জাতীয়তাবাদঃ ধারণা, গুরুত্ব ও আধুনিক সভ্যতায় প্রভাব

জাতীয়তাবাদ এমন একটি ধারণা, যা মূলত একটি জাতির সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক একাত্মতা, স্বাধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে। সাধারণত জাতির মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং ঐক্য সৃষ্টির জন্য এটি গড়ে ওঠে।
জাতীয়তাবাদ এমন একটি ধারণা, যা মূলত একটি জাতির সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক একাত্মতা, স্বাধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে। সাধারণত জাতির মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং ঐক্য সৃষ্টির জন্য এটি গড়ে ওঠে।

জাতীয়তাবাদ মানব সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা একদিকে জাতি গঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, অন্যদিকে আধুনিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে বিশাল ভূমিকা পালন করে। ষোড়শ শতাব্দীতে এর উন্মেষ ঘটলেও উনবিংশ শতাব্দীতে এসে এটি পূর্ণতা লাভ করে। জাতীয়তাবাদ একটি জাতির মানুষের মধ্যে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক অধিকার সংরক্ষণে সংহতি ও একাত্মতার অনুভূতি তৈরি করে। তবে, আদর্শচ্যুত জাতীয়তাবাদ আধুনিক সভ্যতার জন্য বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা জাতীয়তাবাদের ধারণা, তার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলো বিশ্লেষণ করবো।

জাতীয়তাবাদ কী?

জাতীয়তাবাদ এমন একটি ধারণা, যা মূলত একটি জাতির সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক একাত্মতা, স্বাধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে। সাধারণত জাতির মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং ঐক্য সৃষ্টির জন্য এটি গড়ে ওঠে।

ইংরেজি শব্দ “Nationality” এর বাংলা প্রতিশব্দ “জাতীয়তা” বা “জাতীয়তাবাদ”। এই শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন “Natus” বা “Natio” শব্দ থেকে, যার অর্থ জন্ম। শব্দগত দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবাদ হলো একই বংশোদ্ভূত জনসমষ্টির মনের গভীরে থাকা একটি মানসিক প্রবণতা, যা একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় বসবাসের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। এটি সম্মিলিতভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে জাতীয় ঐক্যের পথে পরিচালিত করে।

ইতালির দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি জাতীয়তাবাদ বা রাষ্ট্র গঠনের ধারণার প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, তবে তিনি সরাসরি “জাতীয়তাবাদ” শব্দটি ব্যবহার করেননি বা এর পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব তৈরি করেননি। তার রচনাগুলিতে (বিশেষ করে The Prince) তিনি শক্তিশালী ও কার্যকর শাসনব্যবস্থা গঠনের উপর জোর দেন, যা জাতীয় ঐক্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

পরবর্তিতে বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন ও এডওয়ার্ড কেলার জাতীয়তাবাদকে আরোও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এডওয়ার্ড কেলার জাতীয়তাবাদকে একটি সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্যের প্রতি গভীর সম্পর্ক হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, জাতি একটি ঐতিহ্যবাহী গোষ্ঠী, যার অভ্যন্তরীণ সংহতি এবং বাইরের বিশ্বের সাথে সম্পর্ক জাতি হিসেবে তার অস্তিত্ব নির্ধারণ করে। কেলার এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেন, যেখানে জাতি কখনও কখনও রাজনৈতিক ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক বা আধ্যাত্মিক সম্পর্কের বিষয়।  বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন তার “Immagined Communities” নামক কাজের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের একটি বিশেষ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি বলেন, “জাতীয়তাবাদ হলো এক ধরনের কাল্পনিক সম্প্রদায়, যেখানে জাতির সদস্যরা একে অপরকে জানেন না, তবুও তারা নিজেদের একটি ঐতিহাসিক গোষ্ঠী হিসেবে দেখে।” তার মতে, মুদ্রণ সংস্কৃতি, ভাষা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে এই অনুভূতি সৃষ্টি হয় এবং জাতীয়তাবাদ জাতির মানুষের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে, যা সাধারণত আধুনিক রাষ্ট্রের উত্থান এবং বহুসংস্কৃতির সমাজে এক নতুন ধারণা হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে, হেগেল বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ একটি আধ্যাত্মিক শক্তি,” যেখানে তিনি রাষ্ট্রের মানুষের আত্মবিশ্বাস এবং ঐক্যকে গুরুত্ব দেন। তার মতে, জাতীয়তাবাদ মানবজাতির আত্মপ্রকাশ এবং আত্ম-পরিচয়ের একটি অংশ, যা রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর পাশাপাশি, রুশো জাতীয়তাবাদকে গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে একত্রে দেখেছেন। তিনি বলেছিলেন যে, একটি রাষ্ট্র তখনই সফল হতে পারে, যখন তার নাগরিকরা সাধারণ স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকে। রুশো জাতীয়তাবাদের ধারণা হিসেবে জনগণের মতামত ও অধিকারকেই মূল বিষয় হিসেবে রাখেন।

সাইপ্রাস সমস্যার আদ্যোপান্ত

তবে, অ্যাডাম স্মিথ এবং কার্ল মার্ক্স জাতীয়তাবাদের কিছু সমালোচনা করেছিলেন। স্মিথ বিশেষত জাতীয়তাবাদকে বিপজ্জনক এবং অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখতেন, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। আর মার্ক্স, যারা প্রাক-শ্রেণী সমাজে বিশ্বাসী ছিলেন, তিনি মনে করতেন যে, শ্রেণী সংগ্রামই জাতীয়তা বা জাতির পরিচয়ের চেয়ে বড়ো বিষয়।

এছাড়া, আধুনিক যুগে নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারি রবিনসন এবং আমেরিকান রাজনীতিবিদ গ্যারেট হاردিন জাতীয়তাবাদকে একধরনের ‘কমন গুড’ বা ‘সামাজিক কল্যাণ’ হিসেবে যুক্ত করেছেন, যেখানে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ঘটানো একটি লক্ষ্য।

জাতীয়তাবাদে সাধারণত দুটি ধারা দেখা যায়—সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে জাতির ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিগত পরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেখানে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ জাতির সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামকে প্রাধান্য দেয়।

তবে, বর্তমান সময়ে জাতীয়তাবাদ অনেক দেশেই বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে যেখানে জাতির ঐক্য এবং স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে এটি কখনও কখনও জাতীয়তাবাদের নামে বৈষম্য, সহিংসতা এবং সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের প্রবর্তক হতে পারে। ভারতীয় বিজেপি এবং আরএসএস-এর উত্থান, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান সংঘাতে ইসরাইলের ভূমিকা, এবং বিশেষ করে বিভিন্ন জাতির স্বাধীনতার প্রশ্নে বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে জাতীয়তাবাদী সংকটগুলো জাতীয়তাবাদের নেতিবাচক উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতীয়তাবাদ: আধুনিক সভ্যতার সহায়ক না হুমকি?

আধুনিক সভ্যতায় জাতীয়তাবাদের প্রভাবের ক্ষেত্রে যেমন ইতিবাচক, তেমনি নেতিবাচক উদাহরণ পাওয়া যায়।  এটি একদিকে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে শক্তিশালী রাষ্ট্রের দিকে পরিচালিত করে, অন্যদিকে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে বিশ্বশান্তির পথে অন্তরায় হতে পারে। একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উগ্র জাতীয়তাবাদ কতটা বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছিল। এতে দেখা গেছে যে, উগ্র জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রের মধ্যে অন্ধ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে এবং তার ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধ ও ধ্বংস কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। তবে, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও একটি জাতির স্বাধীনতার জন্য জাতীয়তাবাদ কতটা শক্তিশালী প্রেরণা হতে পারে, তা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং আফ্রিকার ঔপনিবেশিক মুক্তির উদাহরণে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তাই জাতীয়তাবাদের প্রকৃত প্রভাব বোঝার জন্য, এটি আধুনিক সভ্যতার প্রতি সহায়ক না হুমকি, তা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

মুসকান খানের হিজাব ও ভারতের অসাম্প্রদায়িকতা

জাতীয়তাবাদ যখন আধুনিক সভ্যতার সহায়ক

জাতীয়তাবাদ একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং দেশের উন্নতির জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। যখন জাতি একত্রিত হয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়, তখন তার শক্তি স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। ইংরেজি দার্শনিক জোহান গটফ্রিড হার্নানি এর মতে, “জাতীয়তাবাদ একটি জাতির সত্ত্বার একটি অটুট অংশ, যা তাকে বিশ্বের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে।” তাঁর এই বক্তব্যে তিনি জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরেছেন, যা একটি জাতিকে তার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি সচেতন করে এবং তাকে বিশ্বমঞ্চে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে।

জাতীয়তাবাদ শুধু জাতিকে একত্রিত করে না, এটি তার স্বকীয়তা ও সংস্কৃতির বিকাশেও সহায়ক। কার্ল মার্ক্স মনে করতেন, “প্রতিটি জাতি তার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্যের অধিকারী হওয়া উচিত, যা জাতীয়তাবাদ নিশ্চিত করে।” ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এর মতো উদাহরণগুলো আমাদের দেখায় যে, জাতীয়তাবাদ একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা হতে পারে। এই সংগ্রামগুলোতে জাতীয়তাবাদ একটি শক্তিশালী আদর্শ হিসেবে কাজ করেছে, যা স্বাধীনতার পথে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

জাতীয়তাবাদ তখনই গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশে সহায়ক হতে পারে, যখন এটি সকল নাগরিকের জন্য সমানাধিকার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায়। Karl Deutsch এর মতে, “Nationalism can be a force for democratization when the national group seeks to establish a political order that guarantees equal rights and political participation for all.” অর্থাৎ, জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি করে, যেখানে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সমতা এবং অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়, যা একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।

জাতীয়তাবাদ একটি জাতির নিজস্ব পরিচিতি গড়তে সহায়তা করে এবং এর মাধ্যমে একটি জাতি তার সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যিক এবং ঐক্যবদ্ধ অঙ্গসংগঠন তৈরি করতে সক্ষম হয়। Giuseppe Mazzini জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন যে, এটি শুধুমাত্র একটি দেশের স্বাধীনতা ও ঐক্যের জন্য নয়, বরং বিশ্ব সভ্যতার সমৃদ্ধি এবং উন্নতির জন্যও অপরিহার্য। তিনি বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ বিশ্ব সভ্যতার সমৃদ্ধিতে সাহায্য করে,” কারণ এটি প্রতিটি জাতির নিজস্ব গুণাবলী এবং সংস্কৃতির বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে, যা সমগ্র মানবতার উন্নতির জন্য অবদান রাখে।

এইভাবে, জাতীয়তাবাদ আধুনিক সভ্যতার জন্য একটি শক্তিশালী শক্তি হতে পারে, তবে এটি তখনই সঠিকভাবে কাজ করবে যখন এটি শুধুমাত্র স্বার্থপরতার পরিবর্তে, সমানাধিকার, সামাজিক ন্যায় এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মতো মূল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত হবে।

জাতীয়তাবাদ যখন আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আগ্রাসনের হাতিয়ার হয়ে

যদিও জাতীয়তাবাদ একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তার স্বকীয়তা রক্ষা করতে সাহায্য করে, কিন্তু এর উগ্র রূপ বিশ্ব শান্তি ও সমাজে একাধিক সংকট তৈরি করতে পারে। উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতির মধ্যে বিদ্বেষ, ঘৃণা এবং অন্ধ আবেগ সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে সহিংসতা এবং সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এরকম জাতীয়তাবাদকে “সভ্যতার সংকট” হিসেবে অভিহিত করেছেন।

জাতীয়তাবাদের এই বিকৃত রূপ যখন ক্ষমতার লোভে পরিণত হয়, তখন এটি সাম্রাজ্যবাদের দিকে পরিচালিত হতে পারে। অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ যদি ক্ষমতার অন্ধ তৃষ্ণায় পরিণত হয়, তবে এটি সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়,।” ইতিহাস সাক্ষী যে, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের ক্ষমতার বিস্তার ঘটাতে অন্য জাতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে আরএসএস এবং বিজেপি-র “অখণ্ড ভারত” ধারণা জাতীয়তাবাদের বিকৃত রূপ বা আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদের একটি জীবন্ত উদাহরণ। তারা উপমহাদেশের সব দেশকে একীভূত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এটি শুধুমাত্র ঐতিহাসিক সত্য এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তগুলির প্রতি অবজ্ঞা নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনেরও সরাসরি লঙ্ঘন। তাদের এই নীতিতে প্রশ্ন ওঠে—এটি কি সত্যিকার অর্থে ভারতীয় জনগণের কল্যাণের জন্য, নাকি হিন্দুত্ববাদী আধিপত্য বিস্তারের জন্য একটি প্রচেষ্টা?

প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলের ৭৬ বছরের দখলদারির ইতিহাস জাতীয়তাবাদের অপব্যবহারের আরেকটি করুণ উদাহরণ।  ইহুদি জাতীয়তাবাদের নামে সেখানে প্যালেস্টাইনি জনগণকে ভূমি হারানোর পাশাপাশি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হয়েছে। এর ফলে শুধু একটি জাতি তাদের মাতৃভূমি হারিয়েছে তা নয়, এই সংকট মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে বারবার হুমকির মুখে ফেলেছে।

জাতীয়তাবাদের বিকৃত রূপ কেবল ভূখণ্ড দখল বা সামরিক আধিপত্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি জাতির সংস্কৃতি, পরিচয় এবং সামাজিক বৈচিত্র্য ধ্বংস করে। “অখণ্ড ভারত” এবং ইসরায়েলের আগ্রাসনের মতো উদাহরণ দেখায় যে, জাতীয়তাবাদ শুধু অন্য জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং নিজ জাতির ভেতরেও বিভেদ এবং সংঘাতের বীজ বপন করে।

ভারতের বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ দেশের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিক করে দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। এই বৈষম্যমূলক নীতি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে দুর্বল করতে পারে। অন্যদিকে, শুধুমাত্র ইহুদিদের নাগরিকত্বের অধিকারকে প্রাধান্য দেয়া ইসরায়েলের জাতি-রাষ্ট্র আইনের মতো নীতিমালাগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের অবস্থানকে আরও সংকটাপন্ন করেছে।

বিভিন্ন সময়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ সমাজের ভিতরে সংকীর্ণতা সৃষ্টি করে, বাইরের সংস্কৃতি এবং চিন্তাভাবনা গ্রহণের পথ রুদ্ধ ফলে জাতি বৈশ্বিক চিন্তা এবং উদ্ভাবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। হ্যান্স কনের মতে, “জাতীয়তাবাদ যখন অত্যাধিক শক্তিশালী হয়, তখন এটি সাংস্কৃতিক বন্ধনকে রুদ্ধ করে এবং একটি জাতিকে নিজেদের মধ্যে অন্ধকারে রাখে।”

ধনতন্ত্রের বিকাশের পর্যায়ে জাতীয়তাবাদ বিকৃত রূপ ধারণ করে। ধনতান্ত্রিক শক্তি, বিশেষত বুর্জোয়া শ্রেণি, জাতীয়তাবাদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতা কায়েম ও প্রতিরোধ দমন করে। অধ্যাপক হায়েনের মতানুসারে, “Nationalism is artificial and it is far from ennobling, in a word it is patriotic snobbery.”

জাতীয়তাবাদ আধুনিক সভ্যতার জন্য একদিকে শক্তি, যা জাতির ঐক্য ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক, অন্যদিকে এর উগ্র রূপ সমাজ এবং সভ্যতার জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। জাতীয়তাবাদ যখন ক্ষমতার লোভ বা অন্ধ আবেগে বিকৃত হয়, তখন এটি সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে ওঠে।

লেখক

  • রাকিবুল ইসলাম, মেরুনপেপার

    রাকিবুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম সম্পন্ন করেছেন। রাজনীতি, আইন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ইতিহাস নিয়ে স্পষ্ট ও তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। ওয়ার্ডপ্রেসসহ ডিজিটাল প্রকাশনার মাধ্যমে তিনি পাঠককে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করেন।

    শেয়ার করুনঃ
    আরো আর্টিকেল পড়ুন
    মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আজ যে উত্তেজনায় ভরা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ফিলিস্তিনি সংকট এবং আব্রাহাম চুক্তি নামের এক পরিবর্তনশীল কূটনৈতিক প্যাকেজ।
    ফিলিস্তিনি সংকট ও আব্রাহাম চুক্তিঃ সমালোচনা, সুফল ও বাস্তবতা

    মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আজ যে উত্তেজনায় ভরা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ফিলিস্তিনি সংকট এবং আব্রাহাম চুক্তি নামের এক পরিবর্তনশীল কূটনৈতিক প্যাকেজ।

    পি আর পদ্ধতি কী — ধরন, সুবিধা-অসুবিধা ও বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রাসঙ্গিকতা (1)
    পি আর পদ্ধতি কী — ধরন, সুবিধা-অসুবিধা ও বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রাসঙ্গিকতা

    পি আর পদ্ধতি হলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা। পি আর পদ্ধতির ধরন, সুবিধা, অসুবিধা বিবেচনায় বাংলাদেশে পি আর পদ্ধতি প্রাসঙ্গিক কি না প্রশ্ন উঠেছে।

    বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধানগুলোর অন্যতম মদিনা সনদ ইসলামি রাষ্ট্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য ঐতিহাসিক দলিল। 
    মদিনা সনদ কীঃ মদিনা সনদের প্রধান ধারা ও বিশ্ব ইতিহাসে এর গুরুত্ব বিশ্লেষণ

    বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধানগুলোর অন্যতম মদিনা সনদ ইসলামি রাষ্ট্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য ঐতিহাসিক দলিল। 

    বিবিসির প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিওতে হাসিনা স্বয়ং নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
    বিবিসির তদন্তে শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও: ‘যেখানে পাবে সেখানেই গুলি করো’

    বিবিসির প্রতিবেদনে প্রমান মিলেছে যে, শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিওতে হাসিনা স্বয়ং নিরাপত্তা বাহিনীকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

    কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল? আন্তর্জাতিক বিচারের হাত থেকে বাঁচতে, গাজার নিপীড়ন থেকে দৃষ্টি সরাতে ও ইহুদি আধিপত্য জাহিরের হতাশাজনক প্রচেষ্টা।
    কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল তার প্রকৃত কারণ

    কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল? আন্তর্জাতিক বিচারের হাত থেকে বাঁচতে, গাজার নিপীড়ন থেকে দৃষ্টি সরাতে ও ইহুদি আধিপত্য জাহিরের হতাশাজনক প্রচেষ্টা।

    গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।
    সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রেরঃ নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা

    গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।

    গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।
    বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ

    গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।

    আজ ১০ মে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে "অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস" নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটি কোরআনের সূরা আস-সাফের ৪ নম্বর আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ "গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর"। গত ৬ মে’র ভারতের "অপারেশন সিঁদুর"-এর জবাবে পাকিস্তান এই পাল্টা হামলা চালিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ভারত প্রকাশ করেনি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দাবি, এই অভিযানে জম্মু-কাশ্মীর, পাঞ্জাব, ও রাজস্থানের একাধিক সামরিক টার্গেটে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে, যার মধ্যে ব্রাহ্মোস মিসাইল ডিপো এবং এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত।
    অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুসঃ ভারতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা

    পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে “অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস” নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটির অর্থ “গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর”।

    এই আর্টিকেলগুলিও আপনি পড়তে পারেন

    মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আজ যে উত্তেজনায় ভরা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ফিলিস্তিনি সংকট এবং আব্রাহাম চুক্তি নামের এক পরিবর্তনশীল কূটনৈতিক প্যাকেজ।

    ফিলিস্তিনি সংকট ও আব্রাহাম চুক্তিঃ সমালোচনা, সুফল ও বাস্তবতা

    মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আজ যে উত্তেজনায় ভরা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ফিলিস্তিনি সংকট এবং আব্রাহাম চুক্তি নামের এক পরিবর্তনশীল কূটনৈতিক প্যাকেজ।

    পি আর পদ্ধতি কী — ধরন, সুবিধা-অসুবিধা ও বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রাসঙ্গিকতা (1)

    পি আর পদ্ধতি কী — ধরন, সুবিধা-অসুবিধা ও বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রাসঙ্গিকতা

    পি আর পদ্ধতি হলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা। পি আর পদ্ধতির ধরন, সুবিধা, অসুবিধা বিবেচনায় বাংলাদেশে পি আর পদ্ধতি প্রাসঙ্গিক কি না প্রশ্ন উঠেছে।

    বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধানগুলোর অন্যতম মদিনা সনদ ইসলামি রাষ্ট্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য ঐতিহাসিক দলিল। 

    মদিনা সনদ কীঃ মদিনা সনদের প্রধান ধারা ও বিশ্ব ইতিহাসে এর গুরুত্ব বিশ্লেষণ

    বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধানগুলোর অন্যতম মদিনা সনদ ইসলামি রাষ্ট্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য ঐতিহাসিক দলিল। 

    জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস

    জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস

    ইতিহাসের পাতায় যেসব মুহূর্ত স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তার মধ্যে বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস অন্যতম।

    নিয়মিত আর্টিকেল পেতে

    সাবস্ক্রাইব করুন

    Scroll to Top
    ×