একুশ শতকের এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আমরা এমন কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি যে, প্রতিনিয়ত আমাদের ভাবতে হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কি সত্যিই সংকুচিত হচ্ছে? আমরা এই সময়ে এসে যা কিছু দেখছি, উপভোগ করছি বা সহ্য করছি যা হয়ত আজ থেকে দশ-বিশ কিংবা একশ বছর আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। যদিও এই কল্পনা করতে না পারার ব্যাপারটা নানা কারণের সাথে নির্ভরশীল, তবুও কল্পনাতীতের ব্যাপারটা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। আমরা এখন এসে যেমন চ্যাট-জিপিটির জয়ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, তেমনি এটাও শুনতে পাচ্ছি, কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা এতটাই খারাপ যে, ইতালি সরকারি ভাবে চ্যাট-জিপিটিকে ইতালিতে নিষিদ্ধ করেছে! কিন্তু কেন?দুনিয়া জুড়ে চ্যাট-জিপিটির যে জয়গান, মুহুর্তেই যেন চুপসে গেল, অভিযোগ, চ্যাট-জিপিটির দৌরাত্ম! আসলেই কি তাই? দুনিয়া জুড়ে আমেরিকা-ন্যাটোর তথ্য সন্ত্রাসবাদের যে দৌরাত্ম চলছে যুগ যুগ ধরে, তার কি কেউ লাগাম টেনে ধরেছে? কিংবা কখনও কেউ ভেবে দেখেছে লাগাম টেনে ধরার? বরং যখনি জুলিয়ান এসাঞ্জ কিংবা এডওয়ার্ড স্নোডেনের মত জনস্বার্থবাদী কোন ব্যক্তি আমেরিকা ন্যাটোর তথ্য সন্ত্রাসের মুখোস খুলে দিতে গেছে তখুনি তার ওপর নেমে এসেছে খড়্গ! এত সব কিছু মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগায়,মত প্রকাশের স্বাধীনতা কি সংকুচিত হচ্ছে? নাকি এটাই সংকীর্ণতাই মত প্রকাশের নীতি!
মত প্রকাশের স্বাধীনতা কি?
মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে কি না সেটা খোঁজার আগে আমাদের জানতে হবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে আসলে কি বুঝায়। আভিধানিক ভাবে ‘মত’ বলতে বুঝায় অভিমত, মানসিকভাব বা ধারণা, বোধ ইত্যাদি। ইংরেজিতে মতের সমার্থক শব্দ হিসেবে পাওয়া যায় Opinion, View Remark, Thought, Idea, Sentiment, Belief, এবং Faith। আবার অক্সফোর্ড ডিকশনারির নবম সংস্করণ অনুযায়ী, মত বলতে বোঝায়, কোন বিষয় বা ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির অনুভূতি, চিন্তা বা ধারণা, তবে কোন বাস্তবতা নয়। অর্থাৎ, মত বলতে বোঝায় কোন ব্যক্তি বা বস্তু সম্পর্কে অপর কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত অনুভূতি বা চিন্তা। এটা যে বাস্তবসম্মত তা সত্য কোন ঘটনা বা কোন ঘটনার প্রকৃত কোন অবস্থা সম্পর্কেই বলবে তা নয়। অপ্রকৃত অবস্থা বা অসত্য ঘটনা বা সত্য ঘটনার অসত্য অবস্থাও এই ‘মত’এর অধীনে আসে। আর মত প্রকাশ বলতে বোঝায়, যেকোন মাধ্যম বা উপায়ে ব্যক্তির মনোভাব, চিন্তা, অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। এটা হতে পারে কবিতা, গল্পের মাধ্যমে। হতে পারে নাটক-সিনেমার মাধ্যমে। আবার কার্টুন আকার মাধ্যমেও মত প্রকাশ ঘটতে পারে। প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তির চিন্তা, অনুভূতি মত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও এর সীমারেখা
তবে ‘মত’ থাকা কিংবা মত প্রকাশের সাথে জড়িত সবচেয়ে জরুরী মৌলিক শর্ত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা। যদি জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের মত আপনার দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানও বলেন যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই কিন্তু, মত প্রকাশের পরে কি হবে তার নিশ্চয়তা নাই তাহলে বুঝতে হবে ব্যক্তি মুগাবের সহোদরের রাজ্যেই বসবাস করছেন, যেমনটা আমরা দেখেছি এডওয়ার্ড স্নোডেনের বেলায়, জুলিয়ান এসাঞ্জের বেলায়, জামাল খাশোগি কিংবা সাগর-রুনির বেলায়। মত প্রকাশ হয়ত করেছেন, কিন্তু স্বাধীনতার সাড়ে বারো অবস্থার ফলে আপনাকে অকালে পরকালবাসী যদি হতে হয় তবে সেখানে আর যাইহোক, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা কি সংকুচিত হচ্ছে?
সাধারণ থেকে অসাধারণ, প্রত্যকেরই কথা বলার, মত প্রকাশের অধিকার আছে, সাংবিধানিক অধিকার। আপাতঃ দৃষ্টিতে যদিও চাইলেই যে কেউ এই অধিকার লঙ্ঘন করতে পারেনা তবে, একুশ শোতকে এসে মনে হচ্ছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করার কর্তব্য সরকার বা রাষ্ট্রগুলো নিয়ে নিয়েছে। কথা বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা, সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা, কার্টুন আঁকার ওপর নিষেধাজ্ঞা! এই চর্চা দুনিয়া জুড়ে চলছে। অথচ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে বলা যায়।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিভাবে দুনিয়া জুড়ে লঙ্ঘিত হচ্ছে একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অভিযোগ ছড়িয়েছে যে, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, কথা বললে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, হত্যা করা হয়, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে হাজার হাজার মামলা করা হয়, মানুষের ভোটাধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই। এই অভিযোগগুলো বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিই করে আসছে কয়েক বছর ধরে। সম্প্রতি তাদের সাথে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তাদের সমমনা দেশগুলো একই সুরে কথা বলছে। তারা সম্প্রতি নতুন ভিসা নীতিও জারি করেছে যেখানে বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচনে কেউ ভোটাধিকার খর্ব করলে, জালিয়াতি করলে, নির্বাচন সাজানো হলে দায়ীরা কেউ আমেরিকার ভিসা পাবেনা। অতীত ইতিহাস বলে আমেরিকা-ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেখানে নাক গলাবে সেখানে আর রক্ষা নাই। সে যাইহোক, এইসব অভিযোগের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে সরকার ও সরকারকে ক্ষমতায় চাওয়া ভারত সরকার। আর তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে চীন ও রাশিয়া।
How far Freedom of Expression is appropriate?
তবে মজার ব্যপার হলো, আমেরিকা-ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টায়’ সরকারকে চাপে ফেলেছে যেন সরকার ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়, মানবাধিকার নিশ্চিত করে। এই আমেরিকা-ইইউ’ই কিন্তু আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন তছনছ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছে। আর যুদ্ধে যারা তাদেরকে সমর্থণ করেনি, করছেনা তাদের ওপর নানা ধরণের চাপ প্রয়োগ করছে, নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, সম্পদ আটকে দিচ্ছে। তারা পুরো অনলাইন-অফলাইন জুড়ে ইউক্রেন যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্যের অবাধ সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণ করছে। যারা আমেরিকা-ইইউয়ের সুরে কথা বলবে না, তাদেরকে সমর্থণ করবে না, তাদের আর্থিক লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে। আমেরিকা-ইইউবিরোধী চিন্তাভাবনার কোন লেখা, কন্টেন্ট অনলাইনে পাবলিশ হবে না, মুছে দেয়া হবে এবং চুড়ান্তভাবে ওইসব কন্টেন্ট থেকে কেউ কোন অর্থ উপার্জন করতে পারবে না, অর্থাৎ, মনিটাইজেশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গুগলসহ প্রত্যেকেই।
শুধু ইউক্রেন ইস্যুই নয়। আমেরিকা-ইউরোপ জুড়ে যে তথাকথিত ‘জাগ্রত সংস্কৃতি’র চর্চা চলছে তার বিরোধী কোন কন্টেন্ট, মতামত কেউ প্রদান করতে বা প্রকাশ করতে পারবে না। সো কল্ড লিবারেলরা যা খুশী বলতে পারবে, চাইলে কোন পুরুষ নিজেকে মহিলা হিসেবে পরিচিত করতে পারবে, খুনের আসামি নিজেকে ৫ বছরের অবুঝ শিশু হিসেবে নিজেকে দাবী করতে পারবে কিন্তু আপনি তাদের এইসব আবোলতাবোল-উদ্ভট দাবি বা চর্চার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবেন না, আপনি হেট-স্পিচের দায়ে দোষী হবেন। শুধু তাই নয়, তাদের এই প্রলাপকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়, নতুবা শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়না, এটাই আইন, আপনি মানতে বাধ্য।
এটা গেল একটা দিক, এর ভিন্ন দিক অর্থাৎ, বাংলাদেশ সরকার ও তার বন্ধু ভারত, চীন, রাশিয়ার বয়ানটাও মজার। বাংলাদেশ সরকারের বয়ান হচ্ছে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন, মত প্রকাশের যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে, ভোটাধিকার আছে। আর এই বয়ানকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে ভারত, রাশিয়া ও চীন। এবং এসব বয়ানকে সমর্থন ও প্রচার করার জন্য আছে বিশেষ সাইবার টিম। তাদের দাবি, বাংলাদেশের ব্যপারে নাক গলাচ্ছে আমেরিকা-ইউরোপ, তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই ‘সাইবার টিম’ ভারতের হস্তক্ষেপকে দোষ হিসেবে দেখছে না, এটাকে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ বলেই প্রচার করছে। অভিযোগ আছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত সুজাতা সিং বিরোধী দলীয় নেতা হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদকে অনুরোধ করেছেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে। এসব ছাড়াও নানা ধরণের অসম সম্পর্কের খেসারত বাংলাদেশকে দিতে হলেও ভারতের হস্তক্ষেপকে সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে না দেখে বন্ধুত্ব হিসেবে দেখলেও আমেরিকা-ইউরোপের হস্তক্ষেপকে সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে দেখছেন। অর্থাৎ, একই বিষয়ে একেক পক্ষের, একেক ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন মত, ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। তবে ভুলে গেলে চলবে না, সিকিমের মত ঘটনা প্রতিবেশি হিসেবে বাংলাদেশ খুব কাছ থেকেই দেখেছে।
What is the Gender Pay Gap? Does it really exist?
অনলাইন জগতে, স্যোশাল মিডিয়া টুইটারে কিছুদিন আগেও ডোনাল্ড ট্রাম্প, এন্ড্রু টেটকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে যদিও পরে ইলন মাস্ক টুইটার কিনে নেয়ার পরে টুইটারের পলিসি পালটে যায় এবং ট্রাম্প ও এন্ড্রু টেটের মত অনেকেই কথা বলার স্বাধীনতা ফিরে পান। ফেসবুকের ঘটনাও এখানে রেফারেন্স হিসেবে টানা যায়। ২০১৭ সালে যখন মায়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, ফেসবুক নানাভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যা সংক্রান্ত তথ্য নিয়ন্ত্রন করেছে। তারা আন্তর্জাতিক আদালতে চলাকালীন মামলার জন্য গাম্বিয়াকে রোহিঙ্গা গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য দিতে অস্বীকার করেছে। সাম্প্রতিককালে কাতারে অনুষ্ঠিত ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপে বিবিসি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতে বিরত থেকেছিল। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করাই কারো কাছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা।













