অপেক্ষাকৃত সভ্য এই ইউরোপের ইতিহাস সপ্তদশ শতকেও ছিলো উত্তাল,ভয়ানক আর যুদ্ধবিগ্রহে বৃত্তের কেন্দ্রসম। অশান্তির লাগাম টেনে সভ্যতার এই মাপকাঠিতে পেরোনোর আছে এক বিশাল উপন্যাস। শুরু করলে সে লেখনীর শেষ টানতে আমার কয়েক রাত নির্ঘুমই কলম চালাতে হবে। আজকের লেখনীতে সেসবের হালকা মূর্ছনা দিয়ে অল্পেই যবনিকা টানতে হবে। নাহলে পাঠক আগ্রহ হারাবে মূল আলোচনায় যাওয়ার আগেই। আজকের আর্টিকেলটা লেখার পেছনে এক বড়ো ভাইয়ের লেখার অনুপ্রেরণা রয়েছে। ভাবলাম আমার কিছু পড়াশোনা এই বিষয়ে আছে, তো রাতজাগা কলমটা চলুক আমার পক্ষ থেকেও।
বলছিলাম সপ্তদশ শতকে ইউরোপের কলহের কথা। দফায় দফায় যুদ্ধে আহত নিহত মানুষের লাশ পাখির মতো পড়ে থাকতো। রাষ্ট্র হিসেবে তখনকার সময়ে বেশিরভাগ রাষ্ট্রই সার্বভৌম ক্ষমতা, অধিকার ভোগ করতে পারতো না। কিন্তু বর্তমান সময়ে প্রত্যেকটি রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা এবং পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের অধিকার সংরক্ষণ করে। এর কোনো ক্ষেত্রেই অন্য কোনো রাষ্ট্র কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যেকোনো ধরণের হস্তক্ষেপই আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হতে বাধ্য। সে সময়ে চলমান এসব হস্তক্ষেপ এবং যুদ্ধের অবসানে ভূমিকা রয়েছে আন্তর্জাতিক মন্ডলে প্ৰভাব বিস্তারকারী এক চুক্তির,যার নাম ওয়েস্টফেলিয়ান চুক্তি(Westphalian Treaty).
আজকের আলোচনার মূল বিষয়:
- ওয়েস্টফেলিয়ান চুক্তি (Westphalian Treaty)
- ওয়েস্টফেলিয়ান সার্বভৌমত্ব (Westphalian Sovereignty)
- হেজেমোনিক সার্বভৌমত্ব (Hegemonic Sovereignty
ওয়েস্টফেলিয়ান চুক্তি বা Westphalian Treaty
এটি একটি শান্তি চুক্তি। সপ্তদশ শতকে ইউরোপে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে প্রায় ত্রিশ বছর(৩০ বছর ) ধরে চলা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এই শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। ১৬১৮ সাল থেকে শুরু করে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত গড়ানো এই যুদ্ধের মোটামুটি সফল সমাপ্তি ঘটে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মাধ্যমে। স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, ওয়েস্টফালিয়ার, জার্মানি, সুইডেন, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, পোল্যান্ডসহ যুদ্ধে লিপ্ত ইউরোপের অনেক দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ধারণামতে, প্রায় এক কোটি(কোথাও ৮০ লক্ষাধিক উল্লেখ আছে) সামরিক ও বেসামরিক লোক হতাহত হয় এই যুদ্ধে। যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে ইউরোপে বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মোট ৩টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়-
- পিস অব মুনস্টার (নেদারল্যান্ডস বনাম স্পেন)
- মুনস্টার চুক্তি (রোমান সাম্রাজ্য বনাম ফ্রান্স)
- অসনাব্রুক চুক্তি (রোমান সাম্রাজ্য বনাম সুইডেন)
চুক্তির ফলাফলসরূপ –
- রাষ্ট্রসমূহ পরস্পরের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
- অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে এবং
- রাষ্ট্রের আইনগত সম অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় এই শান্তি চুক্তির ফলে। এছাড়াও এর অনেক গুরুত্ব ও ফলাফল রয়েছে। একইভাবে এই চুক্তির ফলে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন সংঘাতের জন্ম হয়েছিলো।
ওয়েস্টফেলিয়ান সার্বভৌমত্ব বা Westphalian Sovereignty
চুক্তির ফলাফলে উল্লেখ করেছিলাম,রাষ্ট্র সমূহ একে অন্যের সার্বভৌমত্বে(Sovereignty) হস্তক্ষেপ করবে না। ওয়েস্টফেলিয়ান সেই চুক্তি থেকেই আগত হয়েছে ‘ওয়েস্টফেলিয়ান সার্বভৌমত্ব’(Westphalian Sovereignty) টার্মটির। আমরা জানি,প্রত্যেকটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ডে অন্য দেশ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সার্বভৌম রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক সমস্ত কর্মকান্ডই তাদের সিদ্ধান্তে কার্যকর হয়। তাতে অন্য যেকোনো দেশের অযাচিত হস্তক্ষেপই আন্তর্জাতিক আইনে সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাই, একটা রাষ্ট্রের নিজ ভূখণ্ডে যদি তার চূড়ান্ত এবং সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বজায় থাকে তাহলে তাকে ওয়েস্টফেলিয়ান সার্বভৌমত্ব বলে। প্রশ্ন হচ্ছে এই সার্বভৌমত্বের প্রথা, আইন থাকার পরেও বিশ্বের পরাশক্তি গুলো বিশেষ করে আমেরিকা কিভাবে অন্য দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে? কিভাবে ইরাকের, লিবিয়ার, সিরিয়ার, আফগানিস্তানের সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অযাচিত হস্তক্ষেপ চালিয়ে যাচ্ছে? পরবর্তি আলোচনায় কিংবা লেখনীতে এর অনেক গুলো উত্তর থাকবে তবে এর বিপরীতে একটি বিশেষ টার্ম পরিচয় করিয়ে দিবো সেটি হলো Hegemonic Sovereignty.
হেজেমোনিক সার্বভৌমত্ব বা Hegemonic Sovereignty
ওয়েস্টফেলিয়ান শান্তিচুক্তি অনুযায়ী কিংবা আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী আমেরিকার প্রত্যেকটি হস্তক্ষেপই আন্তর্জাতিক আইনে লঙ্ঘন এবং অপরাধ। কিন্তু বিশ্বে আমেরিকার প্রভাব বিস্তার করতে এবং পূর্বে করা হস্তক্ষেপকে বৈধতা দিতে তারা এই হেজেমোনিক সার্বভৌমত্ব নামক বিশেষ টার্মটির সূচনা ঘটায়। বিশ্বের যেকোনো দেশে যদি গণতন্ত্র না থাকে এবং মানবাধিকার ভঙ্গ হয় তাহলে সে দেশে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার(কথিত মানবাধিকার, নাটক) প্রতিষ্ঠা করতে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারবে এবং অবশ্যই সেটা বৈধ হবে। একেই Hegemonic Sovereignty বলে। এরই মাধ্যমে আমেরিকা সাদ্দামের দেশে আক্রমন (ইরাক আক্রমন, ২০০৩ সালে। অভিযোগ ছিলো, WMD বা Weapons of Mass Destruction কিংবা গণ বিধ্বংসী অস্ত্র আছে এই দোহাই দিয়ে), লিবিয়ায় আক্রমন(২০১১), আফগানিস্তান সহ বিভিন্ন দেশে আক্রমণ কিংবা অবৈধ হস্তক্ষেপকে বৈধতা দিচ্ছে। আজকের এই সময়ে এসে Hegemonic Sovereignty নামক এই টার্মটি শক্তিশালী হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার কৃত অপকর্মের বৈধতা দিচ্ছে।দিনদিন বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের এই নগ্ন হস্তক্ষেপ বেড়েই চলছে।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।