বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে পশ্চিমারা শুরুই করেন ৬ই অক্টোবর দিনটা শান্তিময় ছিল। অর্থ্যাৎ, ৭ই অক্টোবরে হামাসের হামলাই ফিলিস্তিন ইসরায়েল সংঘাতের জন্য দায়ী। যেন কোন কারণ ছাড়া, ইতিহাস ছাড়া, প্ররোচনা, উত্তেজনা ছাড়াই হামাস ৭ অক্টোবর হামলা চালিয়েছে। তবে, এই ন্যারেটিভ সম্পূর্ণ ভুল এবং বিভ্রান্তিকর। শুধু ভুল এবং বিভ্রান্তিকরই নয়, যুদ্ধের দায় হামাসের ওপর চাপিয়ে দেয়ার এই ন্যারেটিভ পশ্চিমারা খুব সচেতন ভাবেই তৈরীর চেষ্টায় নিয়োজিত।
৭ অক্টোবরের আগে কি সত্যিই শান্তি ছিল?
প্রত্যেক বছর ইসরায়েল ফিলিস্তিনে কি পরিমান অপরাধ সংঘটন করে, কতজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে সে ব্যাপারে কোন ধারণা না থাকলেই কেবল বলা সম্ভব ৭ অক্টোবরের আগে ফিলিস্তিনে শান্তি ছিল। তবে পশ্চিমারা এই বয়ান উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই প্রচার করে ফিলিস্তিনের অধিকার, ইতিহাসকে অস্বীকার, উপেক্ষা করার জন্য।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন যুদ্ধের ইতিহাস
ফিলিস্তিনিদের জীবনে প্রত্যেকটি বছর অভিশপ্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৪৮ থেকে কোন বছরটি শান্তিময় ছিল? আসলে শান্তিময় না, প্রশ্ন করা উচিৎ কোন বছরটি সবচেয়ে বেশি হিংসাত্মক বছর ছিল! প্রতিবছর হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে শত শত নারী-শিশু নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কিংবা দখলদার ইসরায়েলিদের হাতে বিনা বিচারে আটক রয়েছেন। ইসরায়েল ফিলিস্তিনে কি পরিমান ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তা পরিষ্কার হবে নিচের তথ্যসারণীতে। নিচের সারণীতে বিভিন্ন উৎসের তথ্যের ভিত্তিতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে মৃত, আহত, গ্রেপ্তার এবং অপহরণের বার্ষিক তথ্যের একটি চিত্র তুলে ধরা হলোঃ
Year | Death | Injuries | Detained Palestinian | ||
Israeli | Palestinian | Israeli | Palestinian | ||
2008 | 6 | 1,440 | 1,000 | 5,000 | 3,000 |
2009 | 10 | 1,100 | 500 | 4,000 | 2,500 |
2010 | 20 | 600 | 300 | 2,000 | 2,000 |
2011 | 15 | 700 | 200 | 3,000 | 2,200 |
2012 | 40 | 2,300 | 400 | 6,000 | 2,800 |
2013 | 4 | 700 | 150 | 1,500 | 1,500 |
2014 | 67 | 2,100 | 2,000 | 10,000 | 3,000 |
2015 | 20 | 300 | 800 | 1,200 | 1,700 |
2016 | 15 | 100 | 600 | 900 | 1,200 |
2017 | 17 | 200 | 500 | 1,000 | 1,500 |
2018 | 12 | 300 | 1,200 | 2,000 | 1,800 |
2019 | 10 | 150 | 400 | 800 | 1,000 |
2020 | 5 | 100 | 300 | 500 | 900 |
2021 | 13 | 250 | 1,000 | 2,500 | 1,500 |
2022 | 18 | 300 | 900 | 2,000 | 1,700 |
2023(before 7th Oct.) | 32 | 247 | 213 | 9379 | 1,264 |
2023-24 (after 7th Oct.) | 1,139 | 37,077 | 8,730 | 87,959 | 3,000 |
৪ জুন পর্যন্ত গাজায় সর্বশেষ হতাহতের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজায় ১৫ হাজারেরও বেশি শিশুসহ কমপক্ষে ৩৬,৫৫০ জন নিহত হয়েছে, ৮২,৯৫৯ জনেরও বেশি লোক আহত হয়েছে এবং ১০,০০০ এরও বেশি নিখোঁজ রয়েছে। দখলকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১৩২ শিশুসহ অন্তত ৫২৭ জন নিহত এবং পাঁচ হাজারের বেশি আহত হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলে ৭ অক্টোবরের হামলায় নিহতের সংখ্যা সংশোধন করে ১,১৩৯ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে, এছাড়া কমপক্ষে ৮,৭৩০ জন আহত এবং ২৪০ জন নিখোঁজ রয়েছে।
রাফায় অভিযান বন্ধে ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের নির্দেশ
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত শতাধিক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই ফিলিস্তিনি। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস এবং ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টসের মতে, ৯৬ জন ফিলিস্তিনি, তিনজন লেবানিজ এবং চারজন ইসরায়েলি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। গাজায় প্রতি ঘন্টায়, ১৫ জন নিহত (ছয়জন শিশু), ৩৫ জন আহত হয়, ৪২টি বোমা ফেলা হয় এবং ১২টি ভবন ধ্বংস হয়।
পশ্চিমাদের স্বরূপ উন্মোচিত
প্রতি বছর ইসরায়েলি সেনাদের হাতে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, কিন্তু রাজনৈতিক ও মিডিয়া শ্রেণীতে তার খুব কম প্রভাব পড়েছে। ইসরায়েলিদের অপরাধযজ্ঞ, হাজার হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যুকে অস্বীকার করা হয়েছে, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। কয়েকদিন আগেই নিকি হেইলিকে ইসরায়েলে ভ্রমণকালে দেখা যায় যে তিনি একটি মিসাইলে অটোগ্রাফ দিয়ে লিখছেন “ওদেরকে শেষ কর!”
ইসরায়েলের সেটেলমেন্ট ও ন্যাশনাল মিশন বিষয়ক মন্ত্রী ওরিট স্ট্রোক ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলেন, “ফিলিস্তিনি জনগণ বলে কোনও কিছু নেই।ইসরাইলের ভূমিতে কখনোই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে না। বিশ্বের প্রতিটি সভ্য মানুষ জানে যে এই ভূমি আমাদের, ইসরায়েলি জনগণের এবং শুধুই আমাদের জন্য”। ২০১৩ সালে উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন দাহান এক রেডিও সাক্ষাৎকারে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে বলেন, “আমার কাছে তারা পশুর মতো, তারা মানুষ নয়”।
গাজায় ফিলিস্তিনি শিশুদের মৃত্যুর বিষয়ে একজন কর্মীর প্রশ্নের জবাবে টেনেসির রিপাবলিকান প্রতিনিধি অ্যান্ডি ওগলস জোর দিয়ে বলেছিলেন যে “তাদের সবাইকে আমাদের হত্যা করা উচিত”।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, শক্তির নিরিখে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর খবর কোন প্রভাব ফেলেনি। বরং সব কিছু জেনে শুনে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের পক্ষপাতিত্বে তাদের মানবতার মুখোশের আড়ালে তাদের ফ্যাসিবাদি চরিত্র উন্মোচিত হয়ে গেছে এতদিনে। পশ্চিমাদের, যারা মানবতা, মানবিক অধিকার প্রভৃতি নিয়ে শোরগোল করে, অন্যান্যদের ছবক দেয়, তাদের দ্বিমুখীতা, রক্তলিপ্তা, জিঘাংসা আর আড়ালে আবডালে নেই, তাদের বিচ্ছিরি কদাকার চেহারা উন্মোচিত হয়েছে দুনিয়ার সামনে।
অনন্যোপায় হামাস
হামাস বুঝতে পেরেছে কীভাবে এই নীরবতা ভাঙা যায়, কীভাবে পরিস্থিতিকে আলোড়িত করা যায়। তারা জানতো যে ইসরায়েলিদের ব্যাপক সংখ্যায় মৃত্যুই এই আলোড়ন সৃষ্টি করবে, যা আর উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না। কারণ ইসরায়েলিদের মৃত্যু গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করা হলেও আরবদের মৃত্যু গুরুত্ব পায় না। এইভাবে তারা ইসরায়েলি ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে যে এই সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তারা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যেখানে ফিলিস্তিনিদের অবস্থা আর উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না।
শান্তি প্রক্রিয়া ইতিহাসের পুণর্লিখন
হামাসের এই পদক্ষেপ কাজে এসেছে। অনেকেই বলছে এই আলোচনার মাধ্যমে হামাসকে পুরস্কৃত হচ্ছে। তারা কিভাবে পুরস্কৃত হচ্ছে? তাদের সমস্যাগুলো আলোচিত হচ্ছে। এটা কি পুরস্কার? নাকি ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তাদের ন্যায্য পাওনা? এই সমস্যাগুলোতো হামাসের নয়, বরং সমগ্র ফিলিস্তিনি জনগণের। হামাস সেই দল যারা ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে যেকোন পন্থা অবলম্বন করতে প্রস্তুত, তাদের অবস্থান জানান দিতে লড়াই করতে প্রস্তুত।
ফিলিস্তিনিদের লড়াইয়ে হামাসকে চাননা?
অনেকেই গাজায় দখলদার ইসরায়েলি সহিংসতার প্রতিক্রিয়া দেখে শিউরে উঠেন। তবে আপনি কাউকে বলতে শুনবেন না যে তিনি ফিলিস্তিনিদের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত। এদের কেউই তাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অবস্থান ঝুঁকির মুখে রেখে ফিলিস্তিনি জীবনের জন্য লড়াই করতে ইচ্ছুক নয়। আপনি যদি ফিলিস্তিনিদের জন্য লড়াই না করেন, তাহলে অবশ্যই হামাস সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে। এই হিসেব একেবারে সহজ। যখনই সেই সুযোগ আসবে তারা সেই সুযোগ গ্রহণ করবে। কেন নেবে না? আপনি যদি না চান যে হামাস আলোচনায় আসুক, ফিলিস্তিনের হয়ে লড়াই করুক, তাহলে আপনাকেই সেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাঁড়াতে হবে, আলোচনা করতে হবে, লড়াই করতে হবে। হামাসকে না চাইলে আপনিই ফিলিস্তিনিদের জন্য লড়াই করুন!
2 Comments
Leave A Comment
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রেরঃ নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা
গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ
গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।
পিকেকে-র বিলুপ্তি: তুরস্কের জন্য সুযোগ নাকি কুর্দিদের জন্য নতুন সংকট?
পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা: তুরস্কের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ, নাকি কুর্দিদের জন্য অধিকার হারানোর নতুন ঝুঁকি?
অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুসঃ ভারতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা
পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে "অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস" নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটির অর্থ "গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর"।
আদালতের এখতিয়ারঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও বাংলাদেশে প্রয়োগ
বিচারিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আদালতের এখতিয়ার। আদালতের এখতিয়ার তিন প্রকারঃ আদি এখতিয়ার, আপীল এখতিয়ার, এবং পরিদর্শন এখতিয়ার।
[…] সংঘর্ষের পর, অবশেষে ইসরায়েল ও হামাস গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত […]
[…] সালের ৭ অক্টোবর, হামাস ইসরাইলে ব্যাপক মাত্রায় রকেট হামলা ও […]