যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার গঠন ও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অর্জন

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার গঠন ও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অর্জন অবিস্মরণীয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার গঠন ও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অর্জন অবিস্মরণীয়।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার, নির্মম ধ্বংসযজ্ঞে বাংলাদেশ এক বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয় । প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোর সবকিছুই ছিল বিপর্যস্ত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে  ভারত ও ভুটান ব্যতীত অন্য কোন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বাংলাদেশ পায়নি1। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা সে বিষয়েও সংশয় দেখা যায়। এমনই এক পরিস্থিতিতে এই বিধ্বস্ত জনপদের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। এই নিবন্ধে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার গঠন ও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অর্জন নিয়ে আলোচনা করব।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার গঠন ও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অর্জন

মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে লক্ষ লক্ষ ঘর-বাড়ি, হাজার হাজার অফিস ভবন, প্রাথমিক বিদ্যালয়,হাইস্কুল-মাদ্রাসা, শত শত কলেজ  ও গ্রামীণ হাট বাজার জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী।  পরিকল্পিতভাবে এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ধ্বংস করে দেয় তারা। শত শত ছোট বড় সড়ক ও রেল সেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এমন অবস্থায়, প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, গ্রামগঞ্জের লাখ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর পুণর্নির্মাণ, সর্বোপরি সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের চাহিদা পূরণ ও আইন-শৃঙ্খলা পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ছিল স্বাধীনতার প্রাপ্ত দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ । এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানের বিশেষ বিমানে শুরুতে লন্ডন যান বঙ্গবন্ধু। তারপর, লন্ডন থেকে ব্রিটিশ বিমানে করে ভারতের দিল্লিতে বিরতি নিয়ে বাংলাদেশে পদার্পণ করেন বঙ্গবন্ধু। 

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার গঠন ও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অর্জন
লন্ডনে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর একেবারে শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করে বঙ্গবন্ধুর সরকার। ১১ই জানুয়ারি সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে পরের দিন ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। মাত্র তিন বছর সাত মাস তিন দিনে বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন এর মত কঠিন দায়িত্ব পালনে বলিষ্ঠ ও কার্যকরি ভূমিকা রাখেন। ১৯৭২-১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনসমূহ নিম্নরূপঃ

সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বিশিষ্ট নতুন সংবিধান প্রণয়ন

১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ জারি করে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা চালু করেন। পরের দিন ১২ই জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১১ই এপ্রিল সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ড. কামাল হোসেনের উত্থাপিত খসড়া সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বরথেকে কার্যকর হয়। এই সংবিধানের মূলনীতি হল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। সংবিধানে সার্বজনীন ভোটাধিকার মৌলিক অধিকার ন্যায়বিচার সহ জনগণের সকলের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারকে  স্বীকৃতি দেয়া হয়।

Sheikh Mujibur Rahman: The Architect of Bangladesh

গণপরিষদ

১৯৭২ সালের ২৩ শে মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ নামে একটি আদেশ জারি করেন। এই আদেশ বলে ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য গণপরিষদের সদস্য বলে পরিগণিত হন। ১৯৭২ সালের ১৯শে এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় আইন কানুন পাস ও কার্যকর করা সম্ভব হয়। 

শিল্প কারখানা জাতীয়করণ

পাকিস্তান সরকার পুঁজিবাদ বিকাশের পথ উন্মুক্ত রেখে দেশের আর্থিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়েছিল। ফলে, দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক বৈষম্য সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতার পর আদমজী সহ বিভিন্ন কলকারখানার পাকিস্তানি ও ভারতীয় শিল্পপতিরা বাংলাদেশ ত্যাগ করলে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের গণমানুষের অধিকার নিশ্চিতে বাংলাদেশ জাতীয়করণ আদেশ, ১৯৭২-এর অধীনে সমগ্র দেশের প্রায় ৮৫ ভাগ প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন

পাকিস্তান আমলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত শিক্ষকগণ সরকারের কাছ থেকে সামান্য বেতন ভাতা পেতেন বঙ্গবন্ধু প্রায় ৩৮ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। এর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের ২৬ শে জুলাই বিজ্ঞানী ডঃ কুদরত-এ-খুদার ন্তৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এই কমিটি ১৯৭৪ সালের গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতির রূপরেখা উপস্থাপন করে। এছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ করেন। 

উন্নয়ন, পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কার্যক্রম

মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত সকল সেতু জরুরী ভিত্তিতে পুনঃনির্মাণ করার ফলে ১৯৭৪ সালের মধ্যে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা একটা সন্তোষজনক অবস্থায় উন্নীত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সহ অন্যান্য রেল সেতু চালু হয়। এছাড়া বিমান যোগাযোগের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় বঙ্গবন্ধুর সরকার। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রুটে বিমান চালু করা শুরু করা হয় এবং তেজগাঁও বিমানবন্দর ব্যবহার উপযোগী করার কাজ সম্পন্ন হয়। 

প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ায় সরকার পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কঠিন দায়িত্ব নিয়ে রেড ক্রস সোসাইটির মাধ্যমে সারাদেশে গ্রাম থেকে জেলা পর্যায়ে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও মানুষজনকে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত কম্বল খাদ্যদ্রব্য ও অর্থ সাহায্য বন্টন করে।

১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন

প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ। নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসন সহ ৩১৫ টি আসনের মধ্যে ৩০৬ টি আসনে আওয়ামী লীগ  জয় লাভ করে। দ্বিতীয় মেয়াদে বঙ্গবন্ধুর সরকার গঠিত  হয়। 

Uncovering the Agartala Conspiracy Case: A Political Conspiracy against Bangladesh!

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন

১৯৭৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। এই সরকার পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের কোন ক্ষমতা ছিল না। রাষ্ট্রপতি চাইলে উপরাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য সরকারি বিভাগের কর্মকর্তাকে নিয়োগ ও দরখাস্ত করতে পারবেন এমন ক্ষমতা প্রদান করে  রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এছাড়া  অন্যান্য রাজনৈতিক দল বাতিল ও বেআইনি ঘোষণা করে একটিমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠনেরও কর্তৃত্ব প্রদান করা হয় রাষ্ট্রপতিকে। ১৯৭৫ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অন্যান্য রাজনৈতিক দল ভেঙ্গে দিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ (বাকশাল) নামে একটিমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তবে গঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী শ্রমিক লীগ বা ‘বাকশাল’কে কোন রাজনৈতিক দল বলা যায় না কারণ এটি সংবিধান মোতাবেক গঠিত হয়েছিল।

গঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী শ্রমিক লীগ বা ‘বাকশাল’কে কোন রাজনৈতিক দল বলা যায় না কারণ এটি সংবিধান মোতাবেক গঠিত হয়েছিল।

ক্ষমতাহীন সংসদ

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে এমন কিছু বিতর্কিত বিধান প্রণয়ন করা হয় যা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা নেই2।  রাষ্ট্রপতি সরকার ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের থাকলেও সেখানে রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে চতুর্থ সংসদের মাধ্যমে এমন বিধান করা হয় যে রাষ্ট্রপতি যতবার খুশি তার পদে বহাল থাকতে পারবেন। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করার ক্ষেত্রে চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয় যে ২/৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের প্রস্তাব আনতে এবং তা পাস হতে লাগবে ৩/৪ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের আর কোন সম্ভাবনা থাকল না।

মূল সংবিধানের ৮০3 অনুচ্ছেদে বলা ছিল যে কোন বিল সংসদের পাশ হতে হলে রাষ্ট্রপতি ১৫ দিনের মধ্যে বিলে সম্মতি প্রদান করবেন। অন্যথায় বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠাবেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত না পাঠালে রাষ্ট্রপতির সম্মতি আছে বলে ধরে নেয়া হবে। রাষ্ট্রপতি সংসদে বিলটি ফেরত পাঠালে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে পাশ হয়ে রাষ্ট্রপতির নিকট পুনরায় পাঠানো হলে তিনি ৭ দিনের মধ্যে সম্মতি দিবেন। সম্মতি প্রদানে অসমর্থ হলে ৭ দিন পরে সম্মতি আছে বলে ধরে নেয়া হবে এবং বিলটি আইনে প্রণীত হবে। কিন্তু চতুর্থ সংসদের মাধ্যমে সংসদে উত্থাপিত কোন বিলে সম্মতি না দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয় এবং সম্মতিহীন কোন আইন কোন কোন বিল কখনো আইনে পরিণত হতে পারবে না যা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিপন্থী4

এছাড়া চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগের মৌলিক অধিকার বলবৎকরনের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া, সংসদ সদস্যদের দল ত্যাগে বা বিপক্ষে ভোটদানে বাধা দেয়া সহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয় যা স্পষ্টতঃ রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিরোধী। 

বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতায় এর গুরুত্ব

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার জন্য ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে এবং প্রণীত হয় প্রথম (১৯৭৩-১৯৭৮) পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প, কৃষি, সহ বিভিন্ন খাতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, দারিদ্র্য হ্রাস, প্রভৃতির হার ৩% থেকে ৫.৫% উন্নীত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

কৃষি উন্নয়ন

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ৮৫ ভাগ জনগণের জীবিকা ছিল কৃষি নির্ভর। অর্ধেকেরও বেশি জাতীয় আয় আসতো কৃষি খাত থেকে। তাই বঙ্গবন্ধুর সরকার কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ সহ ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বকেয়া সুদ মওকুফ করে  দেয়। সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা পর্যন্ত পরিবার প্রতি জমির মালিকানা নির্ধারণ করে দেন।  এছাড়া ২২ লাখেরও অধিক কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। 

পররাষ্ট্র নীতি

সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সুদৃঢ় ও সুপরিকল্পিত পররাষ্ট্রনীতির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসার পূর্বে ভারত ভুটান ছাড়া পৃথিবীর আর কোন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বাংলাদেশ পায়নি। একইসাথে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক সম্পদের সাহায্য সহযোগিতা লাভ অত্যন্ত জরুরি ছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে দেশ পুনর্গঠনে বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা নিশ্চিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। ঢাকায় পদার্পণ করে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেন, ‘বাংলাদেশ শান্তিতে বিশ্বাস করে, কারো প্রতি বৈরী আচরণ সমর্থন করবে না।’ তিনি ঘোষণা করেন, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’- এ নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারিত হবে। 

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফেরত যাওয়া

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বিশ্ব সেনাবাহিনী মিত্র বাহিনী অংশগ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অবিস্মরণীয়। সদ্য স্বাধীন দেশের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় অবস্থানে আগ্রহী হলেও বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে মিত্রবাহিনীর সদস্যদের ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় সেনা অপসারণে সময় চাইলেও বঙ্গবন্ধুর দাবি মেনে নেন। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই মৃত্যুর বাহিনী বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যায়। 

মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর সরকার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার ভিত্তি নির্মাণ করেন। তারপরেও স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকারকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তারই আশেপাশের চক্রের হাতে জীবন দিতে হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় দায়ীরা পরবর্তিতে নতুন করে সরকার গঠন করে যারা একসময় বঙ্গবন্ধুর অনেক কাছের ছিলেন। তারা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন যা কোনদিন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। 

  1. নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, সেপ্টেম্বর ২০১৭, পাতা ২০৪ ↩︎
  2. জসিম আলি চৌধুরী, বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন, ৩য় সংস্করণ, ২০১৭,পাতা ৬৩৩ ↩︎
  3. জসিম আলি চৌধুরী, বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন, ৩য় সংস্করণ, ২০১৭,পাতা ৬৩৩ ↩︎
  4. মোঃ আরিফুল ইসলাম, বাংলাদেশের সংবিধান তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ, ১ম সংস্করণ, ২০১৭, পাতা ২১-২৪ ↩︎

লেখক

  • রাকিবুল ইসলাম, মেরুনপেপার

    রাকিবুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম সম্পন্ন করেছেন। রাজনীতি, আইন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ইতিহাস নিয়ে স্পষ্ট ও তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। ওয়ার্ডপ্রেসসহ ডিজিটাল প্রকাশনার মাধ্যমে তিনি পাঠককে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করেন।

    শেয়ার করুনঃ
    আরো আর্টিকেল পড়ুন
    মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আজ যে উত্তেজনায় ভরা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ফিলিস্তিনি সংকট এবং আব্রাহাম চুক্তি নামের এক পরিবর্তনশীল কূটনৈতিক প্যাকেজ।
    ফিলিস্তিনি সংকট ও আব্রাহাম চুক্তিঃ সমালোচনা, সুফল ও বাস্তবতা

    মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আজ যে উত্তেজনায় ভরা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ফিলিস্তিনি সংকট এবং আব্রাহাম চুক্তি নামের এক পরিবর্তনশীল কূটনৈতিক প্যাকেজ।

    পি আর পদ্ধতি কী — ধরন, সুবিধা-অসুবিধা ও বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রাসঙ্গিকতা (1)
    পি আর পদ্ধতি কী — ধরন, সুবিধা-অসুবিধা ও বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রাসঙ্গিকতা

    পি আর পদ্ধতি হলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা। পি আর পদ্ধতির ধরন, সুবিধা, অসুবিধা বিবেচনায় বাংলাদেশে পি আর পদ্ধতি প্রাসঙ্গিক কি না প্রশ্ন উঠেছে।

    বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধানগুলোর অন্যতম মদিনা সনদ ইসলামি রাষ্ট্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য ঐতিহাসিক দলিল। 
    মদিনা সনদ কীঃ মদিনা সনদের প্রধান ধারা ও বিশ্ব ইতিহাসে এর গুরুত্ব বিশ্লেষণ

    বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধানগুলোর অন্যতম মদিনা সনদ ইসলামি রাষ্ট্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য ঐতিহাসিক দলিল। 

    বিবিসির প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিওতে হাসিনা স্বয়ং নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
    বিবিসির তদন্তে শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও: ‘যেখানে পাবে সেখানেই গুলি করো’

    বিবিসির প্রতিবেদনে প্রমান মিলেছে যে, শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিওতে হাসিনা স্বয়ং নিরাপত্তা বাহিনীকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

    কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল? আন্তর্জাতিক বিচারের হাত থেকে বাঁচতে, গাজার নিপীড়ন থেকে দৃষ্টি সরাতে ও ইহুদি আধিপত্য জাহিরের হতাশাজনক প্রচেষ্টা।
    কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল তার প্রকৃত কারণ

    কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল? আন্তর্জাতিক বিচারের হাত থেকে বাঁচতে, গাজার নিপীড়ন থেকে দৃষ্টি সরাতে ও ইহুদি আধিপত্য জাহিরের হতাশাজনক প্রচেষ্টা।

    গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।
    সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রেরঃ নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা

    গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।

    গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।
    বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ

    গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।

    আজ ১০ মে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে "অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস" নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটি কোরআনের সূরা আস-সাফের ৪ নম্বর আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ "গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর"। গত ৬ মে’র ভারতের "অপারেশন সিঁদুর"-এর জবাবে পাকিস্তান এই পাল্টা হামলা চালিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ভারত প্রকাশ করেনি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দাবি, এই অভিযানে জম্মু-কাশ্মীর, পাঞ্জাব, ও রাজস্থানের একাধিক সামরিক টার্গেটে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে, যার মধ্যে ব্রাহ্মোস মিসাইল ডিপো এবং এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত।
    অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুসঃ ভারতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা

    পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে “অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস” নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটির অর্থ “গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর”।

    এই আর্টিকেলগুলিও আপনি পড়তে পারেন

    মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আজ যে উত্তেজনায় ভরা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ফিলিস্তিনি সংকট এবং আব্রাহাম চুক্তি নামের এক পরিবর্তনশীল কূটনৈতিক প্যাকেজ।

    ফিলিস্তিনি সংকট ও আব্রাহাম চুক্তিঃ সমালোচনা, সুফল ও বাস্তবতা

    মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আজ যে উত্তেজনায় ভরা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ফিলিস্তিনি সংকট এবং আব্রাহাম চুক্তি নামের এক পরিবর্তনশীল কূটনৈতিক প্যাকেজ।

    পি আর পদ্ধতি কী — ধরন, সুবিধা-অসুবিধা ও বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রাসঙ্গিকতা (1)

    পি আর পদ্ধতি কী — ধরন, সুবিধা-অসুবিধা ও বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রাসঙ্গিকতা

    পি আর পদ্ধতি হলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা। পি আর পদ্ধতির ধরন, সুবিধা, অসুবিধা বিবেচনায় বাংলাদেশে পি আর পদ্ধতি প্রাসঙ্গিক কি না প্রশ্ন উঠেছে।

    বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধানগুলোর অন্যতম মদিনা সনদ ইসলামি রাষ্ট্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য ঐতিহাসিক দলিল। 

    মদিনা সনদ কীঃ মদিনা সনদের প্রধান ধারা ও বিশ্ব ইতিহাসে এর গুরুত্ব বিশ্লেষণ

    বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধানগুলোর অন্যতম মদিনা সনদ ইসলামি রাষ্ট্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য ঐতিহাসিক দলিল। 

    জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস

    জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস

    ইতিহাসের পাতায় যেসব মুহূর্ত স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তার মধ্যে বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস অন্যতম।

    নিয়মিত আর্টিকেল পেতে

    সাবস্ক্রাইব করুন

    Scroll to Top
    ×