১৯৬৬ সালে উত্থাপিত ৬ দফা দাবি বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি শুধু একটি দাবি ছিল না, এটি ছিল বাঙালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সুস্পষ্ট রূপরেখা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের এই কর্মসূচি হয়ে ওঠে মুক্তি আন্দোলনের মূল ভিত্তি। ছয় দফার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবিগুলো একটি সুসংগঠিত কাঠামোতে উপস্থাপিত হয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান করে।

৬ দফা কি?

৬ দফা দাবি বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ইতিহাসে অমর। এর মধ্যেই নিহিত ছিল বাংলার স্বাধীনতার বীজ। তবে, ৬ দফা আকস্মিক কোনো দাবির ফল নয়। এটি ছিল দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সামরিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রামের একটি স্বতঃস্ফূর্ত এবং ঐতিহাসিক প্রকাশ।

ছয় দফার পটভূমি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতার আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বৈষম্যের শিকার হতে থাকে—অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসন, এবং সামরিক ক্ষেত্রে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ছয় দফা দাবি একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবি জানায়।

৬ দফার ভিত্তি গড়ে ওঠে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজন, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন, এবং ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের শাসনের পটভূমিতে। এই ঘটনাগুলোর প্রতিটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে শোষণের চিত্র আরও স্পষ্ট করেছে।

উপমহাদেশ বিভাজনের পর থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান শাসন-ব্যবস্থায় ছিল পুরোপুরি উপেক্ষিত। পশ্চিম পাকিস্তান বরাবরই পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিয়ে নিজ অঞ্চলের উন্নয়নে ব্যয় করেছে। পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ১৯৭০ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে পাকিস্তানের বাজেটের ৬৮.৩১ শতাংশ ব্যয় হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৩১.৬৯ শতাংশ।

১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর এই বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা কার্যত উপেক্ষিত ছিল। ১৯৬৫-৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের সামগ্রিক বাজেটের মাত্র ২৮.৮৪ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হয়। এতে বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়।

শেখ মুজিবুর রহমান এই বৈষম্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে যুদ্ধকালীন সময়ে এতিমের মতো ফেলে রাখা হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা যদি এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে যেত, তবুও তাদের প্রতিরোধ করার মতো অস্ত্র বা সেনাশক্তি পূর্ব বাংলায় ছিল না। যদি চীন আমাদের রক্ষাকর্তা হয়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে চীনের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধলেই ভালো হতো।”

এই ধরনের বৈষম্য এবং শোষণের প্রেক্ষাপটেই ৬ দফার উত্থান ঘটে। এটি শুধু রাজনৈতিক দাবি নয়; এটি ছিল বাঙালির আত্মনির্ভরশীলতা এবং শোষণমুক্ত জীবনের প্রতি এক দৃঢ় অঙ্গীকার।

এক নজরে ৬ দফা দাবিসমূহ

১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের এক সম্মেলনে তাজউদ্দীন আহমেদকে সাথে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করেন। ওই সম্মেলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। এই দাবিগুলো ছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার রক্ষার একটি সুসংগঠিত কর্মসূচি। পরবর্তীতে, ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের বাঁচার দাবিঃ ছয় দফা দাবি’ শীর্ষক পুস্তিকায় এই দাবিগুলো সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হয়। ছয় দফার মূল বিষয়বস্তু রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক কাঠামোকে কেন্দ্র করে গঠিত। নিচে এই ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবির বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো:

১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি

পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির অধীনে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা

কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক ক্ষমতা থাকবে। অন্য সকল বিষয় প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

৩. মুদ্রা ও আর্থিক নীতি

  • সারাদেশে অবাধে বিনিময়যোগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে, অথবা একটি অভিন্ন মুদ্রা চালু হবে, যা নির্দিষ্ট শর্তে কার্যকর থাকবে।
  • একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এবং দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।

৪. রাজস্ব ও শুল্ক আদায়

প্রাদেশিক সরকার সকল প্রকার কর ও শুল্ক ধার্য এবং আদায় করার ক্ষমতা পাবে। তবে, প্রাদেশিক সরকারের সংগ্রহ করা রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়ার নিয়ম থাকবে।

৫. বৈদেশিক বাণিজ্য ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনা

প্রাদেশিক সরকার নিজের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে এবং একটি নির্ধারিত অংশ কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদান করবে।

৬. আঞ্চলিক নিরাপত্তা বাহিনী গঠন

প্রাদেশিক সরকারের অধীনে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা থাকবে।

ছয় দফার গুরুত্ব

ছয় দফা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আত্মপরিচয়ের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি শুধু রাজনৈতিক দাবি নয়; এটি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি এক বলিষ্ঠ অঙ্গীকার। ছয় দফা দাবি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের শোষণমুক্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে সামনে নিয়ে আসে এবং তাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ তৈরি করে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনঃ যুক্তফ্রন্টের গঠন, বিজয় ও মুসলিম লীগের পরাজয়

১৯৬৬ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ছয় দফা গৃহীত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন স্থানে জনসমর্থন গড়ে তোলার জন্য বক্তব্য দেন। দ্রুতই এই দাবিগুলো জনগণের মধ্যে গভীর সাড়া ফেলে। আতঙ্কিত আইয়ুব সরকার ছয় দফাকে রাষ্ট্রদ্রোহী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি হিসেবে আখ্যায়িত করে। এই দমননীতি জনগণের চেতনায় ছয় দফাকে আরও গভীরভাবে প্রোথিত করে।

৬ দফা দাবী কীভাবে বাঙালির স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করেছিল?

নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার পর ৯ই মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত হরতালে পাকিস্তান সরকার গুলি চালালে টঙ্গী, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে ১১ জন বাঙালি নিহত হন। এই ঘটনায় সারা দেশে উত্তাল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

ছয় দফার পক্ষে সৃষ্ট জাতীয় জাগরণের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে। এই আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। এর পাশাপাশি, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে ১১ দফা দাবি ঘোষণা করে, যা কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করে।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছয় দফা ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান ইশতেহার। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করে যে, ছয় দফা দাবিই ছিল বাঙালির মুক্তির প্রধান রূপরেখা।

১৯৭০ সালের নির্বাচনঃ যে নির্বাচনে পাকিস্তানের অবিচারের জবাব দিয়েছে বাংলা

ছয় দফার মাধ্যমে বাঙালি বুঝতে পারে যে পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থায় থেকে তাদের মুক্তি ও ন্যায্য অধিকার কখনো সম্ভব নয়। ছয় দফার প্রত্যাখ্যানই বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। এ কারণেই ছয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বা “ম্যাগনা কার্টা” হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই সম্ভব হয়েছিল। ছয় দফা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ, যা জাতিকে শোষণমুক্ত ভবিষ্যতের পথে পরিচালিত করে।

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক রাজনীতি রাকিবুল ইসলামের বিশেষ আগ্রহের বিষয়। তাঁর লেখালেখির মূল বিষয়বস্তু হলো রাজনীতি, সরকার, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

  • আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

  • ইক্যুইটির ম্যাক্সিম

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা

  • আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা

আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

  • পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয়

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।