২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (ইসি) দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন। সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনের পর এ নিয়ে বৈঠকে বসে নির্বাচন কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে, যেহেতু সরকার দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে, সেহেতু আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এসআরও নম্বর ১৩৭-আইন/২০২৫, তারিখ ১২ মে ২০২৫ মূলে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা-১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক যেকোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, সেহেতু, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন (নম্বর-০০৬ তারিখ: ০৩/১১/২০০৮) এতদ্বারা স্থগিত করল।’
নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপটি রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন ও তাদের নির্বাচনী যোগ্যতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটি নজির স্থাপন করেছে। নির্বাচন কমিশনের সচিব জানান, দলটির বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, অনিয়ম ও স্বচ্ছতার অভাবের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ওই দল আগামী জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি দেশের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নতুন মাত্রা দেবে এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নতুন সমীকরণ তৈরি করবে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কেন আওয়ামি লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল?
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সাবেক শাসক দলের নিবন্ধন স্থগিত করার পেছনে মূল কারণ হলো নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, স্বচ্ছতার অভাব এবং অনিয়মের অভিযোগ। কমিশন বলেছে, দলটির বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে যে তারা নির্বাচনী নিয়মকানুন সঠিকভাবে মানেনি এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা রক্ষা করতে এই কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, নির্বাচন ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কমিটির রিপোর্টে উঠে এসেছে। ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের পর থেকে নির্বাচন ব্যবস্থায় নানা ধরনের ত্রুটি ও দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ভোটের আগে ও পরে অনিয়ম, ভোট কারচুপি, ‘ডামি প্রার্থী’ ইস্যু এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার কারণে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন কঠিন হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা নির্বাচনি আইন, কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া ও ভোটিং পদ্ধতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব দেবে। এই প্রেক্ষাপটে, কমিশন সাবেক শাসক দলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে যাতে ভবিষ্যতে নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়।
জর্জ অরওয়েলের অ্যানিম্যাল ফার্ম ও স্বৈরাচার হাসিনার শাসন
অন্যদিকে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের প্রেক্ষিতে কমিশন বারবার সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। তবে বিরোধীরা এই আহ্বানকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে অবিশ্বাস প্রকাশ করছে।
আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত কি বৈধ?
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সাবেক শাসক দলের নিবন্ধন স্থগিতের সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বৈধ এবং দেশের সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী গৃহীত।
প্রথমত, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮(১) ও ১১৮(৪) এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, যেখানে কমিশনকে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন এবং কেবল সংবিধান ও আইন অনুসারে কাজ করে।
দ্বিতীয়ত, Representation of the People Order (RPO), 1972-এর ধারা ৯০(এইচ) অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করার জন্য নির্দিষ্ট শর্তাবলী রয়েছে। যেমন, দল যদি নিজস্ব সংবিধান অনুযায়ী বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়, সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়, তিন বছর ধারাবাহিকভাবে কমিশনকে তথ্য প্রদান না করে, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বা দুইবার ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে কমিশন তার নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করতে পারে। এই বিধান নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার আইনি ভিত্তি প্রদান করে।
নির্বাচন কমিশন যখন কোনো দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, স্বচ্ছতার অভাব বা অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত পায়, তখন আইনের প্রক্রিয়া অনুসারে সংশ্লিষ্ট দলকে যথাযথ শুনানি ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয় এবং তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই আদেশের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দল আদালতে আপিল বা পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করতে পারে, যা দেওয়ানি আইনের আওতায় বিচারাধীন থাকে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের পূর্ববর্তী রায় থেকেও স্পষ্ট যে, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করার ব্যাপারে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যদি দলটির সাংবিধানিক উদ্দেশ্য বা কার্যক্রম দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। উদাহরণস্বরূপ, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও সংশ্লিষ্ট উচ্চ আদালতের রায় এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক।
সুতরাং, নির্বাচন কমিশনের সাবেক শাসক দলের নিবন্ধন স্থগিতের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সংবিধান, নির্বাচন আইন এবং সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ বৈধ এবং আইনি ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দল আদালতে আপিল করতে পারে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিষয়টি পুনঃমূল্যায়ন হতে পারে।
বিরোধীরা এই সিদ্ধান্তকে কেন সন্দেহের চোখে দেখছে?
বিরোধীরা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে সন্দেহের চোখে দেখার প্রধান কারণ হলো তারা মনে করে এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সরকারের ইঙ্গিত নিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর মতে, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে এবং তারা বিশ্বাস করে যে সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে এই ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে যাতে বিরোধীদের ক্ষমতা সীমিত করা যায়।
বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল মনে করে, নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপের আড়ালে সরকারের চাপ কাজ করছে। তারা দাবি করে, নির্বাচন কমিশন কোনো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না, বরং সরকারের নির্দেশনায় কাজ করছে। এজন্য তারা নির্বাচন সংক্রান্ত যে কোনো সংলাপ বা পদক্ষেপকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করছে না।
এছাড়া, বিরোধীরা মনে করে অতীতে ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। তাই তারা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ হিসেবে দেখে এবং এই ধরনের পদক্ষেপকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা কমানোর কারণ হিসেবে মনে করে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপ গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে একই সঙ্গে তারা সতর্ক করেছেন, এই ধরনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে এবং রাজনৈতিক সংলাপের অভাব ঘটাতে পারে। তাই দেশের সকল রাজনৈতিক পক্ষের উচিত শান্তিপূর্ণ ও সংলগ্ন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষায় নিয়মিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে কমিশন আরও শক্তিশালী ও স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করছে। এই পদক্ষেপও সেই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দেশের সাধারণ জনগণ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এই সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য ইতিবাচক বলে মূল্যায়ন করছেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও সংলাপের অভাব এড়াতে সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
সার্বিকভাবে, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সাবেক শাসক দলের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে নতুন দিকনির্দেশনা দেবে। আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব কেমন হবে, তা সময়ই বলবে। তবে নিশ্চিত যে, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।













