গত বুধবার ভারতের কর্ণাটকের মেয়ে মুসকান খান বেশ ঝড় তুলেছে, প্রতিবাদের ঝড়। এই ঝড় মুসকান খানের হিজাব বিদ্রোহের ঝড়। এবং এই ঝড়কে বিদ্রোহের ঝড় বলাটাও মনে হয়না ভুল হবে। আর এই ঝড়ের ঝড়ো হাওয়া ভারতের প্রতিবেশীদের নাড়িয়ে দিয়েও সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সারা বিশ্ব মুগ্ধ মুসকানের এই প্রলয়ঙ্করী আবির্ভাবে। যে গুণ নিজের জন্য আবশ্যক হলেও, যারা ঘরের কোনে ঘাপটি মেরে বসে থাকে তবু প্রতিবাদ করে না অন্যায়ের, তারাও মুসকান খানের হিজাব বিদ্রোহে এই ‘একাই একশো’ রূপ দেখে বিমুগ্ধ, বিমোহিত।
মুসকান খানের হিজাব বিদ্রোহ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, মুসকান স্কুটিতে করে কলেজে আসে। কলেজের নির্দিষ্ট স্থানে বাইক রেখে মুসকান ক্লাসের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করে। প্রতিদিনের মত মুসকান সেদিনও তার বোরকা-হিজাবে কলেজে এসেছিল এসাইনমেন্ট জমা দিতে। কলেজের বাইরে অনেকেই ছিল যারা তাকে বোরকা পরে কলেজে ঢুকতে বাঁধা দিয়েছিল। আর কলেজের ভেতরে গেরুয়া রুমাল ঘাড়ে, হাতে নিয়ে আগে থেকেই প্রাঙ্গনে অবস্থান করা করছিল কট্টরপন্থি হিন্দু কিশোর-যুবকদের একটা দল।
Secular India and the Nature of its so-called Secularism

তারা মুসকানকে দেখেই ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেয়া শুরু করে এবং মুসকানের দিকে উস্কানি দিতে দিতে এগোতে থাকে। মুসকান শুরুতে পাশ কাটিয়ে এগোলেও পরে ওইসব কিশোর-যুবকদের উস্কানীর প্রতিবাদে ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিতে দিতে একাই প্রাঙ্গন পার হতে থাকে। তখনি গেরুয়া কিশোর-যুবকেরা তার দিকে দ্রুত এগোতে থাকলে দু-একজন কর্তাব্যক্তি মুসকানকে নিরাপত্তা দিয়ে গেরুয়া কিশোর-যুবকদের সরিয়ে নেন।
এরপর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেলে কর্ণাটকের ওই ঘটনা আলোচনায় আসে। মুহুর্তের মধ্যে টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয় ওই ঘটনা। বিশ্ব আলোচনায় উঠে আসে বিজেপি শাসিত কর্ণাটকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের বোরকা-হিজাবে নিষেধাজ্ঞার খবর।
আরো পড়ূনঃ What is cultural aggression? How does it threaten world cultural diversity?
মূলত গত ডিসেম্বর থেকেই হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে কর্ণাটকে। আর জানুয়ারিতে ছয় মেয়ে শীক্ষার্থীকে ক্লাসে ঢুকতে না দিয়ে বাইরে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। তখন থেকেই মূলত প্রতিবাদ দানা বাধতে শুরু করে। বোরকা-হিজাব পরিহিত মেয়েরা ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তাদের অনুপস্থিত দেখানো হয়। এর প্রতিবাদে কর্নাটকসহ পাশের রাজ্যেও প্রতিবাদ শুরু হয়।
ধীরে ধীরে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ আলোচনা করেও কোন সুরাহা করতে পারেনি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মুসকানের প্রতিবাদের ওই ভিডিওর ধাক্কা সরকার সামাল দিতে তিনদিনের জন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ঘোষনা করে এবং এর আশেপাশে কোন ধরণের জনাসমাগম দুই সপ্তাহের জন্য নিষিদ্ধ করে।
সর্বশেষ, বিক্ষোভকারীরা আদালতে হিজাব নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে পিটিশন দায়ের করে। আদালত ব্যাপারটি ‘জটিল এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ’ বিবেচনায় বিশদ পর্যবেক্ষনের জন্য নতুন বেঞ্চের নিকট পাঠিয়েছে।
কিন্তু ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে’র দেশে কি মুসকানদের ওপর এটা নতুন কিছু নাকি অনেক দিন ধরেই এসবের মুখোমুখি হতে হচ্ছে? মুসকানদের এই লড়াইয়ের চিত্র কি শুধু ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে’র দেশ ভারতেই চোখে পড়ে নাকি ‘নারী স্বাধীনতার দেশ’ ইউরোপেও এমন হরহামেশাই দেখা যায়? মুসকানের প্রতিবাদ কি কোন নারীর ব্যাক্তি স্বাধীনতা আদায়ের লড়াই নাকি ধর্মীয় স্বাধীনতার লড়াই?
How Sikkim became a part of India?
কর্ণাটকের মুসকান এমন সব প্রশ্নের পাশাপাশি আরো কতগুলো প্রশ্ন চোখের সামনে তুলে ধরেছে। মুসকানের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা যদি নারীর স্বাধীনতার ওপর বৈষম্যমূলক হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হয় তাহলে এক উত্তর আসবে আর যদি সেটাকে ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে ভিন্ন উত্তর আসবে। আবার এটাকে যদি সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু ভারতের ঘটনা হিসেবে দেখি তাহলে উত্তর কি হবে আর সারা বিশ্বের একটা আয়না হিসেবে হিসেবে দেখি তাহলে কি উত্তর আসবে সেটাও বিবেচ্য বিষয়।
মুসকানের ঘটনাকে এককভাবে শুধু নারীর স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ কিংবা ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বরং যুগপতভাবে এদুটো প্রশ্নই তুলতে হবে।
নারীদের ওপর এমন কাপুরোষিত আক্রমন কিংবা বৈষম্যমূলক আচরণ এটা নতুন নয়। এটা ভারতের হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষের মত ছড়িয়ে আছে। নারীদের শিক্ষা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখা, আতিথেয়তার একটা রূপ হিসেবে নারীদের অতিথীদের শয্যাশয়ী করা, নারীদের স্বাধীনতার নামে অর্ধ-উলংগ করে রাখা, পরিপূর্ণ পোষাক পরিধানে খাজনা প্রদানে বাধ্য করা, ঋতুবর্তীকালীন সময়ে মেয়েদের সমাজ-গ্রাম থেকে দূরে একাকী এক ঘরে থাকাকে বাধ্য করা, এসব একদিনের চর্চা নয়। ধর্মের নামে, প্রগতিশীলতার নামে সবচেয়ে বেশী অধর্ম আর কুসংস্কারের চর্চা ভারতেই হচ্ছে এই শতকে এসেও।
2 Comments
Leave A Comment
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।
[…] […]
[…] […]