বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া যা ব্যবসার আইনগত সুরক্ষা এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্র্যান্ডের বিশেষত্ব নিশ্চিত করে। যে কোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে, ট্রেডমার্ক আপনাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় প্রদান করে এবং এটি রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে আইনি সুরক্ষা পাওয়া যায়। ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন করার মাধ্যমে আপনি  ব্র্যান্ডকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলতে পারেন এবং সেটির উপর একক অধিকার অর্জন করতে পারেন।  বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত আইনগুলি পরিচালিত হয় ট্রেডমার্কস অ্যাক্ট, ২০০৯ অনুযায়ী। এই নিবন্ধে আমরা ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

কেন ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন করা উচিত?

ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধুমাত্র  ব্র্যান্ডকে সুরক্ষিত করে না, বরং বিভিন্ন আইনি অধিকার প্রদান করে। ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন করার মূল কয়েকটি কারণ হলো:

  • স্বত্বাধিকার: নিবন্ধিত ট্রেডমার্কের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ব্যবহারের একচ্ছত্র অধিকার নিশ্চিত হয়, যা প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা পরিচিতি দেয়।
  • আইনি সুরক্ষা: ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন পণ্য বা সেবা সুরক্ষিত করার অধিকার প্রদান করে। এটি অন্য কাউকে  ট্রেডমার্ক ব্যবহার করা থেকে বাধা দেয়।
  • ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা: একটি নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক ভোক্তাদের মধ্যে ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করে। এটি  ব্র্যান্ডের মান নির্ধারণ করতে সহায়ক।
  • আন্তর্জাতিক প্রসার: আন্তর্জাতিক ব্যবসায় প্রবেশের ক্ষেত্রে একটি নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি অন্য দেশে ব্র্যান্ড সুরক্ষিত করার সুযোগ দেয়।
  • ট্রেডমার্ক স্থানান্তর: ট্রেডমার্ক নিবন্ধিত থাকলে বিক্রি বা লিজ দেয়া যায়, যা অতিরিক্ত আয় করতে সহায়ক হতে পারে।

ট্রেডমার্ক: কী, কেন, এবং ট্রেডমার্ক সুরক্ষা করার উপায় কি?

ট্রেডমার্ক: কী, কেন, এবং ট্রেডমার্ক সুরক্ষা করার উপায় কি?

কোন চিহ্নগুলি ট্রেডমার্ক হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারে?

ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন পেতে, চিহ্নটি হতে হবে স্বতন্ত্র এবং অন্য কোনো রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্কের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া যাবে না। এছাড়াও, এটি অবৈধ বা প্রতারণাপূর্ণ চিহ্ন হতে পারবে না যা বাজারে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। অনেক সময় কিছু চিহ্ন বা প্রতীক ট্রেডমার্ক হিসেবে রেজিস্ট্রেশনযোগ্য হয় না। সাধারণ বা বর্ণনামূলক শব্দ, অশ্লীল বা অবমাননাকর শব্দ, মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী চিহ্ন, সরকারি বা জাতীয় প্রতীক ট্রেডমার্ক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করা যায় না। নানাবিধ শর্ত বিবেচনায় নিম্নলিখিত চিহ্নগুলো ট্রেডমার্ক হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারে:

  • শব্দচিহ্ন (Word Marks)
  • লোগো বা চিত্রচিহ্ন (Logo or Figurative Marks)
  • থ্রিডি চিহ্ন (Three-dimensional Marks)
  • রঙ, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি যা পণ্য বা সেবার স্বাতন্ত্র্যকে প্রকাশ করে

বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য

বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশনের জন্য নিম্নলিখিত তথ্যগুলি প্রয়োজন হয়:

  • ট্রেডমার্কের পূর্ণ বিবরণ বা চিত্র
  • আবেদনকারীর নাম, ঠিকানা, এবং জাতীয়তা
  • যদি প্রতিষ্ঠান হয়, তবে সইকারীর নাম এবং পদবি
  • পণ্য বা সেবার বিবরণ (কোন শ্রেণীতে আওতাভুক্ত)
  • প্রথমবার ব্যবহারের তারিখ (যদি ট্রেডমার্কটি ইতিমধ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে)
  • পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি (যদি কোনো প্রতিনিধি আবেদন করে)

বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া

ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াটি মোটামুটি একাধিক ধাপে সম্পন্ন হয়, যা উল্লেখযোগ্যভাবে সময়সাপেক্ষ হলেও বাংলাদেশের আইনে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ট্রেডমার্কস অ্যাক্ট, ২০০৯ অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া নিম্নরূপ:

  1. ট্রেডমার্ক অনুসন্ধান: আবেদনপূর্ব একটি প্রয়োজনীয় ধাপ হলো নিশ্চিত করা যে ট্রেডমার্কটি ইতিমধ্যেই নিবন্ধিত নয় বা অনুরূপ চিহ্নের সাথে মিলে না। এই অনুসন্ধানটি ডিপিডিটি (Department of Patents, Designs and Trademarks) ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনেও করা যায়।
  2. আবেদন দাখিল: অনুসন্ধান সফল হলে, আবেদনপত্র প্রস্তুত করে দাখিল করতে হবে। এতে থাকবে ট্রেডমার্কের পূর্ণ বিবরণ, আবেদনকারীর তথ্য, পণ্য বা সেবা শ্রেণী, এবং প্রয়োজনীয় ফি জমা দেওয়ার কাগজপত্র। এছাড়া, অনলাইনে DPDT এর মাধ্যমে আবেদন করা সম্ভব।
  3. পরীক্ষণ ধাপ: আবেদনের পর ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রারের কাছে পরীক্ষা করা হয়। যদি চিহ্নটি বৈধ এবং অনন্য হয়, তবে ট্রেডমার্কটি ট্রেডমার্ক জার্নালে প্রকাশ করা হয়। যদি কোনো আপত্তি না আসে, তাহলে আবেদনকারীর জন্য স্বীকৃতি পত্র ইস্যু করা হয়।
  4. জার্নালে প্রকাশনা: পরীক্ষা সফলভাবে সমাপ্ত হলে, ট্রেডমার্কটি সরকারী জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই পর্যায়ে কেউ আপত্তি উত্থাপন করতে পারে যদি তারা মনে করে যে চিহ্নটি তাদের অধিকার লঙ্ঘন করছে।
  5. আপত্তি এবং প্রতিউত্তর: যদি কোনো আপত্তি উত্থাপিত হয়, তাহলে আবেদনকারীকে দুই মাসের মধ্যে একটি প্রতিউত্তর দাখিল করতে হবে। এরপর রেজিস্ট্রার উভয় পক্ষের শুনানির পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
  6. রেজিস্ট্রেশন প্রশংসাপত্র: আপত্তি নিষ্পত্তি হলে এবং সমস্ত প্রয়োজনীয় ফি প্রদান করলে, আবেদনকারীকে একটি রেজিস্ট্রেশন প্রশংসাপত্র প্রদান করা হয়।
  7. নবায়ন: একটি নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক প্রথম সাত বছরের জন্য বৈধ এবং এরপর প্রতি ১০ বছর অন্তর নবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশে পেটেন্টের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া কেমন?

বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন ফি

বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশনের জন্য নির্দিষ্ট ফি রয়েছে। এই ফি ট্রেডমার্কের ধরন এবং পণ্য বা সেবার উপর নির্ভর করে। সাধারণত, একটি ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন করতে প্রাথমিক আবেদন ফি এবং নবায়নের জন্য অতিরিক্ত ফি জমা দিতে হয়। তাছাড়া, যদি কোনো আপত্তি ওঠে তবে সেগুলি সমাধান করতে আরো আইনি খরচ হতে পারে। ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে, নাম সার্চ খরচ প্রায় ২০০০ টাকা + ভ্যাট, আবেদন ফি প্রায় ৫০০০ টাকা + ভ্যাট, ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন খরচ প্রায় ২০০০০ টাকা সহ সব মিলিয়ে মোট সরকারি খরচ প্রায় ৩৫০০০ টাকা + ভ্যাট ৫২৫০ টাকা লাগবে।

ট্রেডমার্কে WIPO নির্দেশিকা

বাংলাদেশ একটি WIPO (World Intellectual Property Organization) সদস্য দেশ। এর ফলে, আন্তর্জাতিক ট্রেডমার্ক নীতিমালা এবং মাদ্রিদ সিস্টেম এর অধীনে বাংলাদেশী সংস্থা আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন করতে পারে। মাদ্রিদ সিস্টেমের মাধ্যমে একক আবেদন ফর্মের মাধ্যমে বহু দেশে ট্রেডমার্কের জন্য আবেদন করা সম্ভব।

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক রাজনীতি রাকিবুল ইসলামের বিশেষ আগ্রহের বিষয়। তাঁর লেখালেখির মূল বিষয়বস্তু হলো রাজনীতি, সরকার, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।

সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রেরঃ নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা

গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।

  • গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ

গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।

  • পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা: তুরস্কের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ, নাকি কুর্দিদের জন্য অধিকার হারানোর নতুন ঝুঁকি?

পিকেকে-র বিলুপ্তি: তুরস্কের জন্য সুযোগ নাকি কুর্দিদের জন্য নতুন সংকট?

পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা: তুরস্কের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ, নাকি কুর্দিদের জন্য অধিকার হারানোর নতুন ঝুঁকি?

  • আজ ১০ মে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে "অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস" নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটি কোরআনের সূরা আস-সাফের ৪ নম্বর আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ "গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর"। গত ৬ মে’র ভারতের "অপারেশন সিঁদুর"-এর জবাবে পাকিস্তান এই পাল্টা হামলা চালিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ভারত প্রকাশ করেনি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দাবি, এই অভিযানে জম্মু-কাশ্মীর, পাঞ্জাব, ও রাজস্থানের একাধিক সামরিক টার্গেটে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে, যার মধ্যে ব্রাহ্মোস মিসাইল ডিপো এবং এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত।

অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুসঃ ভারতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা

পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে "অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস" নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটির অর্থ "গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর"।

  • বিচারিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আদালতের এখতিয়ার। আদালতের এখতিয়ার তিন প্রকারঃ আদি এখতিয়ার, আপীল এখতিয়ার, এবং পরিদর্শন এখতিয়ার।

আদালতের এখতিয়ারঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও বাংলাদেশে প্রয়োগ

বিচারিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আদালতের এখতিয়ার। আদালতের এখতিয়ার তিন প্রকারঃ আদি এখতিয়ার, আপীল এখতিয়ার, এবং পরিদর্শন এখতিয়ার।