আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে পশতুনিস্তান সমস্যা অন্যতম যা গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে আজও অমিমাংসিত অবস্থায় বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। পশতুনিস্তান, পাকতুনিস্তান নামেও পরিচিত যার অর্থ “পশতুদের দেশ”। এটি ভাষীর জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের কিছু অঞ্চল নিয়ে গঠিত একটি ঐতিহাসিক ভৌগোলিক অঞ্চল। ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়ার পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং এর পরই পশতু ভাষাভাষী অঞ্চলের সার্বভৌমত্বের দাবি নিয়ে আফগানদের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত বিরোধ শুরু হয়। এটিই পশতুনিস্তান বা পাকতুনিস্তান সমস্যা।
পশতুনিস্তান সমস্যা
আহম্মদ শাহ আবদালী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আফগান রাজ্য ও ভারতের সীমানা নির্ধারিত ছিলনা। কিন্তু ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আগমনের পরই আফগানিস্তানের সীমানা নির্ধারণ অতীব জরুরী হয়ে পড়ে কেননা তখন ব্রিটিশদের ক্ষমতা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় ঈঙ্গ-আফগান যুদ্ধের পর ১৮৯৩ সালে আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত রেখা নির্ধারিত হয় যা ডুরাল্ড লাইন নামে পরিচিত। ১৮৯৩ সালে স্যার মার্টিমার ডুরাল্ড এবং আব্দুর রহমানের মধ্যকার চুক্তি অনুসারে ডুরাল্ড লাইনের দক্ষিণাঞ্চল তথা চিত্রল ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত (দিরত্রির, সওয়াত ও রাজাউর অঞ্চল) এবং বেলুচিস্তান পাঠান এলাকা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে আসে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগকালে আফগান সীমান্তে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং উত্তরাধিকারসূত্রে ডুরাল্ড লাইনের দক্ষিণাঞ্চলের মালিকানা লাভ করে পাকিস্তান। কিন্তু এতে সৃষ্টি হয় এক নতুন বিপত্তির। আফগানরা এর চরম বিরোধিতা শুরু করে, তাদের দাবী যেহেতু ব্রিটিশরা উক্ত অঞ্চলসমূহ জোড়পূর্বক আফগানদের নিকট থেকে দখল করেছে সেহেতু ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের পর উক্ত অঞ্চল থাকবে শুধুই আফগানদের অধীনে নতুবা উক্ত অঞ্চল জন্মলাভ করবে এক নতুন রাষ্ট্র হিসেবে যার নাম হবে “পাকতুনিস্তান”। কিন্তু পাকিস্তান তাদের এ দাবী মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় আর এতে করেই উভয়ের মাঝেই সৃষ্টি হয় এক চরম উত্তেজনার। আর এভাবেই উদ্ভব ঘটে পাকতুনিস্তান সমস্যার।

তবে, স্বাধীন পাকতুনিস্তানের দাবি সর্বপ্রথম ওঠে আফগান শাসক জহির শাহের রাজত্বকালে। ঐতিহাসিকভাবে যেহেতু উক্ত অঞ্চল পশতু ভাষাভাষীদের, সেহেতু তিনি এ অঞ্চলকে আফগানিস্তানের অংশ হিসেবে দাবি করেন এবং এর প্রেক্ষিতে গড়ে তোলেন এক আন্দোলন যা “পাকতুনিস্তান আন্দোলন” নামে পরিচিত।
মূলত এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি ছিলেন বর্ষিয়ান লালকোর্তা নেতা আব্দুল গাফ্ফার খান। তৎকালীন ভারতের উত্তর- পশ্চিম সীমান্তে বিশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি প্রচার ও ধারণ করার জন্য তাকে সীমান্ত গান্ধী উপাধী দেয়া হয়। তিনি ওই এলাকায় একটি পাঠান রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন এবং আফগান সরকার উক্ত অঞ্চলের উপর গণভোট দাবি করে কেননা তাদের মতে, কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই ব্রিটিশ সরকার উক্ত অঞ্চল পাকিস্তানকে দিতে পারেনা। পশতু ভাষাভাষীরা পাকিস্তান না আফগানিস্তানের সাথে থাকবে এ ব্যাপারে আফগানরা গণভোটের দাবি করলেও ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তা নাকচ করা হয়।
মরক্কোর জাতীয়তাবাদি আন্দোলন ও সুলতান মুহাম্মাদ
আফগানদের উক্ত অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব দাবি করার অন্যতম কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত। কেননা আফগানিস্তানের চতুর্দিকে কোনো সমুদ্র বন্দর নেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মের পূর্বে অর্থাৎ, ১৯৪৭ সালের পূর্বে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে আফগানদের ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে আফগানরা বিরাট অসুবিধার সম্মুখীন হয়। এর সমাধানকল্পে তারা ভেবেছিল, উক্ত অঞ্চলে পাঠান রাষ্ট্র গঠিত হলে তারা সেটাকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে সেজন্যই তারা পশতুনিস্তান সমস্যা তুলে ধরে কিন্তু পাকিস্তান তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেনি। পর্যায়ক্রমিক বেশ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ আন্দোলন পরবর্তীতে ব্যাপক আকার ধারণ করে।
প্রথম পর্যায় (১২ আগস্ট, ১৯৪৭ সাল)
আফ্রিদি জাতির লোক Tinai Bagn এ মিলিত হয় এবং ঘোষণা দেয় তাদের মাতৃভূমির কেন্দ্রস্থলে একটি দেশ প্রতিষ্ঠার। একই সময় অন্য জায়গা Raznak এ মিলিত হয়ে ফাকিরকে পাকতুনিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। এতে করে এই সমস্যা আরো প্রকট রূপ ধারণ করে। পাকিস্তান সরকার ফাকিরসহ আরো অনেক বিদ্রোহী নেতাকে গ্রেফতার করেন।
দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৫৩ সাল)
দাউদ খানও পাঠান রাজ্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন। তিনি ১৯৫৩ সালে একটি আন্দোলনও গড়ে তোলেন যার লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন পাঠান রাষ্ট্র গঠন। তিনি দাবি উত্থাপন করেন যে, ” হয় পাঠানরা আফগানিস্তানের সাথে যুক্ত হবে নতুবা তারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবে।”
তৃতীয় পর্যায় (১৯৫৫ সাল)
১৯৫৫ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পাকিস্তানকে পূর্ব ও পশ্চিম এ দু’প্রদেশে ভাগ করার প্রস্তাব সংসদে পাশ করার পূর্বেই আফগান সরকার পাকিস্তানকে তীব্র নিন্দা করে। ৩০ শে মার্চ ১৫ হাজার আফগান কাবুলে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাস আক্রমণ করে, আসবাবপত্র ভাংচুর করে, পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলে শুধু তাই নয় আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানি কূটনীতিককে প্রত্যাহার করা হয় এবং পাকিস্তান থেকে আফগান কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৫৮ সালে ইরাকের সামরিক বিপ্লবের পটভূমি
পশতুনিস্তান সমস্যার সমাধান কি আদৌ হয়েছে? আসুন সে সম্পর্কেও জেনে নেওয়া যাক। এ সমস্যা সমাধানের বেশ কিছু প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হলেও আজও তার নিষ্পত্তি ঘটেনি।
- ১৯৪৭ সালে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে সর্বপ্রথম প্রচেষ্টা চালান আফগানিস্তানের নজিবুল্লাহ্ ও পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ কিন্তু তা ব্যর্থ হয়।
- ১৯৫৫ সালে আফগান প্রধানমন্ত্রী তাদের দূতাবাসে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করেন। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৬ সালে আফগান সফরে যান। এতে করে দু’দেশের বৈরী সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কিন্তু পরের বছর বৈরীতার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ঐ বছর পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্র হতে যুদ্ধাস্ত্র আমদানী করে এতে করে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে আফগানিস্তান। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে।
- মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান ও সৌদি আরব উক্ত সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় দু’দেশের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসে কিন্তু সেটিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এছাড়া ১৯৬১ সালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এম এইচ মেইনডলের প্রচেষ্টায় উক্ত সমস্যার সাময়িক উন্নতি হয়। অপরদিকে রুশ প্রেসিডেন্টও এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন কিন্তু কোনো সুরাহা মেলানি। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে চলমান এই সীমান্ত সমস্যা ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সৃষ্ট ডুরাল্ড লাইনকে কেন্দ্র করেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত আফগানিস্তানের সাথে এই “পাকতুনিস্তান” বা “পশতুনিস্তান” নামক সমস্যা রয়েই গেছে।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।