“যদি রাত পোহালেই শোনা যেত,
বঙ্গবন্ধু মরে নাই,
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা,
আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।”

ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ ১৫ই আগস্ট। বাঙালী জাতির ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়।ইতিহাসের বেদনা বিধুর ও বিভীষিকাময় একটি দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি,হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাংলাদেশের ইতিহাসের মহানায়ক, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সেনাবাহিনীর কিছু উশৃঙ্খল ও বিপথগামী সদস্য।

বঙ্গবন্ধুকে আনোয়ার সাদাতের উপহার

১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর স্বাধীনতার গৌরব অর্জন করে আমাদের এই সোনার বাংলা। প্রত্যেকটি দেশের সাথে সুসম্পর্ক নীতি নিয়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে খুব সাবধানে পা ফেলেই অগ্রসর হচ্ছিল। বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আর সহমর্মিতা জানিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। তেমনি্ভাবে আরবকে সমর্থন জানিয়েছিল ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েলের যুদ্ধে। সে সময় শেখ মুজিবের আন্তরিক সমর্থনে মুগ্ধ হয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত যুদ্ধ শেষে উপহার পাঠান বাংলাদেশে। উপহার ছিল ৩০ টি T-44 ট্যাঙ্ক এবং ৪০০ রাউন্ড ট্যাঙ্কের গোলা।ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সের বাংলাদেশের একমাত্র সজোয়ার রেজিমেন্ট গ্রহণ করে সেই ট্যাঙ্কগুলো। উদ্দেশ্য ছিল সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশের অস্ত্রভান্ডার গড়ে তোলা। কিন্তু কে জানত বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেয়া সেই ট্যাঙ্ক দিয়েই ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছিল তাকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময়ে!

ভয়াল ১৫ই আগস্ট

মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের উপহার দেয়া সেই ট্যাঙ্ক নিয়ে ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫-এ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রাজকীয় ভঙ্গিতে বেড়িয়ে পড়তে লাগলো নরপিশাচরা। ১৫ই আগস্ট ভোরে ষড়যন্ত্রকারীরা চারটি দলে বিভক্ত হয়। মেজর হুদার অধীনে বেঙ্গল ল্যান্সারের ফার্স্ট আর্মড ডিভিশন ও ৫৩৫ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা মুজিবের বাসভবন আক্রমণ করেন। “মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা” বইয়ের লেখক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তার বইয়ে লেখেন যে, মুজিবের বাসভবনের রক্ষায় নিয়োজিত আর্মি প্লাটুন প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে না। মুজিবের পুত্র, শেখ কামালকে নিচতলার অভ্যর্থনা এলাকায় গুলি করা হয়। মুজিবকে পদত্যাগ করা ও তাকে এ বিষয়ে বিবেচনা করার জন্য বলা হয়। মুজিব সামরিক বাহিনীর প্রধান, কর্নেল জামিলকে টেলিফোন করে সাহায্য চান। জামিল ঘটনাস্থলে পৌঁছে সৈন্যদের সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলে তাকে সেখানে গুলি করে মারা হয়। মুজিবকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মুজিবের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব , মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসের, দুইজন চাকর ; শেখ জামাল, ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেল এবং মুজিবের দুই পুত্রবধুকে হত্যা করা হয়। সেসময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন বলে বেচে যান।

উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ডঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভীনদেশী বীর

দুটি সৈনিক দল মুজিবের ভাগ্নে ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শেখ ফজলুল হককে তার অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রীর সাথে ১৩/১, ধানমন্ডিতে এবং মুজিবের ভগ্নিপতি ও সরকারের একজন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে তার পরিবারের ১৩ জন সদস্যসহ মিন্টু রোডে হত্যা করে । চতুর্থ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী দলটিকে সাভারে সংস্থিত নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত প্রত্যাশিত বিরোধী আক্রমণ ঠেকানোর জন্য পাঠানো হয়। সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের পর এগারজনের মৃত্যু হলে সরকারের অনুগতরা আত্মসমর্পণ করে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইন প্রণয়ন করেছিলেন। কতটা পরিতাপের বিষয় হতে পারে সেই পরিস্থিতি!

১৫ আগস্টের সেই নৃশংস হামলায় প্রাণ হারায় বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব,পুত্র শেখ কামাল,শেখ জামাল,শেখ রাসেল,পুত্রবধু সুলতানা কামাল,রোজি জামাল,ভাই শেখ নাসির ও কর্ণেল জামিল,ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনির ও তার অন্তঃসত্বা স্ত্রী আরজু মনির,ভগ্নিপতি আব্দুর রব সহ আরো অনেকে নিহত হন। দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বড় মেয়ে ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। সেসময় স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সাথে জার্মানীতে স্বামী সন্তানসহ অবস্থান করছিলেন শেখ হাসিনা।

এ হত্যাকান্ডের পর দেখা গেছে ভবনের প্রতিটি তলার দেয়াল,জ্বানালার কাঁচ,মেঝে ও ছাদে রক্তের ছড়াছড়ি। প্রথম তলার সিড়ির মধ্যেই নিধর পড়ে আছেন চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ।তাঁর তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা।

বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর গোটা বিশ্বে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া।হত্যাকারীদের প্রতি ছড়িয়ে পড়েছিল ঘৃণার বিষবাষ্প। পশ্চিম জার্মানীর নেতা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। বিচার শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কের কালি লেপ্টে দেয়া হয়েছিল, ৩৫ বছরেরও বেশি সময় পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সেই কলঙ্ক থেকে বাঙালি জাতির মুক্তি ঘটে।বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ঐদিন মধ্য রাতের পর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

ম্যালকম এক্সঃ আসামী থেকে ইসলামী নেতা

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়েছিল কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এসে ২০০২ সালে জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত বাতিল করে। পরবর্তীতে ৬ বছর পর হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামিলীগ সরকার ১৫ই আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পুনর্বহাল করে।

জাতীয় শোক দিবসটি পালন করতে আজ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সরকারি,আধাসরকারি,সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,বেসরকারি ভবনসহ বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।

বঙ্গবন্ধু হলেন স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক,বাংলার মাটি ও মানুষের পরম আত্মীয়।ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতৃত্বের কালজয়ী স্রষ্টা,বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক।স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা,স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

হে মুজিব, 
মৃত্যু তোমাকে নিঃশ্বেষ করতে পারেনি। 
চিরঞ্জীব তুমি। 
তুমি আছো, 
তুমি রবে, 
বাঙালীর অস্তিত্বে, 
বাংলার প্রতিটি ধূলিকনায়।

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Shanjida Shima is a graduate student at the University of Rajshahi's Department of Islamic History and Culture. She writes from her college days, with a focus on history and literature. She contributes to MaroonPaper on a regular basis. Her articles can be found on MaroonPaper.

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

  • আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

  • ইক্যুইটির ম্যাক্সিম

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা

  • আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা

আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

  • পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয়

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।