত্যুর ঘটনা দেখা গেছে। মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি হলে গর্ভাবস্থা এবং প্রসবকালীন জটিলতার ফলে প্রতি বছর যে লক্ষাধিক মহিলা প্রাণ হারান তাদের বাঁচানো সম্ভব। যদি অনুন্নত দেশগুলির মহিলারা পর্যাপ্ত খাবার, মৌলিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষার পাশাপাশি গর্ভাবস্থা এবং প্রসবকালীন সময়ে নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধার পান, তাহলে এই মৃত্যুর ৯০% এরও বেশি এড়ানো সম্ভব।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে:
- মাতৃমৃত্যুর হার ৭৫ শতাংশ কমানো ও
- প্রত্যেকের প্রজনন স্বাস্থ্যের অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা।
২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী,
- ১৯৯০ সাল থেকে, মাতৃমৃত্যুর অনুপাত বিশ্বব্যাপী ৪৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে । দক্ষিণ এশিয়ায় এই হার ৬৪ শতাংশ আফ্রিকায় ৪৯ শতাংশ কমেছে।
- বিশ্বব্যাপী দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে ৭১ শতাংশেরও বেশি জন্মপ্রদানে সহায়তা করা হয়েছিল, যা ১৯৯০ সালে ৫৯ শতাংশ ছিল।
- গর্ভনিরোধ প্রক্রিয়া গ্রহনের প্রবণতা ৫৫ শতাংশ থেকে ৬৪ শতাংশে বেড়েছে।
এইচ আই ভি – এইডস, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
এইডস, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য রোগবালাই কৃষি উৎপাদন, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার উপর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। অপুষ্টি এবং খাদ্য ও পুষ্টির অভাব একজন ব্যক্তিকে অসুস্থতার জন্য আরও সংবেদনশীল করে তুলতে পারে। এই বিষয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে:
- ২০১৫ সালের মধ্যে এইডস বিস্তার রোধ করা এবং এর অবসান ঘটানো;
- ২০১০ সালের মধ্যে যাদের প্রয়োজন তাদের জন্য এইডসের চিকিৎসার সুযোগ উন্মুক্ত করা;
- ২০১৫ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য গুরুতর অসুস্থতার বিস্তার বন্ধ করা এবং এর অবসান ঘটানো।
২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী,
- এইডসে আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা ৪০ শতাংশ কমেছে ২০১৩ সালের মধ্যে। কমপক্ষে ৩। মিলিয়ন থেকে কমে ২.১ মিলিয়নে নেমেছে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। ২০১৪ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী ১৩.৬ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি আক্রান্ত রোগী অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) গ্রহণ করছিলেন, যা ২০০৩ সালে মাত্র ৮০০০০০ ছিল। ফলশ্রুতিতে ২০১৩ সালের মধ্যে ৭.৬ মিলিয়ন মৃত্যু এড়াতে পেরেছে।
- ২০০০ সালের তুলনায় ৬.২ মিনিল্যন মানুষ ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। সারাবিশ্বে মৃত্যুহার ৫৮ থেকে ৩৭ শতাংশে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।
- ২০০০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে, যক্ষ্মা প্রতিরোধ, নির্ণয় এবং চিকিত্সার অবদানে আনুমানিক ৩৭ মিলিয়ন জীবনকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে যক্ষ্মা মৃত্যুর হার ৪৫ শতাংশ এবং বিস্তারের হার ৪১ শতাংশ কমেছে।
টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণ
মানুষের খাদ্য চাহিদা এবং অন্যান্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত চাহিদাগুলি পর্যাপ্তভাবে পূরণ করা নিশ্চিত করার জন্য, প্রাকৃতিক সম্পদের ভিত্তি এবং বাস্তুতন্ত্রকে টেকসইভাবে পরিচালনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন, সম্পদের অধিকার নিয়ে বিরোধ এবং পানির সরবরাহ হ্রাসের মতো কারণগুলির কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন।
এজন্য, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার নিম্নলিখিত চারটি লক্ষ্য রয়েছেঃ
- প্রতিটি দেশের নীতি ও কর্মসূচিতে টেকসই উন্নয়ন নীতিগুলি অন্তর্ভুক্ত করা এবং পরিবেশগত সম্পদের ক্ষতি পুনরুদ্ধার করা এবং পরিবেশে সম্পদকে অপরিকল্পিত আহরণ থেকে রক্ষা করা;
- জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বন্ধ করা এবং ২০১০ সালের মধ্যে ক্ষতির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা;
- ২০১৫ সালের মধ্যে নূন্যতম স্যানিটেশন এবং বিশুদ্ধ পানির সুবিধাহীন জনসংখ্যার পরিমান অর্ধেকে কমিয়ে আনা ও
- ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ১০০ মিলিয়ন বস্তিবাসির জীবনকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করা।
২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী,
- ২০১৫ সালে, বিশ্ব জনসংখ্যার ৯১ শতাংশ জনসংখ্যা উন্নত পানীয় জলের উৎস ব্যবহার করছে। ১৯৯০ সালে যেখানে ২.৬ বিলিয়ন লোক নিরাপদ পানীয় জলের সুবিধা পেয়েছে, ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ৪.২ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫৮ শতাংশ জনসংখ্যা পানীয় জলের এই সুবিধা ভোগ করছে।
- বিশ্বব্যাপী, ১৪৭ টি দেশ পানীয় জলের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে, ৯৫ টি দেশ স্যানিটেশন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে এবং ৭৭টি দেশ উভয়ই পূরণ করেছে। ২.১ বিলিয়ন মানুষ এখন বিশ্বব্যাপী উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা পেয়েছে। 1990 সাল থেকে, খোলামেলা জায়গায় মলত্যাগের অভ্যাস করা লোকের শতাংশ প্রায় অর্ধেকে হ্রাস পেয়েছে।
- উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শহুরে জনসংখ্যার মধ্যে বস্তিতে বসবাসকারীদের সংখ্যা ৩৯.৪ শতাংশ থেকে কমে ২৯.৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক অংশিদারিত্ব সৃষ্টি
বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক অংশিদারিত্ব সৃষ্টির জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৬টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যথাঃ
- স্বচ্ছ, নিয়মতান্ত্রিক এবং বৈষম্যমুক্ত একটি বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা;
- স্বল্পোন্নত দেশগুলির অনন্য প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার জন্য;
- উন্নয়নশীল স্থলবেষ্টি এবং ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলির বিশেষ প্রয়োজনীয়তা মেটানো;
- উন্নয়নশীল দেশের ঋণের সমস্যা মোকাবেলা করা;
- ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশনগুলির সাথে কাজ করে অনুন্নত দেশগুলিকে সস্তায় প্রয়োজনীয় ওষুধের চাহিদা মেটানো ও
- বেসরকারি খাতের সহযোগিতায়, নতুন প্রযুক্তি, বিশেষ করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উতকর্ষতা লাভ।
২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী,
২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে উন্নত দেশগুলি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়ন সহায়তা ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে, $১৩৫.২ বিলিয়নে পৌঁছেছে। উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশগুলিতে শুল্কমুক্ত পণ্য অনুমোদিত হওয়ার পরিমান ৬৫ শতাং থেকে উন্নীত হয়ে ২০১৪ সালে ৭৯ শতাংশ হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, রপ্তানি রাজস্বের জন্য বৈদেশিক ঋণ সুবিধার অনুপাত ১৩ শতাংশ থেকে ২০১৩ সালে ৩ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে।
২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশই মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধা পেয়েছে। গত ১৫ বছরে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় দশগুণ বেড়েছে। ২০০০ সালের তুলনায় বিশ্বের জনসংখ্যার ৬% থেকে ২০১৫ সালে ৪৩% ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বৃদ্ধি পেয়েছে।
মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট লক্ষ্য ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশ জাতিসংঘের ভাষাতেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার লক্ষ্য অর্জনে অনুসরণীয় সাফল্য দেখিয়েছে৷ বাংলাদেশকে বলা হয় এমডিজির ‘রোল মডেল’৷ অভিষ্ট লক্ষ্য তা দেখানোও সম্ভব জাতিসংঘ এমডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ অনুসরণীয় সাফল্য দেখিয়েছেঃ
- বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রদ্ধৃদ্ধি নিয়মিতভাবে ৬ শতাংশের উপরে রয়েছে যা দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে৷ বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২৪.৮ শতাংশ যা নব্বইয়ের শুরুতে ছিল ৫৬.৭ শতাংশ৷
- বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রকৃত ভর্তি হার ৯৭.৭ শতাংশ৷ এর মধ্যে ছেলে ৯৬.৬ ও মেয়ে ৯৮.৮ শতাংশ৷ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার ১৯৯১ সালে ৪৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ৮১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে৷ এছাড়া ১৫ বছরের বেশি বয়সি জনসংখ্যার শিক্ষার হার ১৯৯০ সালের ৩৭.২ থেকে বেড়ে বর্তমানে ৬১ শতাংশ হয়েছে৷
- ২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রতি ১০০ ছেলের বিপরীতে ১০৩ জন মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়৷ ১৯৯০ সালে ছেলে-মেয়ের এই অনুপাত ছিল ১০০:৮৩৷ আর মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ের অনুপাত ছিল: ১০০: ৫২ যা এখন ১০০:১১৪৷
- ১৯৯০ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর মৃত্যুর হার ছিল হাজারে ১৪৬ জন, যা ২০১৩ সালে ৪৬-এ নেমে এসেছে৷
- ১৯৯০ সালে মাতৃমৃত্যু হার ছিল ৫৭৪, যা ২০১৩ সালে হয়েছে ১৭০৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষত মাতৃস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে ১২ হাজার ২১৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে৷
- বাংলাদেশে এইচআইভি অথবা এইডসের প্রাদুর্ভাব এখনো অনেক কম৷ শতকরা ০.১ ভাগ, যা মহামারি সীমার নীচেই রয়েছে৷ ২০১৩ সালে ১৫-২৪ বছর বয়সি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি-এইডস সম্পর্কে সঠিক ও স্পষ্ট ধারণা রাখে এমন লোকের সংখ্যা ১৮ শতাংশ৷
- ১৯৯০ সালে দেশে বনাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক শূন্য শতাংশ, যা ২০১৪ সালে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে৷ এ সময়ে ‘ওজোন’ ক্ষয়কারী পদার্থের পরিমাণ ২০২ ওডিপি টন থেকে হ্রাস পেয়ে ৬৪ দশমিক ৮৮ হয়েছে৷ ১৯৯০ সালে জনসংখ্যার ৭.৮ শতাংশ বস্তিতে বাস করতো৷ বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫.২৫ শতাংশে৷
- ১৯৯০-৯১-এ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার পরিমাণ ছিল ৫.৫৯ শতাংশ। ২০১৩-১৪ সালে এর পরিমাণ ১.৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
সব মিলিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পৃথিবীর সাথে সাথে বাংলাদেশও অনেক খানি এগিয়েছে। বাংলাদেশের সাফল্য চোখে পড়ার মত। এজন্য বাংলাদেশ স্বীকৃতিও পেয়েছে। তবে পথ চলা বাকি আরো অনেকটাই। এখন চলছে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট লক্ষ্যমাত্রার সময়কাল। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঢেকুর না তুলে অর্জনগুলোকে টেকসই উন্নয়নে রূপান্তরিত করতে হবে। এ যাত্রায় বাংলাদেশ কঠিন অভিজ্ঞতার সম্মুখ হবে। তবে বহির্বিশ্বের সাথে যুগপৎ শক্তিতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে খুব বেশি বেগ পেতে হবেনা। এর জন্য প্রয়োজন সুস্থ গণতন্ত্রের চর্চা; কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা, কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধতা ও জনগনের নিকট জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশে হয়ত ইট পাথরের দালান-কোঠা ছাড়া মানুষের বসবাসের যোগ্য কোন পরিবেশ থাকবে না, মানবাধিকার থাকবে না।
সুতরাং, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার পরে এখন সরকারকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মাপকাঠিতে পথ চলা শুরু করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে না পারলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ধ্বসে পড়তে সময় লাগবেনা।













