পেটেন্ট হল কোনো নতুন আবিষ্কারের উপর একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া অধিকার। এটি একটি আইনী সুরক্ষা যা উদ্ভাবককে তার উদ্ভাবন ব্যবহার, বিক্রয় বা অন্যকে ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ার একচেটিয়া অধিকার দেয়। এই নিবন্ধে পেটেন্টের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া আলোচনা করব।
বাংলাদেশ পেটেন্ট আইন, ২০২৩ বাংলাদেশে পেটেন্ট ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই আইনে পেটেন্ট কী, কে পেটেন্টের জন্য আবেদন করতে পারে, পেটেন্টের জন্য কী কী যোগ্যতা থাকতে হবে, পেটেন্টের মেয়াদ কত হবে অর্থাৎ, পেটেন্টের জন্য আবেদন প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা আছে। এই আইনের অধীন বাংলাদেশে পেটেন্ট ব্যবস্থা পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর দ্বারা পরিচালিত হয়। যখন কেউ কোনো উদ্ভাবনের জন্য পেটেন্টের আবেদন করে, তখন এই অধিদপ্তরই সেই আবেদন পরীক্ষা করে।
পেটেন্ট করলে সুবিধা কি কি?
সাধারণত পেটেন্ট ২০ বছরের জন্য বৈধ থাকে, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি দেশের আইন অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। পেটেন্ট করার মাধ্যমে উদ্ভাবকদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া যায়। নিচে পেটেন্টের কিছু প্রধান সুবিধা আলোচনা করা হলোঃ
- আইনি সুরক্ষা: পেটেন্টের প্রধান সুবিধা হলো আইনি সুরক্ষা। একবার পেটেন্ট পেয়ে গেলে, অন্য কেউ আপনার অনুমতি ছাড়া আপনার উদ্ভাবন ব্যবহার করলে আপনি আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এটি উদ্ভাবনকে নিরাপদ রাখে এবং চুরি বা নকল হওয়ার আশঙ্কা কমায়।
- মুনাফার সুযোগ: পেটেন্ট প্রাপ্তির ফলে আপনি আপনার উদ্ভাবনটি বিক্রি করতে পারবেন বা লাইসেন্স দিতে পারবেন। উদ্ভাবন থেকে লাভ অর্জনের একটি সহজ উপায় হলো পেটেন্ট লাইসেন্স প্রদান, যা আপনাকে রয়্যালটি আকারে আয় এনে দিতে পারে।
- বাজারে একচেটিয়া অধিকার: পেটেন্ট আপনাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (সাধারণত ২০ বছর) আপনার উদ্ভাবন ব্যবহারের একচেটিয়া অধিকার দেয়। এই সময়ে আপনি অন্য কোনো প্রতিযোগীর সাথে উদ্ভাবন ভাগ করতে বাধ্য থাকবেন না, যা বাজারে আপনার শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করে।
- নতুন উদ্ভাবনের জন্য উৎসাহ: পেটেন্টের মাধ্যমে উদ্ভাবন ও গবেষণায় উৎসাহ প্রদান করা হয়। যেহেতু উদ্ভাবক তার উদ্ভাবনের উপর অর্থনৈতিক ও আইনি সুরক্ষা পান, তাই উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন করতে উদ্বুদ্ধ হন।
- সুনাম ও পরিচিতি বৃদ্ধি: সফল পেটেন্ট করা উদ্ভাবনগুলো উদ্ভাবকদের সুনাম এবং প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বা গবেষণাগারগুলোর সাথে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ দেয়। উদ্ভাবনটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক বিনিয়োগকারী বা প্রতিষ্ঠান আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারে।

পেটেন্টের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া
বাংলাদেশ পেটেন্ট আইন, ২০২৩ অনুযায়ী পেটেন্টের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া আরও সহজ ও আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। উদ্ভাবকদের সুরক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে এবং উদ্ভাবনী কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার জন্য এই নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে পেটেন্টের জন্য আবেদন প্রক্রিয়াটি কয়েকটি নির্দিষ্ট ধাপে বিভক্ত, যা আপনাকে পেটেন্ট আবেদন থেকে শুরু করে পেটেন্ট অনুমোদন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। পেটেন্টের জন্য আবেদন প্রক্রিয়াটি নিচে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলোঃ
১. পেটেন্ট যোগ্য উদ্ভাবন নিশ্চিত করা
প্রথম ধাপ হলো, আপনার উদ্ভাবনটি পেটেন্টযোগ্য কিনা তা নিশ্চিত করা। নতুন আইন অনুযায়ী পেটেন্ট পেতে হলে আপনার উদ্ভাবনটি হতে হবে:
- নতুনঃ উদ্ভাবনটি আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি বা ব্যবহার হয়নি।
- উদ্ভাবনশীলঃ এটি এমন কিছু হতে হবে যা পূর্বের প্রযুক্তি বা উদ্ভাবন থেকে আলাদা ও সৃষ্টিশীল।
- শিল্পে ব্যবহারযোগ্যঃ আপনার উদ্ভাবনটি শিল্পে বা অর্থনীতির কোনও ক্ষেত্রে ব্যবহার করা সম্ভব হতে হবে।
ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি (Intellectual Property) কি এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ?
২. পেটেন্ট আবেদনের প্রস্তুতি
প্রথমে পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে একটি নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন দাখিল করতে হবে। এই আবেদনে আপনার উদ্ভাবনের বিস্তারিত বিবরণ, কাজ করার পদ্ধতি, কীভাবে এটি অন্যদের থেকে আলাদা, এবং উদ্ভাবনের কার্যকারিতা এবং বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে হবে। এই আবেদন প্রক্রিয়াটি এখন অনলাইনেও করা সম্ভব, যা আবেদনকারীদের জন্য আরও সহজ করেছে।
অনলাইনে পেটেন্ট আবেদন প্রক্রিয়া:
- প্রথমে DPDT-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।
- এরপর, নির্ধারিত ফি দিয়ে আবেদনপত্র জমা দিতে হবে।
- আবেদনপত্রের সমস্ত বিবরণ সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র স্ক্যান করে আপলোড করতে হবে।
ম্যানুয়াল আবেদন প্রক্রিয়া:
- আপনি চাইলে ম্যানুয়ালি আবেদনপত্র প্রস্তুত করে তা সরাসরি DPDT অফিসে জমা দিতে পারেন।
- ম্যানুয়াল আবেদনের জন্য ফি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য DPDT অফিস থেকে পাওয়া যাবে।
আবেদনের সাথে আপনাকে নিম্নলিখিত দলিলপত্র জমা দিতে হবে:
- উদ্ভাবনের বিস্তারিত বিবরণ (উদ্ভাবনের কাজের পদ্ধতি, তার বৈশিষ্ট্য, এবং তার কার্যপ্রণালীর বিস্তারিত বিবরণ)
- উদ্ভাবকের অধিকারগুলি কী হবে তা উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট দাবি। উদাহরণস্বরূপ, উদ্ভাবনটির কোন অংশ পেটেন্ট করা হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে হবে।
- উদ্ভাবকের পূর্ণ নাম, ঠিকানা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য যুক্ত করতে হবে।
- আপনার উদ্ভাবনের ড্রাফট, স্কেচ বা ডায়াগ্রাম থাকলে তা জমা দিতে হবে।
- আর্থিক ফি
- যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি
What are Legal Rights? Its Essentials and Classification
৩. আবেদন যাচাই ও পরীক্ষা
আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর DPDT আবেদনটির প্রাথমিক যাচাই করবে। তারা দেখবে যে, সমস্ত নথিপত্র সঠিকভাবে জমা দেওয়া হয়েছে কি না এবং আবেদনপত্রের বিবরণ সঠিকভাবে প্রদান করা হয়েছে কি না।
এরপর, পেটেন্ট অফিসের কর্মকর্তারা আপনার উদ্ভাবনটি পরীক্ষা করবেন। এই ধাপটি আবেদনপত্রের সাবস্ট্যান্টিভ এক্সামিনেশন নামে পরিচিত। তারা যাচাই করবে যে আপনার উদ্ভাবনটি নতুন কিনা, এবং উদ্ভাবনশীলতা আছে কিনা।
পরীক্ষার ধাপ:
- পূর্বের উদ্ভাবনের সাথে মিল পরীক্ষা: আপনার উদ্ভাবনটি পূর্বে কোনো পেটেন্ট করা উদ্ভাবনের সাথে মিল আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হবে।
- উদ্ভাবনশীল ধাপের মূল্যায়ন: উদ্ভাবনটি সাধারণ কোন পদ্ধতি বা ধাপের উন্নতি কিনা তা দেখা হবে।
- প্রয়োগযোগ্যতা: উদ্ভাবনটি শিল্পে বা বাণিজ্যে ব্যবহারযোগ্য কিনা তা যাচাই করা হবে।
যদি সমস্ত কিছু সঠিক থাকে, তাহলে আপনার পেটেন্ট আবেদনটি অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত হবে। আবেদনপত্র কোনো তথ্যের ঘাটতি বা ত্রুটি থাকলে, তবে তা সংশোধনের জন্য একটি সুযোগ দেওয়া হবে।
৪. প্রকাশনা ও আপত্তি জানানো
যদি পরীক্ষায় আপনার উদ্ভাবনটি পেটেন্টযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়, তবে পেটেন্ট অফিস একটি প্রাথমিক অনুমোদন দেবে এবং পেটেন্টের তথ্য একটি সরকারি প্রকাশনায় প্রকাশিত হবে। এই প্রকাশনার মাধ্যমে জনগণ ৬ মাসের মধ্যে এই পেটেন্টের বিরুদ্ধে আপত্তি জানাতে পারে। যদি কেউ আপনার পেটেন্টের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তবে সেই আপত্তি খতিয়ে দেখা হবে এবং প্রয়োজন হলে শুনানির মাধ্যমে মীমাংসা হবে।
৫. পেটেন্ট মঞ্জুর
কোনো আপত্তি না থাকলে এবং সমস্ত প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হলে, আপনার পেটেন্টটি মঞ্জুর করা হবে। পেটেন্ট পাওয়ার পরে, আপনি ২০ বছরের জন্য আপনার উদ্ভাবনের একচেটিয়া অধিকার পাবেন। এর মাধ্যমে আপনি এককভাবে উদ্ভাবনটি ব্যবহার, উৎপাদন এবং বিক্রয় করতে পারবেন, এবং অন্য কেউ তা অনুমতি ছাড়া করতে পারবে না।
৬. পেটেন্ট নবায়ন
পেটেন্টের মেয়াদ সাধারণত ২০ বছর। তবে, প্রতিটি পেটেন্টের জন্য নবায়ন ফি দিতে হয়। যদি আপনি সময়মতো নবায়নের জন্য আবেদন না করেন, তবে আপনার পেটেন্টটি বাতিল হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ পেটেন্ট আইন, ২০২৩ অনুযায়ী, পেটেন্ট পাওয়ার পর, আপনার উদ্ভাবনের উপর আপনিই একক অধিকার পাবেন। পেটেন্টের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর পেটেন্ট পেয়ে গেলে আপনি চাইলে অন্য কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানিকে লাইসেন্সের মাধ্যমে আপনার উদ্ভাবনটি ব্যবহার করার অনুমতি দিতে পারেন। যদি কেউ আপনার অনুমতি ছাড়া আপনার পেটেন্টকৃত উদ্ভাবন ব্যবহার করে, তবে আপনি তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবেন। বাংলাদেশ পেটেন্ট আইন, ২০২৩ অনুযায়ী, পেটেন্ট লঙ্ঘনের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, পেটেন্ট লঙ্ঘনকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা এবং লঙ্ঘন বন্ধ করার জন্য আদালতের নির্দেশ প্রদান।













