ঐতিহাসিক এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তুরস্ক। কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (PKK) চার দশকের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতি টেনে বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছে। পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক যুগান্তকারী মোড়। এই ঘটনা একদিকে যেমন তুরস্কের জন্য দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসানের সুযোগ নিয়ে এসেছে, অন্যদিকে কুর্দিদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে। দীর্ঘ চার দশকের সশস্ত্র সংগ্রাম থামিয়ে PKK যদি সত্যিই ডেমোক্র্যাটিক স্বীকৃতি ও সম্প্রীতির পথে পা রাখে, তবে তা শুধুমাত্র তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই নয়, সমগ্র অঞ্চলের নিরাপত্তা-বিভাজন ও রাজনৈতিক সমন্বয়ের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলবে। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, অস্ত্র সমর্পণ এবং বন্দী নেতাকে মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া যতটা সহজ মনে হচ্ছে, তার চেয়েও জটিল—বিশেষ করে তুরস্কের কঠোর নিরাপত্তা নীতিমালা, PKK-র ভাঙা শাখা সংগঠন এবং আন্তঃদেশীয় কুর্দ শুরঙ্খলা নিয়ে সন্দেহ আরো বাড়িয়ে তুলেছে। প্রশ্ন হলো, আঙ্কারা কি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, নাকি কুর্দিদের অধিকার আরও সংকুচিত হবে?
পিকেকে-র বিলুপ্তি: সংগ্রাম থেকে সরলতার যাত্রা?
১২ মে, ২০২৫ তারিখে পিকেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, তারা তাদের সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছে এবং সংগঠনের কাঠামো ভেঙে দেওয়া হবে। বন্দী নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের আহ্বানের প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওজালান দীর্ঘদিন ধরে কুর্দিদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলে আসছেন।
তবে, পিকেকে-র এই সিদ্ধান্তকে সরলভাবে দেখলে চলবে না। তুরস্কের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, কুর্দিদের প্রতি দেশটির সরকারের নীতি এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশগুলোও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। PKK ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তুর্কি সংগ্রাম-ইতিহাসে ভয়াবহ অধ্যায় হিসেবে ফিরে এসেছে; ১৯৮৪–২০২৫ সংঘর্ষে আনুমানিক ৪০,০০০–৪৫,০০০ মৃত্যুর ঘটনা এ সংগঠনের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। অতীতে অনিয়মিত দ্বন্দ্বময় অধ্যায় গিয়ে যার রাজনৈতিক মিশন হারিয়ে গেছে, সেই সংঘাত এখন শান্তিশৃঙ্খলার দিকে অগ্রসর হতে চাইছে—এমন পরিবর্তন কল্পনাতীত। কিন্তু এও সত্যি যে, PKK কখনো এককভাবে অস্ত্র ত্যাগের ঘোষণা দেয়নি; বরং ইরাক-সিরিয়া সীমান্তবর্তী নিজেদের ভরসার স্থাপনা ও সিল্ক রোডের মতো জটিল নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের ভেতর দিয়ে দানা বাঁধে তারা।
রাজনৈতিক স্বীকৃতি বনাম সন্ত্রাস বর্ণনা
PKK-র বন্দী নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের আহ্বান—“দলীয় কাঠামো বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত শান্তি অসম্ভব”—এখন এক ঐতিহাসিক বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। তবে তুরস্ক সরকার আজ পর্যন্ত PKK-কে “সন্ত্রাসী” হিসেবে ঘোষণা করে রেখেছে; তাই অস্ত্রবিরতির কোনো কর্মফল পেতে হলে, তাঁরা প্রথমে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে PKK-কে ওয়ার্কিং গ্রুপ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে কি না, সেটি প্রমাণের খাতা খুলে দেবে।
অস্ত্র সমর্পণ ও বাস্তবায়ন
PKK ৫–৭ মে আয়োজিত কংগ্রেসে “সংগঠন বিলুপ্ত করে সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধ” করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, অস্ত্র সমর্পণ প্রক্রিয়ার সূচনাঙ্ক সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা ঠিক করেনি। Firat News Agency’র মতে, সকল দলকে একই নিয়মে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। এতে প্রশ্ন জাগে—PKK-র সিরিয়া শাখা ও দেশের অভ্যন্তরীণ ভাঙা গেরিলা ইউনিটগুলো সঙ্গী হবে কি?
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
এরদোয়ান সরকার পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে, অতীতে দেখা গেছে, তুরস্ক সরকার কুর্দিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিলেও, শেষ পর্যন্ত নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এরদোয়ান সরকারের সামনে এখন দুটি পথ খোলা রয়েছেঃ
১. পিকেকে-র বিলুপ্তি ঘোষণার সুযোগ নিয়ে কুর্দিদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং একটি নতুন তুরস্কের জন্ম দেওয়া।
২. পুরোনো পথে হেঁটে কুর্দিদের দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখা, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
তুরস্কের রাজনৈতিক দিকঃ কুর্দিদের অধিকার নাকি নতুন সংকট?
পিকেকে-র বিলুপ্তির ফলে কুর্দিদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কুর্দিদের অধিকার আদায়ের জন্য পিকেকে দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে। এখন সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে, কুর্দিদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
এর বিপরীত সম্ভাবনাও রয়েছে। পিকেকে-র বিলুপ্তির পর কুর্দি রাজনৈতিক দলগুলো যদি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তুরস্কের মূলধারার রাজনীতিতে নিজেদের স্থান করে নিতে পারে, তাহলে কুর্দিদের অধিকার আদায়ের পথ আরও প্রশস্ত হতে পারে। তবে, রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের সরকার যদি PKK’র ডেজিগনেশন পরিবর্তন না করে, তাহলে সদস্যদের পুনর্বাসন ও রাজনৈতিক সংলাপ কার্যত ব্যর্থ হবে। এ অবস্থায় PKK’র পক্ষ থেকে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের সম্ভাবনা থাকলেও, তুরস্কের শক্তিশালী নিরাপত্তা আইন এবং সন্ত্রাস বিরোধী আইন তা খুব দ্রুতই ঠেকিয়ে দিতে পারে।
আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি: নতুন মেরুকরণ?
পিকেকে শুধু তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। সিরিয়া এবং ইরাকের কুর্দি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পিকেকে-র শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। পিকেকে-র বিলুপ্তির পর এই অঞ্চলগুলোতে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হতে পারে। সিরিয়া ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স (SDF) ইতিমধ্যে মানবিক সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে নিজেদের স্থিতিশীলতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে, তুরস্ক-ইরাক সীমান্তবর্তী এলাকা এখনো ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর নিরাপত্তা ফাঁক ফোকর দ্বারা বিপজ্জনক—সেখানে কয়েক শ’ PKK-সদস্য অনুপ্রবেশ করে বসতির ওপর হামলা চালাতে পারে। তুরস্কের জন্য এটি একটি সুযোগ। আঙ্কারা যদি কুর্দিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, তাহলে সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে তুরস্কের প্রভাব আরও বাড়বে।
PKK-র ঘোষণা ঐতিহাসিক হলেও, এটি পাথেয় নাকি মর্যাদাহানি—কিছুই এখনও নিশ্চিত নয়। প্রথমত, তুরস্কের কট্টরপন্থী নিরাপত্তা নীতিমালা আন্তরিক আলোচনার পথকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, PKK-র ভাঙাচোরা শাখা সংগঠনগুলো যদি রাজনীতিতে অংশ না নেয়, তাহলে আত্মসমর্পণ অপূর্ণ থেকে যাবে। এবং সর্বোপরি, বন্দী ওজালানের মুক্তির প্রতি তুর্কি সরকারের প্রতিক্রিয়া—যেখানে বিচারিক স্বাধীনতা প্রশ্নের মুখে—সেই চূড়ান্ত শান্তিপূর্ণ সমাধির মূল চ্যালেঞ্জ। এরদোয়ান সরকারকে প্রমাণ করতে হবে, তারা সত্যিই শান্তি চায় এবং কুর্দিদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। অন্যথায়, পিকেকে-র বিলুপ্তি কুর্দিদের জন্য নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে।
PKK-র অস্ত্র ত্যাগের ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র দ্বন্দ্বের সমাপ্তির প্রত্যাশা জাগিয়েছে, তবে এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নির্ভর করছে তুরস্কের আইন-শৃঙ্খলা নীতির নমনীয়তার ওপর। এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যেখানে কুর্দিদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা হবে। একইসাথে, তুরস্ককে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির কথা মাথায় রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশল তৈরি করতে হবে।
এই কৌশলকে শুধু সম্প্রীতির পদক্ষেপ বলে নয়, বরং গভীর রাজনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে দেখা দরকার—যাতে কুর্দ জনগোষ্ঠী ও তুর্কি রাষ্ট্র একত্রে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথে এগোতে পারে।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল তার প্রকৃত কারণ
কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল? আন্তর্জাতিক বিচারের হাত থেকে বাঁচতে, গাজার নিপীড়ন থেকে দৃষ্টি সরাতে ও ইহুদি আধিপত্য জাহিরের হতাশাজনক প্রচেষ্টা।
সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রেরঃ নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা
গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ
গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।
পিকেকে-র বিলুপ্তি: তুরস্কের জন্য সুযোগ নাকি কুর্দিদের জন্য নতুন সংকট?
পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা: তুরস্কের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ, নাকি কুর্দিদের জন্য অধিকার হারানোর নতুন ঝুঁকি?
অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুসঃ ভারতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা
পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে "অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস" নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটির অর্থ "গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর"।