ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে দেখা যায়, মানবসভ্যতার যাত্রাপথ সব সময়ই সহজ সমান নয়। অত্যাচার, নির্যাতন, অসাম্যের অন্ধকার ছায়া বারবারই পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে প্রকট হয়েছে। তবে, সময়ের পরীক্ষায় এটি বার বার প্রমাণিত হয়েছে স্বৈরশাসকের অত্যাচার, নির্যাতন, অসাম্যের ক্ষমতা দিয়ে কখনোই স্থায়ী শাসন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে সত্য, ন্যায়, সাম্যের আলোকবর্তিকাও জ্বলে উঠেছে সব সময়। ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ই এমন নেতাদের উদাহরণে ভরপুর, যারা নিজেদেরকে অপরাজেয় মনে করেছিল, কিন্তু অবশেষে জনগণের ঐক্যের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছে। মানবতার অদম্য চেতনা, সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের অক্লান্ত পদযাত্রা সর্বদা অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং বিজয়ী হয়েছে।
স্বৈরশাসকের উত্থান
ইতিহাসের প্রতিটি যুগে স্বৈরশাসকের উত্থান ঘটেছে। মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা, অধিকার খর্ব করে নিজের শাসন পোক্ত করাই এসব শাসকের মূল লক্ষ্য। মানবাধিকার লঙ্ঘন, স্বৈরাচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ – এসবই স্বৈরশাসকের কর্মকাণ্ডের বহিঃপ্রকাশ। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখতে পাই, কত স্বৈরশাসক ক্ষণিকের জন্য ক্ষমতার সিংহাসনে বসেছিলেন। ফারাওদের অত্যাচার, হিটলারের নৃশংসতা, স্টালিনের নির্যাতন, এসব ঘটনা ইতিহাসের কালো অধ্যায়। ক্ষমতার লোভ, অহংকার এবং মানবতার প্রতি অবজ্ঞা তাদের কর্মকাণ্ডের প্রেরণা হয়েছে।
ক্ষমতার নেশায় মত্ত হয়ে তারা নিজেদেরকে দেবতা মনে করেছে, অজেয় মনে করেছে, জনগণের উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। তাদের বিশ্বাস, তাদের ক্ষমতা অসীম, এবং কোনো শক্তিই তাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না। কিন্তু, এই অত্যাচারই তাদের পতনের বীজ বপন করেছে। এবং সময়ের পরিক্রমায় তাদের পতন হয়েছে।
একনায়কতন্ত্র: উত্থান, বৈশিষ্ট্য, প্রভাব ও মুক্তির উপায়
জনগণের প্রতিরোধ ও স্বৈরশাসকের পতন
মানুষ সহজে দমে না। অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সূত্র ধরে তারা একত্রিত হয়। সামাজিক ন্যায়, মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার আদর্শকে বুকে ধারণ করে তারা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই সংগ্রামে অনেকের প্রাণ যায়, কিন্তু সত্যের জয় অবধারিত।
ইতিহাস বলছে, অত্যাচার সহ্য করার একটা সীমা আছে। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যখন সাধারণ মানুষের সহনশীলতার বাঁধ ভেঙে গেছে, তখন সেই সাধারণ মানুষই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, বিদ্রোহ করেছে। তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে শুরু করে সশস্ত্র বিদ্রোহ পর্যন্ত, বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে এই প্রতিরোধ। এই রক্তাক্ত বিদ্রোহে অনেক ক্ষেত্রে, বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণ যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষে বিজয়ী হয়। জনগণের একতার শক্তিতে অনেক অত্যাচারী শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে কিভাবে স্বৈরশাসকের পতন ঘটানো যাবে?
বাংলাদেশের বর্তমান স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে দিকে ধাবমান, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। জনগণের অধিকার হরণ, সুশাসনের অভাব, দুর্নীতির প্রকোপ, মানবাধিকার লঙ্ঘন – এসবই স্বৈরশাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হল স্বৈরশাসকের পতন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কিভাবে?
আরো পড়ুনঃ
স্যাটেলাইট স্টেট ও ন্যানী স্টেট কাকে বলে?
স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সফল আন্দোলনের মূলনীতি হল জনগণের একত্রীকরণ। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে হবে। রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, ধর্মীয় নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজ – সকলকে একত্রিত হতে হবে। যুব সমাজ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, সবাইকে সমান অংশীদার করে গড়ে তুলতে হবে একটি শক্তিশালী জোট। বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা প্রতিহত করতে হবে। এই জোটকে সুসংগঠিত ও দৃঢ়চেতা হতে হবে।
অর্থনৈতিক অবরোধ, বয়কট, এবং স্ট্রাইকের মাধ্যমে স্বৈরশাসকের আয় বন্ধ করতে হবে। জনগণকে স্বৈরশাসকের সমর্থিত ব্যবসা থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানাতে হবে। পাশাপাশি, সামরিক বাহিনী যদি স্বৈরশাসকের পক্ষে দাঁড়ায় তবে তাদেরও বিরোধিতা করতে হবে। একটি সাধারণ লক্ষ্যের জন্য সকলকে একত্রিত করতে পারলেই স্বৈরশাসনকে পরাস্ত করা সম্ভব।
সুশাসন কী? সুশাসনের নীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা কী কী?
ভবিষ্যতের আশা
ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, স্বৈরশাসকের জয় সাময়িক। মানবতার অদম্য চেতনা, সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের আদর্শ সর্বদা বিজয়ী হবে। আজকের প্রজন্মের হাতে ভবিষ্যত গড়ার দায়িত্ব রয়েছে। সচেতন নাগরিক হিসাবে আমাদের সকলকেই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
একটি সুন্দর, ন্যায্য ও সুখী বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হলে স্বৈরশাসকের অবসান অপরিহার্য। ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, আজকের প্রেক্ষাপটে সাহসী ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, অন্ধকার যতই ঘন হোক না কেন, আলোর জয় অবশ্যম্ভাবী। জালিমেরা অস্থায়ী, কিন্তু মানুষের ইচ্ছাশক্তি চিরন্তন। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি এমন সমাজ গড়ি, যেখানে মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং সুখের প্রতিষ্ঠা হবে।













