ইসলাম এমন এক ধর্ম যেখানে শুধু মুসলিম নয় বরং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও জানমালের নিরাপত্তার অধিকার সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতেও বসবাসরত ভিন্ন ধর্মী সংখ্যালঘুরা নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আন্তঃধর্মীয় সংঘাতের সমস্যায় জর্জরিত, যেখানে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঘরছাড়া করেছে, সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে এবং দেশগুলোতে মানুষের বিশ্বাস ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে নষ্ট করে দিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার উপর জোর দেওয়ার জন্য একটি ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও কার্যকর করার জন্য ধর্মীয় বিশ্ব নেতারা ২৫ থেকে ২৭ শে জানুয়ারী মারাকেশে মিলিত হন। মরোক্কোর এনডাউমেন্টস অ্যান্ড ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এই সম্মেলনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক একটি থিংক ট্যাঙ্ক ফোরাম ফর দ্য প্রমোশন অব পিস ইন মুসলিম সোসাইটি। নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে সকলকে সচেতন ও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই মারাকেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
কারা মারাকেশ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
মরোক্কোর এনডাউমেন্টস অ্যান্ড ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ২০১৬ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে এই সম্মেলনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক একটি থিংক ট্যাঙ্ক ফোরাম ফর দ্য প্রমোশন অব পিস ইন মুসলিম সোসাইটি, যার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ আবদুল্লাহ বিন বায়িয়া। মুসলিমসংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের ধর্মবিশ্বাসী, সুন্নি ও শিয়া ইসলামী পণ্ডিত ও অ্যাক্টিভিস্ট, মুফতি, ইসলামী বিশ্বের সংখ্যালঘু (আহমদিয়া সহ) এবং বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বকারী ধর্মীয় পণ্ডিতরা মারাকেশে জড়ো হয়েছিলেন।
বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মোট ৩৪০ জন ইসলামী পন্ডিত, আইনজ্ঞ, মুফতি (যারা ফতোয়া জারি করতে যোগ্য) এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সরকারি মন্ত্রীরা, খ্রিস্টধর্মসহ ইসলামী বিশ্বের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, নাইজেরিয়া, সৌদি আরব, মিশর এবং আয়োজক দেশ মরক্কোর মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন পাকিস্তানের হানাফি ইসলামী পন্ডিত ও মুফতি মোহাম্মাদ তাকি উসমানী, ইরানের শিয়া ধর্মগুরু আয়াতুল্লাহ সায়েদ মোস্তফা মোহাঘেগ দামাদ, ইরাকের ইয়াজিদি নেতা খালিদ আমিন রুমি, ফিলিস্তিনের বিশপ মুনিব ইউনান উপস্থিত ছিলেন।
মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাও এতে অংশ নেন। দু’দিন ধরে, অনেক অংশগ্রহণকারী একটানা সেশনে এই আলোচ্য বিষয়গুলো তুলে। পৃথক ব্রেক-আউট সেশনে, অমুসলিম অংশগ্রহণকারীরা কার্যপ্রণালী এবং ঘোষণাপত্রটি আকার নেওয়ার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করার জন্য জড়ো হয়েছিল, যখন মুসলিম সহকর্মীরা ঘোষণার কাঠামো এবং ভাষা নিয়ে বিতর্ক করতে মিলিত হয়েছিল।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা বিশেষ করে জোর দিয়েছিলেন যেন এই উদ্যোগের সাথে পদক্ষেপও নেয়া হয়। বেশ কয়েকজন মুসলিম বক্তা বিশ্বজুড়ে মুসলিম সংখ্যালঘুদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবিচার সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছেন। তারা এমনটাও উল্লেখ করেছেন যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলিতে সংখ্যালঘুদের জন্য একই মান নিশ্চিত না করা পর্যন্ত মুসলমানরা মুসলিম সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং অধিকার দাবি করতেও পারে না।
হরমুজ প্রণালী ও সমকালীন বিশ্ব অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব পড়ুন
মরক্কোতেই কেন এই সম্মেলন?
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আন্তঃমুসলিম ধর্মীয় সংঘাতের সমস্যায় জর্জরিত, যেখানে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে, লাখ লাখ মানুষকে ঘরছাড়া করেছে, সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে এবং দেশগুলোতে মানুষের বিশ্বাস ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে নষ্ট করে দিয়েছে।
এই সহিংস সংঘাতের প্রতিক্রিয়ায় সাংবিধানিক আইন বিশারদ শেখ আবদুল্লাহ বিন বাইয়াহ, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মরক্কো ভিত্তিক ফোরাম ফর দ্য প্রমোশন অব পিস ইন মুসলিম সোসাইটির তত্ত্বাবধানে ২৫ থেকে ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে মরক্কোর মারাকেশে যৌথভাবে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন।
আয়োজকরা মরক্কোকে তার মধ্যপন্থী অবস্থান, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রশংসা এবং বিগত কয়েক বছর ধরে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতির কারণে এই শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের জন্য বেছে নিয়েছেন। মরক্কোতে খ্রিস্টানরা নির্যাতন বা কোনো ধরনের শারীরিক বা মানসিক নিপীড়নের শিকার হয় না একারণে একে একটি “সহনশীল দেশ” হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। মরক্কোর মারাকেশে আয়োজিত এই সম্মেলনটি ইসলামের ইতিহাসের শেষ ১৪০০ বছরের মধ্যে এই ধরনের প্রথম আয়োজন।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কিত মারাকেশ ঘোষণাপত্র
মরোক্কোর এনডাউমেন্টস অ্যান্ড ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে সকলকে সচেতন ও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও ঘোষণাপত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে মারাকেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
নানা রাজনৈতিক মেরুকরণে বিভক্ত মুসলিম নেতারা আধুনিক ইতিহাসে এই প্রথম ধর্মীয়ভাবে বৈধ নিপীড়ন ও বৈষম্যের এত স্পষ্ট প্রতিবাদ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোর মধ্যে এমন একটি সুস্পষ্ট ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করেছেন।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কিত মারকেশ ঘোষণাপত্রটি প্রণয়নের সময় সম্মেলনে মদিনা সনদের থেকে অনুপ্রেরণা নেয়া হয়। প্রায় ১৪০০ বছরের পুরানো মদিনা সনদ থেকে মারকেশ ঘোষণাপত্রটি অনুপ্রাণিত, যা মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনার প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রগুলির মধ্যে শান্তি স্থাপনের প্রয়াসে উপস্থাপন করেছিলেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্র সম্পর্কে পড়ুন
মদিনা সনদ কী যারা জানে না তাদের জন্য একটি সদয় তথ্য যে, মদিনা সনদ ঐতিহাসিক মুসলিম শহর মদিনায় মুসলমান এবং ইহুদিদের মধ্যে একটি নগর-রাষ্ট্রের ভিত্তি যা ৬২২-৬২৪ খ্রিস্টাব্দে লিখিত হয়েছে। এটি ছিল ইসলামের প্রথম লিখিত সংবিধান এবং ইতিহাসে সাংবিধানিক আইনের প্রথম নথিভুক্ত সনদ। এটি সংঘাত নিরসনের একটি ঐতিহাসিক ইসলামী উদাহরণ। সপ্তম শতাব্দী থেকেই নথিটি একটি বহুধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি গঠন করে এবং মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনায় পৌঁছানোর অল্প সময়ের মধ্যেই কার্যকর করা হয়েছিল।
মদিনা সনদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে জাতীয় সংবিধানের জন্য একটি উপযুক্ত কাঠামো সরবরাহ করা এবং জাতিসংঘ সনদ এবং মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার মতো দলিলগুলো মদিনার সনদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেই তৈরি করা হয়।
বিশেষ করে, মদিনা সনদে মুসলিম ও অমুসলিমদের ক্ষেত্রে সনদের “সাংবিধানিক চুক্তিভিত্তিক নাগরিকত্বের নীতিমালা” এবং “চলাচলের স্বাধীনতা, সম্পত্তির মালিকানা, পারস্পরিক সংহতি এবং প্রতিরক্ষা, পাশাপাশি আইনের সামনে ন্যায়বিচার ও সমতার নীতিগুলি” উল্লেখ করা হয়েছে।
মারাকেশ সম্মেলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
২০১৬ সালে মরক্কোয় আয়োজিত মারাকেশ সম্মেলনে খ্রিস্টান সহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার উপর জোর দিয়ে একটি ঘোষণাপত্র জারি করা ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। মারাকেশ ঘোষণাপত্র পর্যালোচনা করলে আরো বিশদভাবে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। যাইহোক, মুলতঃ মারাকেশ ঘোষণাপত্রের ছয়টি উদ্দেশ্য রয়েছে, যেমনঃ
অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিকত্বের ওপর নতুন আইনশাস্ত্রের বিকাশ;
অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিকত্বের উপর নতুন আইনশাস্ত্রের বিকাশের সাথে আইনী নীতি এবং ব্যাখ্যাগুলির বিবর্তন জড়িত যা জাতি, লিঙ্গ, জাতিগততা, ধর্ম বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে সমস্ত ব্যক্তির জন্য সমান নাগরিকত্বের অধিকার এবং সুযোগকে উৎসাহিত করে। নাগরিকত্বকে প্রভাবিত করে এমন আইন এবং নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্তি এবং বৈষম্যহীনতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয় আইনের এই ধারণা।
একটি বহুসাংস্কৃতিক সমাজে সকলের সমান আচরণ নিশ্চিত করার জন্য চুক্তিভিত্তিক নাগরিকত্বের একটি রূপের ধারণা;
একটি বহুসাংস্কৃতিক সমাজে সকলের সমান আচরণ নিশ্চিত করার জন্য চুক্তিবদ্ধ নাগরিকত্বের ধারণা অনুযায়ী নাগরিকত্বকে কেবল আইনী বা রাজনৈতিক অবস্থা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা উচিত নয় বরং সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নিয়ম এবং মূল্যবোধের দ্বারাও সংজ্ঞায়িত করা উচিত যা সমতা এবং বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাকে উৎসাহিত করে। বহুসাংস্কৃতিক সমাজে নাগরিকত্বকে অবশ্যই আনুষ্ঠানিক আইনি অধিকার এবং সুরক্ষা ধারণার বাইরে যেতে হবে যেন একটি অভিন্ন প্রতিশ্রুতি হিসেবে নির্দিষ্ট মূল্যবোধ এবং নীতিগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
মুসলমানদের মধ্যে চরমপন্থাকে সহায়তা করে এমন কারণগুলি নির্মূল করার লক্ষ্যে মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পুনর্গঠন,
চরমপন্থাকে সহায়তা করে এমন কারণগুলি নির্মূল করার লক্ষ্যে মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পুনর্গঠনে চরমপন্থার মূল কারণগুলি মোকাবেলা এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি প্রচারের জন্য একটি বিস্তৃত পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে পাঠ্যক্রম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক প্রচারণার পরিবর্তন সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ জড়িত থাকতে পারে।
মুসলিম দেশগুলিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ন্যায়সঙ্গত আচরণের আন্দোলনকে সমর্থন করা,
মুসলিম দেশগুলিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ন্যায়সঙ্গত আচরণের আন্দোলনকে সমর্থন করার মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা ও প্রচারের পক্ষে সমর্থন করা এবং তাদের সাথে ন্যায্য ও মর্যাদার সাথে আচরণ নিশ্চিত করার জন্য কাজ করার মত বিষয়গুলো জড়িত। এর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা, জনসাধারণের সমর্থন এবং স্থানীয় নাগরিকদের সামাজিক সংগঠনগুলোর সমর্থন সহ বিভিন্ন কৌশল জড়িত থাকতে পারে।
আরো পড়ুনঃ মানবাধিকার কাকে বলে? কিভাবে মানবাধিকার রক্ষা করা যায়?
মুসলিম ভূমিতে সকল ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীর জন্য আতিথেয়তার ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করা;
অন্যান্য সমস্ত ধর্মবিশ্বাসী গোষ্ঠীকে সাদরে গ্রহন ও আতিথেয়তার ঐতিহ্যবাহী মুসলিম দেশগুলিতে আতিথেয়তার পুনরুজ্জীবনের বলতে, ইসলামী আতিথেয়তার নীতিতে ফিরে আসা জড়িত, যেখানে তাদের বিশ্বাস বা জন্মভূমি নির্বিশেষে সকল অতিথিদের প্রতি উদারতা, দয়া এবং শ্রদ্ধার ওপর বিশ্বাস করা হয়। এর মধ্যে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ এবং সহযোগিতা এবং স্থানীয় উদ্যোগের আতিথেয়তা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকান্ডে সমর্থনসহ বিভিন্ন কৌশল জড়িত থাকতে পারে।
ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, অপমান ও অবমাননা দূর করা;
ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, অপমান এবং লোকদের ভ্রান্ত বিশ্বাসগুলো নির্মূল করা একটি জটিল এবং বহুমুখী বিষয় যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন কৌশল প্রয়োজন। ধর্মীয় বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রচারের জন্য যে কয়েকটি মূল কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে তার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রচার করা, ধর্মের ইতিবাচক ভাবধারা প্রচারের জন্য মিডিয়া এবং বিনোদন শিল্পকে উৎসাহিত করা, বিদ্বেষমূলক অপপ্রচারকে শক্তিশালী আইনের আওতায় আনা, ধর্মীয় নেতাদের ধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা প্রচার করতে উৎসাহিত করা।
উপরোক্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পাশাপাশি মারাকেশ সম্মেলনের আরো বেশকিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। আর্টিকেলের এই পর্যায়ে সেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিস্তারিত আলোচনা করব।
মুসলিম জাতির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা আলোচনা
এক সময় মুসলিমরা বৈজ্ঞান, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক চর্চায় সুপ্রসিদ্ধ ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য চর্চায় সারা বিশ্বে তারা নেতৃত্ব দিয়েছন। কিন্তু বিদেশি পরাশক্তির কাছে সব হারিয়ে এখন নিজেদের মধ্যে অন্তঃকোন্দলে লিপ্ত হয়েছে। এক মুসলিম রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের শত্রু। জাতিগত বিদ্বেষ এখন মাত্রা ছাড়িয়ে ক্ষমতার লড়াই, আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থার আলোচনা ও উত্তরণের সম্ভাবনা খুঁজে পেতেই মারাকেশে সবাই জড়ো হয়েছিলেন। মারাকেশ সম্মেলনের আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল মুসলিম জাতির এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা, যে অবস্থার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা জীবন অতিবাহিত করছে।
চলমান সহিংসতা
সম্মেলনের অন্যতম একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সমগ্র পৃথিবীতে চলমান সহিংসতা সম্পর্কে আলোচনা করা ও এর সমাধানের পথ খোঁজা। বিশেষ করে ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাকে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ নারী-পুরুষ, শিশুশ-বৃদ্ধ প্রতি মুহুর্তে মেশিন গান কিংবা বোমার আঘাতে প্রাণ হারাচ্ছে। দিন দিন এ সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষমতা লিপ্তুরা ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে সাধারণের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে ভীনদেশীদের মদদে। আঞ্চলিক ও জাতীয় স্বার্থকে দুমড়ে-পিষে ব্যক্তি স্বার্থ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে দিনকে দিন।
জাতিসংঘের হিসেবে, সৌদি আরব নেতৃতাধীন জোটের চালানো যুদ্ধে ইয়েমেনে ১৫০,০০০ এরও বেশি লোক মারা গেছে, পাশাপাশি চলমান দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধের কারণে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার অভাবের ফলে ২২৭,০ এরও বেশি লোক মারা গেছে। এইসব সহিংসতার সম্ভ্যাব্য সমাধান খুঁজে বের করাটা মারাকেশ সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
আরব ও অনারবের অসহনশীলতা
মারাকেশ সম্মেলনের অন্যতম আরেকটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বের অসহনশীল পরিস্থিতির কথা আলোচনা করা। বিশ্বের অন্যান্য জায়গার মত মধ্যপ্রাচ্যেও জাতি বিদ্বেশ আছে। আরবরা অনারদের জাতিগতভাবেই অপছন্দ করে। শিয়ারা সুন্নিদের সহ্য করতে পারে না। আবার সুন্নিরা শিয়াদের সহ্য করতে পারেনা। কুর্দিদের সিরিয়াররা সহ্য করে না। আবার কাতার, সিরিয়াকে সৌদি আরব সহ্য করে না। এই জাতি বিদ্বেষ, যে ঘৃণার আগুণ দাউ দাউ করে জ্বলছে, এর শেষ কোথায়? শুধু হত্যার মাঝেই তাদের বর্বরতা সীমাবদ্ধ নেই তারা ভিন্নধর্মী উপাসনালয়গুলোও অবমাননা করছে, বিবেককে বিসর্জন দিয়ে অগ্নি সংযোগ ঘটাচ্ছে, ধ্বংস করে দিচ্ছে। যেমনটা আবদুল্লাহ বিন বায়িয়ার তার বক্তব্যে বলেছেন,
“সম্মানিত পন্ডিতগণ, আমি দার্শনিক নিৎশের সাথে একমত, যিনি বলেছিলেন, যখন সভ্যতাগুলি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন তাদের নিরাময়কারীরা ঋষি এবং দার্শনিক। অন্যকথায়, যখন সভ্যতাগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন আধ্যাত্মিক পন্ডিত এবং বুদ্ধিজীবীরাই তাদের চিকিৎসক। অতএব আজ এখানে আমাদের একত্রিত হওয়ার কারণ হলো এই সংকটটি নিয়ে আলোচনা করা যাতে অসুস্থতা নির্ণয় করা যায় এবং ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দুর্যোগের জন্য চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরী করা যায়” ।
মানবাধিকারের ইতিহাস সম্পর্কে পড়ুন
সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ ও নির্যাতন রোধ
মারাকেশ সম্মেলনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাদের উপর চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘিত কাজ এবং নির্যাতন রোধে সম্মিলিতভাবে কাজ করা।
বর্তমান অসহহিঞ্চু পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশেই দায়ী এই আচরণ। সমাজের এই অবস্থার জন্য দায়ী সঠিক দিক নির্দেশনার অভাব। আর তার জন্য দায়ী দুর্বল আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এবং এর সাথে সাথে কিছু তথাকথিত বক-ধার্মিকদের জঘন্য কর্মকান্ডে জড়িত থাকার কারণে এটি যে শূন্যতা তৈরী করে তার কারণে এটি বিশেষভাবে সমালোচনামূলক।
এ পরিস্থিতির থেকে উত্তরণের জন্য ধর্মীয় পন্ডিতগণকের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে, তাদের ভুল ধারণাগুলি সংশোধন করতে হবে, সমস্যার সঠিক সমাধান দিতে হবে। বর্তমান বিশ্বে যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনকল্পে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। কৌতুহল মেটাতে হবে, জানাশোনার সুযোগ দিতে হবে, আলোচনা করতে হবে। সঠিক ধর্মীয় জ্ঞানের পরিচর্যা ও প্রভাবেই মানুষের আচরণের পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সংখ্যালঘুদের প্রতি মুসলিম রাষ্ট্রের আচরণ বিধি প্রণয়ন
মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে এবং এই দেশগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘু। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এ সংখ্যালঘুরা রাষ্ট্রের সরকারের রোষানলে পড়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শীয়া প্রধান দেশে সুন্নি ও অন্যান্যরা বিদ্বেষ, নির্যাতনের শিকার। আবার যেখানে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে শীয়া, কুর্দিসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা নির্যাতন নিপিড়নের শিকার হয়। এবং অনেক সময় এসব অপকর্ম প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সরকারের মদদে সংঘটিত হয়।
মারাকেশ সম্মেলনে সংখ্যালঘুদের মানবিক ও নাগরিক অধিকার নিয়ে কথা বলা হয়, কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে তা তুলে ধরা হয়। কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে একটি মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী সংখ্যালঘুদের প্রতি মুসলিম জনগণ বা মুসলিম রাষ্ট্রের আচরণ কেমন হবে তা আলোচনাই হলো এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে সম্মিলিত প্রয়াসে, জ্ঞান চর্চায়, আচরণ সংশোধনের মাধ্যমেই কেবল এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।
শেষকথা
এ সম্মেলনের লক্ষ্য হলো আল্লাহ তা’য়ালা কর্তৃক নির্ধারিত পবিত্র আইনের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ সম্মেলনের পূর্বে ২০১২ সালে নুয়াকচুটের একটি সম্মেলন হয়েছিল যেখানে আরো একটি ফলপ্রসূ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয় যার ফলাফল হলো মারাকেশ সম্মেলন। এ সম্মেলনের পদক্ষেপে সাড়া দিয়ে নুয়াকচুটের একদল পন্ডিত এবং অভিজ্ঞ প্রবীণ যোগ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন ধর্মের এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলন এই সম্মেলনে। এ সম্মেলনে মুসলিম সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো বের করে তা সমাধানের পথ অনুসন্ধান করা হয় এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ে সকলের সম্মিলিতি প্রয়াসের নবসূচনা করে।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।