আমেরিকান মিডিয়া সত্যকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরণের “ফিল্টার” ব্যবহার করে। তারা জাতিগত পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে অপরাধীদের আলাদা পরিচয় দেয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ কোনো অপরাধ করলেই তার নামের আগে “সন্ত্রাসী” শব্দটি যুক্ত হয় যেন এটি তার পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এটি তার পাসপোর্টে স্ট্যাম্প করা আছে। অন্যদিকে, একজন শ্বেতাঙ্গ চার্চে ঢুকে নয়জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করলেও তাকে “বিচ্ছিন্ন বন্দুকধারী” বলা হয়। এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তিনি সমাজ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিলেন।
“বিচ্ছিন্ন বন্দুকধারী” শব্দের তাৎপর্য
তাহলে প্রশ্ন হলো: এই “বিচ্ছিন্ন বন্দুকধারী” কথাটার মানে কী? এই শব্দের মানে এমনভাবে তুলে ধরা হয় যেন অপরাধী আকাশ থেকে হুট করে নেমে এসেছেন এবং পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাকে এমন একজন হিসেবে চিত্রিত করা হয় যার বন্ধু নেই, ফেসবুক প্রোফাইল নেই, এবং সামাজিক কোনো যোগসূত্রও নেই। সমাজের এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তি হিসেবে তাকে দেখানো হয়, যার অপরাধের জন্য সমাজকেও কিছুটা দায়ী করা হয়। তিনি সমাজের এমন এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তি যে তাকে দোষারোপ করতেও আপনার মায়া হবে।
সন্ত্রাসবাদ বনাম মানসিক অস্থিরতা: এক জাতি, দুই বিচারব্যবস্থা
আমেরিকান মিডিয়া অপরাধীদের জাতিগত পরিচয়ের ওপর নির্ভর করে যেভাবে তাদের বিচার করে, তা চরম পরিহাসের বিষয়। যদি অপরাধী মধ্যপ্রাচ্যের হন, তবে তাকে “সন্ত্রাসী” তকমা দেওয়া হয়। যদি কৃষ্ণাঙ্গ হন, তবে তাকে “গ্যাং কালচারের” অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদের ক্ষেত্রে “তিনি মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন” বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। যেন শ্বেতাঙ্গ হওয়া মানেই অপরাধের জন্য ক্ষমা পাওয়ার সার্টিফিকেট।
ইরাকের গনবিধ্বংসী অস্ত্রের তথ্য মিথ্যা ছিল – দ্য গার্ডিয়ান
প্রশ্ন হলো, মানসিক অস্থিরতা কি শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদের জন্য প্রযোজ্য? মধ্যপ্রাচ্যের কোনো ব্যক্তি যদি আত্মঘাতী বোমা হামলা করেন, তবে কি তিনি মানসিকভাবে স্থিতিশীল ছিলেন? কেন তারা “সন্ত্রাসী,” আর শ্বেতাঙ্গ অপরাধী “মানসিকভাবে অসুস্থ”?
মিডিয়ার ভাষার কারসাজি: সৃজনশীল বর্ণবাদ
আমেরিকান মিডিয়া অপরাধের গুরুত্ব নির্ধারণে অপরাধীর জাতিগত পরিচয়কে ব্যবহার করে। শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদের ক্ষেত্রে তাদের বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, “তিনি বন্ধু-বান্ধবহীন ছিলেন, কারো সাথে মিশতেন না।” কিন্তু অপরাধী যদি মধ্যপ্রাচ্যের কেউ হন, তবে তাকে একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর সদস্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপরাধ করেছেন বলে তুলে ধরা হয়। এর মানে হলো, শ্বেতাঙ্গ অপরাধীর ক্ষেত্রে এটি একটি ব্যক্তিগত সমস্যা, আর অন্য জাতিগোষ্ঠীর জন্য এটি একটি সামগ্রিক সমস্যা।
সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা: বিকৃত বাস্তবতা
তাত্ত্বিকভাবে, সন্ত্রাসবাদ এমন একটি কার্যকলাপ, যা পরিকল্পিতভাবে ভয় বা ঘৃণা সৃষ্টি করতে পরিচালিত হয়। একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বার্তা প্রেরণের জন্য নিরীহ জনগণের ওপর আক্রমণ চালানোর কৌশল এটি। কিন্তু আমেরিকান মিডিয়া এই সংজ্ঞাকে নিজের মতো করে বদলে নিতে পটু।
What is Woke Culture? Why is it so controversial?
কোন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি চার্চে ঢুকে একের পর এক মানুষ হত্যা করলে এই ঘটনা কি সন্ত্রাসবাদ নয়? না, আমেরিকান মিডিয়া বলবে, “তিনি মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন।” শ্বেতাঙ্গ অপরাধীর জন্য সন্ত্রাসবাদ শব্দটি যেন অপ্রাসঙ্গিক। তাহলে প্রশ্ন ওঠে: একজন মানসিকভাবে অস্থির ব্যক্তি যদি এই ধরনের হামলা করেন, তবে তার কাজ সন্ত্রাসবাদ থেকে আলাদা হয় কীভাবে? কারণ ভয় সৃষ্টি করা, বিশৃঙ্খলা তৈরি করা, এবং একটি বার্তা পাঠানোর অভিপ্রায় তো সন্ত্রাসবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সন্ত্রাসবাদের মূল উপাদানই হলো মানসিক অস্থিরতা। কোনো মানসিকভাবে স্থিতিশীল ব্যক্তি কি নিজেকে উড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবেন?
মিডিয়ার বর্ণবাদী রাজনীতি
শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদের অপরাধকে “মানবিক ভুল” হিসেবে দেখানোর মাধ্যমে আমেরিকান মিডিয়া একটি নির্দিষ্ট বার্তা প্রেরণ করে। তারা বলে, “এই ব্যক্তি নিঃসঙ্গ ছিলেন, পরিবার তাকে বুঝতে পারেনি।” এমন বক্তব্যে শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের অপরাধীদের পেছনের গল্প, মানসিক অবস্থা বা পরিস্থিতি নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। তাদের নাম এবং ধর্মই যেন প্রমাণ করে তারা অপরাধী।

“আফগান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমর্থন করুন – যুক্তরাষ্ট্র/আফগানিস্তান, ১৯৮০-এর দশক। সোলজার অফ ফর্চুন। অস্ত্র এবং গোলাবারুদের জন্য আপনার করযোগ্য অনুদান পাঠান: বোল্ডার, কলোরাডো।”
একবার ভেবে দেখুনঃ শ্বেতাঙ্গ অপরাধী যখন কোনো আক্রমণ চালায়, তখন বলা হয়, “তিনি ব্যক্তিগত কারণ বা হতাশা থেকে এমনটি করেছেন।” কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের কেউ যদি আত্মঘাতী বোমা হামলা করেন, তখন বলা হয়, “তিনি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এমনটি করেছেন।”
What is America’s Blackwater? How does it terrorize the World?
তাহলে কি শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদের কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক বার্তা নেই? শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদ যে আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি হুমকি সৃষ্টি করেছে, তা কি মিডিয়া ভুলে গেছে? বা তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে যেতে চায়?
বর্ণবৈষম্যের ঐতিহাসিক শিকড়
শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদের প্রতি এই সহানুভূতি আমেরিকার বর্ণবাদী ইতিহাসের গভীর শিকড় থেকে উদ্ভূত। দাসপ্রথা, বর্ণবাদী আইন এবং সামাজিক বিভাজন এমন একটি কাঠামো গড়ে তুলেছে, যেখানে শ্বেতাঙ্গদের অপরাধ ক্ষমার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতি এই সহানুভূতি পুরোপুরি অনুপস্থিত।
সরকারি প্রতিবেদন এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদ আমেরিকায় সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হুমকি। তবে মিডিয়া এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। তারা শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদের অপরাধকে ছোট করে এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে অপরাধের জন্য দোষারোপ করে।
কারা দায়ী?
এই ভণ্ডামি কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি বড় মিডিয়া হাউসগুলোর দ্বারা পরিচালিত একটি কৌশল, যা তাদের রাজনৈতিক এবং কর্পোরেট এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে করা হয়। মিডিয়ার পক্ষপাতমূলক আচরণ একটি পরিকল্পিত নাটকের মতো পরিচালিত হয়, যেখানে বিভাজন তৈরি করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
মিডিয়া “সন্ত্রাসবাদের” গল্প শোনানোর মাধ্যমে জনগণকে ভীত রেখে যুদ্ধনীতি এবং অস্ত্র বিক্রির বৈধতা নিশ্চিত করে। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের একটি অংশ।
“আমাদের এই উজ্জ্বল ধারণা ছিল যে আমরা পাকিস্তানে এসে মুজাহেদিনদের একটি বাহিনী তৈরি করতে যাচ্ছি, তাদের স্টিংগার মিসাইল এবং অন্যান্য সবকিছু দিয়ে সজ্জিত করব, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে সোভিয়েতদের পিছনে যেতে। এবং আমরা সফল হয়েছিলাম। সোভিয়েতরা আফগানিস্তান ত্যাগ করে। এবং তারপরে আমরা বলেছিলাম দুর্দান্ত, বিদায় – এই প্রশিক্ষিত লোকদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি যারা আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে ধর্মান্ধ ছিল, তাদের ভালভাবে সশস্ত্র রেখে, একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, সত্যি বলতে, সেই সময়ে আমরা সত্যিই চিনতে পারিনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন দেখে আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম এবং আমরা ভেবেছিলাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমরা এখন ঠিক আছি, সবকিছু অনেক ভালো হতে চলেছে। এখন তুমি ফিরে তাকাও; আজ আমরা যাদের সাথে যুদ্ধ করছি আমরা সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমর্থন করছিলাম”। – ফক্স নিউজের গ্রেটা ভ্যান সাস্টেরেনের সাথে সাক্ষাৎকার, ১৮ জুলাই, ২০১০
আমেরিকান মিডিয়ার বর্ণবাদী মনোভাব শুধু সাংবাদিকতার দিক থেকে নয়, পুরো সমাজের জন্যই হুমকিস্বরূপ। তাদের ভাষার কারসাজি এবং বিভেদমূলক প্রতিবেদনের মাধ্যমে তারা শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদের অপরাধ লঘু করে দেখায় এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে দোষারোপ করে। এটি শুধু মিডিয়ার দায়িত্বহীনতা নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক এবং সামাজিক এজেন্ডার অংশ।
One Comment
Leave A Comment
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রেরঃ নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা
গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ
গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।
পিকেকে-র বিলুপ্তি: তুরস্কের জন্য সুযোগ নাকি কুর্দিদের জন্য নতুন সংকট?
পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা: তুরস্কের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ, নাকি কুর্দিদের জন্য অধিকার হারানোর নতুন ঝুঁকি?
অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুসঃ ভারতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা
পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে "অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস" নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটির অর্থ "গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর"।
আদালতের এখতিয়ারঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও বাংলাদেশে প্রয়োগ
বিচারিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আদালতের এখতিয়ার। আদালতের এখতিয়ার তিন প্রকারঃ আদি এখতিয়ার, আপীল এখতিয়ার, এবং পরিদর্শন এখতিয়ার।
[…] আমেরিকান মিডিয়াঃ সন্ত্রাসবাদ, মানসি… […]