বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় দেওয়ানি মোকদ্দমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তিগত অধিকার, সম্পত্তি, বা পদের মালিকানা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি দেওয়ানি আদালতের প্রধান কাজ। তবে, “দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা” বলতে আসলে কী বোঝায়? এবং এ ধরনের মোকদ্দমাগুলোর বিচার করতে আমাদের দেশে কী কী প্রকারের দেওয়ানি আদালত বিদ্যমান?
এই নিবন্ধে আমরা দেওয়ানি মোকদ্দমার সংজ্ঞা, এর বৈশিষ্ট্য, এবং বিভিন্ন আদালতের এখতিয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা কাকে বলে? [Suits of a Civil Nature]
দেওয়ানি কার্যবিধির ৯ ধারায় দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিধান দেওয়া হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, যে ধরণের মোকাদ্দমায় সম্পত্তি বা পদের অধিকার নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় তাকে দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা বলে। অর্থাৎ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি সম্পত্তি বা পদের অধিকার দাবি করে, তবে সেটি দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা হিসেবে বিবেচিত হবে, এমনকি যদি সেই অধিকার ধর্মীয় আচার বা সামাজিক উৎসবের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল হয়।
দেওয়ানি মামলাকে সাধারণত আদালতের ভাষায় “মোকদ্দমা” বলা হয়। এই ধরনের মামলা সম্পত্তির অধিকার বা দখল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে দায়ের করা হয়। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার বিরোধ বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যক্তির বিরোধ থেকে এই মামলাগুলো তৈরি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বিরোধের সমাধান হয় ক্ষতিপূরণ আদায় বা অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
রেস সাব জুডিস কি? রেস সাব জুডিস ও রেস জুডিকাটার মধ্যে পার্থক্য কি?
কোনো নাগরিকের অধিকার ও দায়িত্ব লঙ্ঘিত হলে সেখান থেকে দেওয়ানি মামলার উদ্ভব হয়। তবে নিছক ধর্মীয় রীতি, সামাজিকতা, বা গোত্রীয় রীতিনীতি নিয়ে কোনো বিরোধ থাকলে, যেখানে অধিকারের প্রশ্ন জড়িত নয়, সেগুলো দেওয়ানি মামলার আওতায় পড়ে না। তবে এই ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো সম্পত্তি বা পদের প্রশ্ন ধর্মীয় বা সামাজিক নিয়মের ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে আদালত সেই প্রশ্ন নিষ্পত্তির এখতিয়ার রাখে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্যক্তি তার গোত্র থেকে বহিষ্কৃত হয় এবং এতে তার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়, তবে এটি দেওয়ানি মামলার আওতায় পড়বে। একইভাবে, যদি কাউকে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে অপসারণ করা হয়, তবে সেটিও দেওয়ানি প্রকৃতির মামলা বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু ধর্মীয় নেতার বিশেষ সুবিধা সংক্রান্ত দাবি, গোত্রীয় ভোজসভায় নিমন্ত্রণ না করা, বা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে, যেখানে অধিকারের কোনো দাবি নেই, সেগুলো দেওয়ানি মামলার পর্যায়ে পড়ে না।
এভাবে, দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা কেবল তখনই তৈরি হয়, যখন কোনো ব্যক্তির অধিকার, সম্পত্তি বা পদ নিয়ে প্রশ্ন জড়িত থাকে। তবে, মামলার বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করবে যে সংশ্লিষ্ট মামলাটি দেওয়ানি প্রকৃতির কি না, পক্ষগণের মর্যাদার ওপর নয়। যদি মামলার বিষয়বস্তু দেওয়ানি প্রকৃতির হয়, তবে তা বিচার করার ক্ষমতা দেওয়ানি আদালতের থাকবে। কোনো আইন যদি সুস্পষ্টভাবে কোনো বিষয় নিষিদ্ধ না করে, তবে প্রতিটি দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ার অক্ষুণ্ন থাকবে। এই ধারাটি সাধারণ আইন এবং বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা সৃষ্ট ও সংরক্ষিত দেওয়ানি প্রকৃতির অধিকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য স্বীকার করে না।
কোনগুলি দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা?
বিভিন্ন আদালতের রায়ের ভিত্তিতে যে সমস্ত মামলা দেওয়ানি প্রকৃতির হিসেবে গণ্য হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:
১) সরকার বা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা কর্তৃক বা তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা।
২) চাকরি থেকে অবৈধভাবে অপসারণের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর মামলা।
৩) প্রার্থনা করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার মামলা।
৪) মুসলিম বা হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলা।
৫) কোনো সদস্যকে বেআইনিভাবে কোনো সামাজিক ক্লাবের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা।
কোনগুলি দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা নয়?
অন্যদিকে, যে সমস্ত মামলা দেওয়ানি প্রকৃতির নয় বলে বিবেচিত, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:
১) যে মামলার প্রধান বিষয় কোনো ধর্মীয় প্রথা বা অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত।
২) কোনো পদাধিকার সূত্রে পদমর্যাদার দাবি, যেমন- একটি মঠের স্বামী কর্তৃক উৎসবের সময় প্রধান প্রধান রাস্তায় পালকীতে বহন করার দাবি।
৩) যেখানে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তিতে বাদীর কোনো স্বত্ব নেই, কিন্তু কোনো দায়িত্ব পালনের দাবি জানানো হয়, যেমন- ট্রাস্টি কর্তৃক মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব পালনের দাবি।
৪) ধর্মীয় অনুসারীদের দ্বারা সম্মান ও সেবা পাবার দাবি।
৫) কোনো সম্পত্তি বা পদের অধিকার ছাড়া শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার দাবি সংক্রান্ত মামলা।
এই ধারা অনুযায়ী, দেওয়ানি আদালত শুধুমাত্র সেই মামলা গ্রহণ করবে যেখানে সম্পত্তি বা পদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমার প্রকারভেদ
৯ ধারার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা সাধারণত দুইটি প্রধান বিভাগে বিভক্তঃ
- প্রথমত, সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কিত মোকদ্দমা। উদাহরণস্বরূপ, বন্ধকী সম্পত্তি উদ্ধারের অধিকার, ঋণ আদায়ের অধিকার, অথবা সরকারি কর্মকর্তার বকেয়া বেতন উদ্ধারের অধিকার। এই সকল মামলা দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা হিসেবে গণ্য হয়।
- দ্বিতীয়ত, পদের অধিকার সম্পর্কিত মোকদ্দমা। যেমন, মুতওয়াল্লির পদের অধিকার সংক্রান্ত মামলা, যেখানে মুতওয়াল্লির পদের অধিকার হারানোর বিষয়ে নির্দেশনা চাওয়া হয়, অথবা কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের কোনো পদের অধিকার দাবি করেন।
চুক্তিভঙ্গের জন্য ক্ষতিপূরণের মোকদ্দমা বা ভাড়া আদায়ের মোকদ্দমা বা সুনির্দিষ্ট প্রতিকার যেমন চুক্তি বলবৎ, চুক্তি রদ, দলিল সংশোধন, দলিল বাতিল, ঘোষণামূলক মোকদ্দমা, নিষেধাজ্ঞা, সম্পত্তিতে দখল উদ্ধার ইত্যাদি সম্পর্কিত মোকদ্দমাগুলি দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা।
What is Woke Culture? Why is it so controversial?
বিভিন্ন প্রকারের দেওয়ানি আদালত
বাংলাদেশের দেওয়ানি আদালতসমূহ সিভিল কোর্টস অ্যাক্ট, ১৮৮৭ (Civil Courts Act, 1887) অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত। এই আইন ৩ ধারা অনুযায়ী, দেওয়ানি আদালতসমূহকে পাঁচটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছেঃ
- জেলা জজের আদালতঃ জেলা জজ আদালত দেওয়ানি বিষয়ের সর্বোচ্চ স্তরের আদালত হিসেবে কাজ করে। এই আদালত রিভিশনের ক্ষমতা প্রয়োগ করে এবং সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা মূল্যমানের দেওয়ানি আপীল নিষ্পত্তি করে। এছাড়া প্রবেট সংক্রান্ত মামলার শুনানি এখানেই অনুষ্ঠিত হয়, যা প্রবেট ও উইল সংক্রান্ত বিষয়াদি পরিচালনার ক্ষেত্রে এর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
- অতিরিক্ত জেলা জজের আদালতঃ অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত মূলত জেলা জজ আদালতের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জেলা জজ কর্তৃক প্রেরিত সকল মামলা এই আদালতে বিচারাধীন থাকে এবং এই আদালত সেসব মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি করে।
- যুগ্ম জেলা জজের আদালতঃ যুগ্ম জেলা জজ আদালত দেওয়ানি মামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর। এই আদালত পঁচিশ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে সীমাহীন অর্থমূল্যের দেওয়ানি মামলার বিচার করে। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়াদিসহ সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলা এখানে নিষ্পত্তি হয়। এছাড়া জেলা জজ কর্তৃক প্রেরিত আপীল ও রিভিশন মামলাগুলোর বিচারও এই আদালতে সম্পন্ন হয়।
- সিনিয়র সহকারী জজের আদালতঃ সিনিয়র সহকারী জজ আদালত সাধারণত মাঝারি মানের দেওয়ানি মামলা পরিচালনা করে। এই আদালত পনের লক্ষ টাকা থেকে পঁচিশ লক্ষ টাকার মধ্যে মূল্যমান সম্পন্ন দেওয়ানি মামলার বিচার করে থাকে।
- সহকারী জজের আদালতঃ সহকারী জজ আদালত হল সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ন আদালত, যেখানে সাধারণত ছোট মামলাগুলি যেমন সাধারণ সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলাগুলি পরিচালনা করা হয়। এই আদালত সর্বোচ্চ পনের লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের দেওয়ানি মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করে।
দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমাগুলি সাধারণত সম্পত্তি ও পদের অধিকার সম্পর্কিত থাকে এবং বাংলাদেশের দেওয়ানি আদালতসমূহের এই শ্রেণিবিন্যাস বিচারিক প্রক্রিয়াকে কার্যকর ও সহজতর করতে সহায়তা করে। প্রতিটি আদালত নির্দিষ্ট এখতিয়ার এবং বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে কাজ করে। বিচার প্রার্থী জনগণের জন্য এই কাঠামো সুবিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সঠিক স্তরে মামলা পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করে।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।
গাজায় যুদ্ধবিরতিঃ সহিংসতার সাময়িক বিরতি নাকি স্থায়ী শান্তির পথ?
যুগ যুগ ধরে সংঘাত চলমান গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এক গভীর প্রশ্ন উঠে আসে: এটি কি সহিংসতার একটি সাময়িক বিরতি, নাকি একটি স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা?
গাজা যুদ্ধ বিরতি চুক্তিঃ ইসরায়েল ও হামাসের ঐতিহাসিক সমঝোতা
দীর্ঘ ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর, অবশেষে ইসরায়েল ও হামাস গাজায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। কাতারের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় দোহায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।