আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন উপজাতি ও মুসলিম অধ্যুষিত একটি উন্নয়নশীল দেশ কিন্তু বিশ্ব ইতিহাসে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এর গুরুত্ব অপরিসীম। হিন্দুকুশ পর্বতমালার এই দেশটিকে এশিয়ার হৃৎপিণ্ড এবং পৃথিবীর ‘ক্রস রোড’ বলা হয়। আফগানিস্তানের ইতিহাস যেসব ঘটনাবলী বিশেষভাবে আলোচিত হয়ে থাকে আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতন তার মধ্যে অন্যতম। কেননা আহমদ শাহ আবদালি প্রতিষ্ঠিত আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতনের মাধ্যমে আফগান ইতিহাস একটি গতানুগতিক ধারা হতে বিচ্যুত হয় এবং পরবর্তীকালে আফগান ইতিহাসে প্রবেশ করে এটি নতুন অধ্যায়ে। এই নিবন্ধে আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতনের কারণগুলো ও এর পেছনে দাউদ খানের ভূমিকা আলোচনা করব।
আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র
প্রকৃত অর্থে আফগানিস্তান কখনোই পশ্চিমা অথবা বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের অধীনে ছিল না। কিন্তু মানব ইতিহাসের অনেক বড় বড় ঢেউ আফগানিস্তানের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কোন শক্তি এখানে স্থায়ী উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেনি। পার্শিয়ান, গ্রিক, ভারতীয়, চৈনিক, হুন মঙ্গল, মুঘল এবং শেষ দিকে ইউরোপীয় প্যাগান, হিন্দু-বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান, আস্তিক এবং নাস্তিক সকলেই আফগানিস্তান জয় করেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্থানীয় আফগানদের নিকট প্রত্যেকেই পরাজিত হয়েছে।

যে আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতন নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তার সূত্রপাত হয় ১৭৪৭ সালে। ১৭৪৭ সালে পারস্য সম্রাট নাদির শাহের সেনাপতি আহমদ শাহ আবদালী আফগানিস্তানে একটি পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং রাজতন্ত্র প্রবর্তন করেন। এরপর তার বংশ এবং পরবর্তীতে মোহাম্মদ যাই রাজ বংশের আমিররা আফগানিস্তান শাসন করতে থাকে। আমির আব্দুর রহমানের শাসনামলে ১৮৮০ থেকে ১৯০১ আফগানিস্তানের রাজনীতিতে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুইটি ধারা চলছিল। এই সময়ে রাজতন্ত্রের ধারা ধীর গতির ছিল। আমির হাবিবুল্লাহ ও তার পুত্র আমির আমানুল্লাহর সময় রাজতন্ত্র পুনরায় শক্তি ফিরে পায়। পরবর্তীতে বাদশাহ মোহাম্মদ নাদির শাহ ১৯৩৩ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হলে তার পুত্র বাদশাহ জহির শাহ মাত্র ২০ বছর বয়সে আফগানিস্তানের সিংহাসনে বসেন।
আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতন
আহমদ শাহ আবদালীর প্রতিষ্ঠিত আধুনিক আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র ১৭৪৭ থেকে প্রায় দুই শতক ধরে স্থায়ী ছিল। তার উত্তরসূরী বাদশাহ জহির শাহ ১৯৩৩ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করেন। এরপর ১৯৭৩ সালে দাউদ খান জহির শাহের বিরুদ্ধে রক্তপাতহীন বিপ্লব ঘটিয়ে আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতনের ঘটান। আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতন আফগান ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা ঘরানার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। দুই শতক ধরে চলা ঐতিহাসিক আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতনের ঘটিয়ে আফগানিস্তানে প্রজাতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র পতনের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা। ছোট ছোট বহু জাতিগোষ্ঠী নিয়ে গড়ে ওঠা আফগানিস্তান একটি অন্যান্য অভ্যন্তরীন সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ ছিল। যেমনঃ আর্থ-সামাজিক অচলাবস্থা, প্রশাসনের দুর্নীতি, ছাত্রদের অসন্তোষ, বামপন্থী আন্দোলনের মত নানা কারণ দায়ী ছিল আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র পতনের জন্য। এছাড়াও, আফগানিস্তান একটি রুক্ষ ও দুর্গম দেশ। এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল। এসব কারণে আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র কখনো শক্তিশালী হতে পারেনি। ফলে, রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র, কোন ধরণের বাধা বিপত্তি ছাড়া। শেষমেশ, ১৯৭৩ সালের ১৭ই জুলাই জহির শাহের ইতালি ভ্রমনের সুযোগ নিয়ে আফগান রাজতন্ত্রের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দাউদ খান বিদ্রোহ করে আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতন ঘটান। আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র পতন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সুদীর্ঘ সংগ্রাম, আন্দোলন, বিক্ষোভের পর আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতন ঘটানো সম্ভব হয়। আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতনের পেছনে দায়ী কারণগুলোকে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলোঃ
পাক্তুনিস্তান সমস্যা বা পশতুনিস্তান সমস্যা
পাক্তুনিস্তান সমস্যা হলো আফগানিস্তানের পশতুনদের একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য হলো পশতুনদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। পাক্তুনিস্তান আন্দোলন আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের অবসানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জহির শাহ পশতুনদের স্বায়ত্তশাসন দাবিকে সমর্থন করেননি। তিনি মনে করতেন যে আফগানিস্তান একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র এবং এর অখণ্ডতা রক্ষা করা জরুরি। তিনি পাকিস্তানের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যাতে পাকিস্তানকে আফগানিস্তানের পশতুন উপজাতিদের উপর প্রভাব বিস্তার হতে বিরত থাকে। কিন্তু পাকিস্থান পশতুনদের মধ্যে স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে বিদ্রোহে উস্কানি দেয়। এই বিদ্রোহগুলো আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের উপর চাপ সৃষ্টি করে। স্পর্শকাতর এই সমস্যাটি সেনাবাহিনী, জনসাধারণ ও উপজাতিদের মধ্যে একটি বিদ্বেষ ভাব জাগিয়ে তোলে। এর ফলে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বৃদ্ধি হয় এবং জহির শাহের সরকারকে দুর্বল করে তোলেএবং আফগানিস্থানের রাজতন্ত্র পতনের দিকে ধাবিত হয়।
উপজাতীয় বিরোধিতা
আফগানিস্তান একটি বহুজাতিক ও বহুধর্মী দেশ। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। আফগানিস্তানের উপজাতিরা তাদের নিজস্ব স্বায়ত্তশাসন ও সংস্কৃতির অধিকার রক্ষার জন্য ঐতিহ্যগতভাবে সংগ্রাম করে আসছে। জহির শাহের শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি, নারীর অধিকার বৃদ্ধি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাসহ নানা ক্ষেত্রে আধুনিক সংস্কার আনার চেষ্টা করা হয়। এই সংস্কারগুলি আফগানিস্তানের উপজাতিদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের জন্ম দেয়। তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের আন্দোলনকে জহির শাহের সরকার এই আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করার চেষ্টা করে। সামরিক অভিযান থেকে শুরু করে বিদ্রোহী নেতা ও সমর্থকদের গ্রেফতার এবং বিদ্রোহী দমনে আইন প্রণয়ন করা সহ সব ধরণের দমনমূলক নীতি তিনি গ্রহণ করেন। ফলে উপজাতিগোষ্ঠীগুলো জহির শাহের সরকার বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়।
জহির শাহের ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ ও স্বৈরাচারী মনোভাব
শাসনতন্ত্র অনুযায়ী বাদশাহ প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার অধিকারী হলেও জহির শাহ প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন। তিনি সংসদের সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করতেন এবং তার নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতেন। বিশেষ করে নতুন সংবিধানেও বাদশাহর ক্ষমতার কমানো করা হয় নাই। জহির শাহ তার ব্যক্তিগত অনুগতদেরকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন এবং সংসদের ক্ষমতা সীমিত করেছিলেন। এছাড়াও, তিনি তার শাসনামলে আফগানিস্তানে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। জহির শাহের ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ নীতির বিরুদ্ধে জনগণ অবস্থান নিতে থাকে এবং তা ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হয়। জহির শাহ ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণেঃ
- তিনি পার্লামেন্টের ক্ষমতা সীমিত করেছিলেন।
- তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে তার ব্যক্তিগত অনুগতদের নিয়োগ করেছিলেন।
- তিনি বিরোধী দলগুলিকে দমন করেছিলেন।
- জহির শাহ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে হস্তক্ষেপ করতেন।
জহির শাহের এই ধরণের স্বৈরাচারী মনোভাব জনগণের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল।
রাজ পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব
রাজ পরিবারের অন্তদ্বন্দ্ব আফগান রাজতন্ত্রের পতনের একটি অন্যতম কারণ ছিল। আফগান রাজতন্ত্রে ক্ষমতার উত্তরাধিকারের স্পষ্ট কোনো নিয়ম ছিল না। ক্ষমতায় আরোহনের নিয়মের অস্পষ্টতা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। ক্ষমতা নিয়ে রাজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা এবং দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। একই রাজপরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও জহির শাহের চাচাত ভাই দাউদ খান ছিলেন একজন প্রগতিশীল নেতা। তিনি আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, জহির শাহ ছিলেন একজন রক্ষণশীল নেতা। তিনি আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের ঐতিহ্য বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। এই দুই নেতার মধ্যে মতবিরোধ ক্রমেই চরম আকার ধারণ করে।
স্নায়ু যুদ্ধ কাকে বলে? স্নায়ু যুদ্ধের উদ্ভব, বিকাশ ও বর্তমান অবস্থা
দাউদ খানকে পদত্যাগে বাধ্য করণ
মুহাম্মদ দাউদ খান ছিলেন বাদশাহ মুহাম্মদ জহির শাহের চাচাত ভাই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সেই আদর্শ অনুসারেই তিনি ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করেন। একই সাথে তিনি তিনি রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং শেষের দিকে রাজতন্ত্রের বিরোধীতা করা শুরু করেন। আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের হুমকি হয়ে ওঠায় জহির শাহ তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। দাউদ খান বিতাড়িত হয়ে প্রকাশ্যেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করেন।
বাদশাহের স্বজনপ্রীতি
স্বজনপ্রীতি জহির শাহের বাদশাহী আমলে একটি বড় সমস্যা ছিল। তিনি তার ব্যক্তিগত অনুগতদেরকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন, এমনকি তাদের যোগ্যতা থাকলেও, না থাকলেও। এতে তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের স্বার্থ দেশের স্বার্থের উপরে স্থান পেয়েছিল। নিজ ক্ষমতাকে কন্টকমুক্ত রাখতে স্বজনপ্রীতির ফলে সরকারের কার্যক্রমে অদক্ষতা ও দুর্নীতির সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারের কার্যক্রমে অদক্ষতা ও দুর্নীতি গুলো জনগণের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল যা আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র পতনের জন্য অনেকাংশেই দায়ী ছিল।
উদারনৈতিক অর্থনীতি
উদারনৈতিক অর্থনীতি একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা বাজারের শক্তিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ দেয়। এই ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ সীমিত থাকে। হির শাহের শাসনামলে আফগানিস্তানে উদারনৈতিক অর্থনীতির কিছু সংস্কার চালু করা হয়। এই ব্যবস্থার অধীনে, বিদেশী পণ্য আমদানির উপর শুল্ক কমানো হয় এবং ব্যবসায়ীদের জন্য আরও স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
এই ব্যবস্থার ফলে, বিদেশী পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি পায় এবং স্বদেশী পণ্যের চাহিদা কমে যায়। এর ফলে, দেশীয় কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। এছাড়াও, পাকিস্তান আফগানিস্তান থেকে পণ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে, আফগান ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় বাজার বন্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনাগুলো আফগান ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারা জহির শাহের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন জহির শাহের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনঃ যুক্তফ্রন্টের গঠন, বিজয় ও মুসলিম লীগের পরাজয়
জহির শাহের পররাষ্ট্র নীতি
জহির শাহের পররাষ্ট্র নীতি আফগান রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জহির শাহের শাসনামলে আফগানিস্তান নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করে। এই নীতির ফলে আফগানিস্তান বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশরা এই অঞ্চল ত্যাগ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এই অঞ্চলে প্রবেশ করে। কিন্তু দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে আফগানরা বৃহৎ শক্তিগুলো হতে সুবিধা আদায়ের পরিবর্তে তাদের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে। এবং উভয়ই আফগানিস্তানে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে। এই কারণে আফগানিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে আফগানিস্তানে কমিউনিজমের উত্থান ঘটে।
এই নীতির ফলে, আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করে। তবে, এই নীতি জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করে। অনেক মানুষ মনে করেন যে জহির শাহ আফগানিস্তানের স্বার্থকে বিদেশী শক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এই ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি রাজতন্ত্রের পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল।
রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি
রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি আফগান রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জহির শাহের শাসনামলে আফগানিস্তানে শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি ঘটে। এই উন্নতির ফলে, জনগণ রাজনীতি সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারে এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এই রাজনৈতিক সচেতনতার ফলে, জনগণ রাজতন্ত্রের অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তারা সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য দাবি জানায়।
সাংবিধানিক ত্রুটি
আফগান সংবিধানে বাদশাহ ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বাদশাহ সংসদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতেন এবং তিনি সরকারের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। এছাড়াও, বাদশাহ আইন প্রণয়ন, যুদ্ধ ঘোষণা এবং শান্তি স্থাপন করতে পারতেন। বাদশাহ কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেও, প্রদেশগুলিতে তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে সামগ্রিকভাবে প্রশাসন ও রাজনৈতিক সমস্যার সমূহ বাদশাহের পক্ষে নিয়ন্ত্রন করা অসম্ভব ছিল। এটি প্রশাসন ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার আনয়নের উদ্দেশ্যে জহির খান নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন। নতুন সংবিধানে নারীর অধিকার বৃদ্ধি এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সংক্রান্ত নানাবিধ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও নতুন সংবিধানে করলেও জনগণের দাবি প্রতিফলিত হতে পারেনি। বিশেষ করে, বাদশাহর সেচ্ছাচারীতা নিয়ন্ত্রণে আনা বা রাখার মত কোন নীতিই সংবিধানে প্রতিফলিত হয়নি।
আমাদের কাছে আফগানিস্তানের কী পাওনা?
আইন প্রণয়নে ব্যর্থতা
জনবান্ধব ও কার্যকর আইন প্রণয়নে ব্যর্থতা আফগান রাজতন্ত্রের পতনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। জহির শাহের শাসনামলে, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল এবং ধীরগতির। বাদশাহের সম্মতি ছাড়া কোনও আইন প্রণয়ন করা যেত না। এছাড়া, শাসন ক্ষমতার উপর জহির শাহ এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং দুর্বল ও অযোগ্য প্রশাসন ব্যবস্থার কারণে কারণে, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। জনবান্ধব আইন প্রণয়নে ব্যর্থতা জনগণের মধ্যে রাজতন্ত্রের প্রতি অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।
আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি
জহির শাহের শাসনামলে, আমলাতন্ত্রে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার শাসনামলের শেষ দিকে আফগান আমলাতন্ত্র একেবারে ভেঙে পড়েছিল। আমলারা তাদের ক্ষমতা এবং পদমর্যাদা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জন করত। তারা ঘুষ গ্রহণ করত, অনিয়ম করত এবং জনগণের উপর অত্যাচার করত। জহির শাহের আমলে আমলাতন্ত্রের দুর্নীতির কারণগুলি নিম্নরূপঃ
- ক্ষমতারকেন্দ্রীকরণঃ স্বজনপ্রিয় জহির শাহ তার ব্যক্তিগত অনুগতদেরকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন। এতে আমলারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করার সুযোগ পায়।
- অদক্ষতাঃ আমলাদের বেশিরভাগই ছিল অদক্ষ এবং যোগ্যতাহীন। তারা সরকারের কাজকর্মে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা আনতে পারেনি।
- দরিদ্রতাঃ বেশিরভাগ আমলারা ছিল দরিদ্র। তারা তাদের বেতন দিয়ে নিজেদের জীবনধারণ করতে পারেনি। তাই তারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করত।
আমলাতন্ত্রের দুর্নীতির ফলে সরকারের কার্যকারিতা হ্রাস পেলে আফগানিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। তারা মনে করেছিল যে রাজতন্ত্র দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের কারণে দেশকে পরিচালনা করতে পারছে না। এই ক্ষোভ রাজতন্ত্রের পতনের অন্যতম একটি কারণ ছিল।
নির্বাচন সংক্রান্ত ত্রুটি
শাসনতন্ত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন পদ্ধতি না থাকায় জহির শাহের শাসনামলে, নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতি ও জালিয়াতি ছিল। ধনী ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা তাদের প্রভাব ব্যবহার করে নির্বাচনে জয়লাভ করত। অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা সংসদে নির্বাচিত হতো। কিছু লোক পেশি শক্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ প্রভৃতির কারণে বা বিনিময়ে জনগণকে নিয়ন্ত্রণে এনে ‘লয়া জিগারা’ বা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে স্থান করে নিত। ফলে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হওয়া অযোগ্য ও ধনী ব্যক্তিরা রাজতন্ত্রের ভিত্তিকে আরও দুর্বল করে দেয়।
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার আফগান রাজতন্ত্রের পতনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। জহির শাহ নিজেই ফ্রান্স থেকে পশ্চিমা শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে এসে আফগান শাসনে নামেন। এছাড়া, জহির শাহের শাসনামলে, আফগানিস্তানে একটি নতুন প্রজন্মের জন্ম হয়েছিল, যারা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল। এই প্রজন্মটি রাজতন্ত্রের পুরনো ধ্যান-ধারণাকে ছুড়ে ফেলে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক আফগানিস্তান গঠনের স্বপ্ন দেখত। তার শাসনামলে আফগান ছাত্র বিদেশে শিক্ষা লাভ করে পাশ্চাত্য ভাবধারা রপ্ত করে এবং দেশে এসে প্রগতিশীল আদর্শ ছড়িয়ে দিতে থাকে। এই চেষ্টা জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল।
সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন
আফগান সমাজ ব্যবস্থা ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক। আফগানিস্তানকে আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা হিসেবে জহির শাহের শাসনামলে, আফগানিস্তানে সামন্ত ব্যবস্থা রহিত করা হয়। পূর্ব প্রচলিত সামন্ত ব্যবস্থা রহিত হলেও কৃষকরা গোত্রনেতা বা বাদশাহর অধীনে চলে আসে। কৃষকরা আপাতঃ দৃষ্টিতে কৃষকরা স্বাধীনভাবে জমি চাষ করার অধিকার পেলেও এই অধিকারটি পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। কৃষকরা এখানেও দাসত্বের মতো অবস্থায় ছিল। কৃষকরা বাদশাহকে বা গোত্রনেতাদেরকে কর দিতে বাধ্য ছিল। এছাড়াও, কৃষকদের প্রায়ই জোরপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য করা হত। ফলে কৃষকরা সমাজব্যবস্থার তথা রাজতন্ত্রের পরিবর্তন কামনা করতে থাকে।
রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা
জহির শাহের শাসনামলে আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র পতনে তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা ছিল ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময়। প্রজাতন্ত্রপন্থী দলগুলোর মধ্যে ছিল মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ওয়ার্কার্স পার্টি অফ আফগানিস্তান (ন্যাপ), সমাজবাদী দল পপুলার ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (এনডিপিএ) ইত্যাদি। এই দলগুলো রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করেছিল।
এছাড়া, জহির শাহের শাসনামলে বেশ কয়েকটি ইসলামি দলও গড়ে ওঠে। এই দলগুলো ইসলামী আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দলগুলো হল: জামায়াত-ই-ইসলামি (জেইআই), হেযবুত-উল-ইসলাম (হুই), ইসলামি উম্মাহ পার্টি (আইইউপি) ইত্যাদি। এই দলগুলো আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রকে ইসলাম বিরোধী হিসেবে দেখত। তারা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাত এবং ইসলামী বিপ্লব ঘটানোর জন্য কাজ করত।
এই রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্নভাবে আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র পতনে তৎপর ছিল। কিছু দল গোপনে প্রচারণা চালিয়েছিল, অন্যরা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এই তৎপরতাকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:
- অভ্যন্তরীণতৎপরতাঃ এই তৎপরতায় আফগানিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং গোষ্ঠী জড়িত ছিল। তারা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা, রাজতন্ত্রের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরা এবং রাজতন্ত্রকে উৎখাত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। এবং দলগুলো এমন তৎপরতায় সফলতাও পায়।
- বৈদেশিকতৎপরতাঃ এই তৎপরতায় আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কিছু দেশ জড়িত ছিল। তারা আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তৎপরতাকে সমর্থন করে এবং রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতে সহায়তা করে। কিছু দল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিদেশী শক্তির সহায়তায় তৎপরতা চালিয়েছিল। গণতন্ত্রপন্থী দলগুলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের মদদে তৎপরতা চালিয়েছিল। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক দলগুলো তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়িনের সহায়তায় কর্মকান্ড পরিচালনা করছিল। তারা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তৎপরতা পরিচালনাকারী দলগুলোকে অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করত। এছাড়া দেশগুলো তারা জহির শাহকে রাজতন্ত্রের কিছু সংস্কারের জন্য চাপ প্রয়োগ করত।
এই সকল রাজনৈতিক দলের তৎপরতা ও কার্যকলাপ আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতনের কে ত্বরান্বিত করে।
How Sikkim became a part of India?
মৌলভি শ্রেণীর বিরোধিতা
ঐতিহাসিকভাবে আফগানিস্তান ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা করে আসছে। আধুনিকীকরণ নীতি ও সংস্কারের নামে আফগানিস্থানের সংস্কৃতিকে ‘পশ্চিমাকরণমূলক কার্যক্রম’ দেশের মৌলভীরা মেনে নেননি। এছাড়া নারীদের স্বাধীনতার নামে দেশে ইউরোপীয় প্রভাব বৃদ্ধি পেলে এবং চিরাচরিত ধর্মীয় মূল্যবোধ ভূলুন্ঠিত হলে মৌলভি শ্রেণি সোচ্চার হয়ে ওঠে। জহির শাহ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে মৌলভিদের দমনের চেষ্টা চালালে মৌলভিরা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজতন্ত্র পতনের আন্দোলন করতে থাকে।
ছাত্র আন্দোলন
১৯৬০-এর দশকে আফগানিস্তানে ছাত্র আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ছাত্র আন্দোলনের মূল কারণ ছিল রাজতন্ত্রের অদক্ষতা, দুর্নীতি, স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা, শিক্ষার ক্ষেত্রে আধুনিকতার অভাব এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য।
১৯৬৫ সালের পর থেকে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৯৬৯ সালে সেনাবাহিনী কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ করলে বহু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ড ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ১৯৭০ সালে সরকার ছাত্রদের স্বার্থপর পন্থী আইন পাস করে এবং রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। এই আইন ছাত্রদের মধ্যে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ছাত্রদের বিক্ষোভের ফলে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে।
সেনাবাহিনীর ভূমিকা
আফগান রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। জহির শাহের শাসনামলে আফগানিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সাথেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সহায়তা প্রদান করে। এই সহায়তার ফলে আফগান সেনাবাহিনীতে সোভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধি পায়। অনেক আফগান সেনা কর্মকর্তা সোভিয়েতপন্থী হয়ে ওঠেন। তারা জহির শাহের নিরপেক্ষ নীতির সমালোচনা করেন। তাছাড়া, সেনাবাহিনীর সৈন্যরা বিভিন্ন গোত্র ও অঞ্চলের হওয়ায় তাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল মারাত্মক। জহির শাহ এই সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, কিন্তু সেগুলো সফল হয়নি। দাউদ খানের প্ররোচনায় রাজতন্ত্রের শেষ দিকে সেনাবাহিনী রাজতন্ত্র বিরোধীদের সাথে আঁতাত করে।
ডুরান্ড লাইন
১৮৯৩ সালে আমির আব্দুর রহমানের সময় ডুরান্ড লাইনের মাধ্যমে আফগান ও ব্রিটিশ ভারতের সীমানা নির্ধারিত হয়। এই সীমানাটি আফগানিস্তানের পাঠান অধ্যুষিত অঞ্চলকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। এই লাইনটি আফগানিস্তানের পাঠান জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে। আফগানিস্তানের উত্তর-পশ্চিমে বসবাসকারী পাঠানরা এই লাইনকে একটি কৃত্রিম সীমানা বলে মনে করে। তারা এই লাইনের পূর্বদিকের অঞ্চলগুলোকে আফগানিস্তানের অংশ বলে দাবি করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভেঙে পাকিস্তান ও ভারত গঠিত হলে ডুরান্ড লাইন পাকিস্তানের সীমানা হিসেবে মেনে নিলেও আফগানিস্তান এই লাইনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা পাকিস্তান থেকে ডুরান্ড লাইনের পূর্বদিকের অঞ্চলগুলোকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি করে। পাকিস্তান এই দাবি অস্বীকার করলে এই অঞ্চলের পাঠানরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই কারণে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক শীতল হয়ে যায়। পাকিস্তান আফগানিস্তানের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপে আফগানিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। আফগান পাঠানরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। যার ফলে আফগানিস্তানের অর্থনীতির সাথে সাথে রাজতন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়ে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ইমাম খোমেনীর ভূমিকা
সমাজতন্ত্রের প্রভাব
সমাজতন্ত্রের প্রভাব আফগান রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর থেকে আফগানিস্তানে সমাজতন্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটে। আমানুল্লাহ খানের সংস্কারের ফলে ১৯১৯ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে যে এলিট শ্রেণী গড়ে ওঠে তারা অধিকাংশই কমিউনিজমে বিশ্বাসী ছিল। ১৯৫১ সালের পর থেকে নূর মোহাম্মদ তারাকি ও তার অনুসারীরা মার্কসবাদী দর্শন প্রচার করতে থাকে। তারাকি ও তার অনুসারীরা আফগানিস্তানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। তারা আফগানিস্তানে একটি শ্রমিক শ্রেণী গঠনের জন্য কাজ করে। তারা আফগানিস্তানে একটি কমিউনিস্ট দল গঠন করে। মৌলভি শ্রেণীর বাধা শিকার হলেও একসময় সমাজতান্ত্রিকরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এক সময় সারা দেশব্যাপী তাদের প্রচারণা রাজতন্ত্র পতনে অবদান রাখে।
আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র পতনে দাউদ খানের ভূমিকা
দাউদ খানের ভূমিকা আফগান রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৩ সালে জহির শাহের সাথে মতানৈক্যের ফলে দাউদ খান পদচ্যুত হন। এই পদচ্যুতির পর তিনি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পোষণ করতে থাকেন। তিনি বিভিন্ন রাজতন্ত্র বিরোধী সংগঠনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। কাবুল শহরের মাঝখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করে সেখানে তিনি রাজতন্ত্র বিরোধীদের সাথে সাক্ষাৎ ও পরামর্শ চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৯৭০ সালের ১৭ জুলাই বাদশা জহির শাহ ইতালি গমন করার সুযোগে দাউদ খান ৬৫ জন সামরিক অফিসার, ২৪০ জন সৈন্য ও বিমানবাহিনীর সহায়তায় রাজপ্রাসা্ বেতার ভবন ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল করে নেন। রাজতন্ত্রপন্থীদের বন্দী করা হয়। এভাবে বিনা রক্তপাতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে দাউদ খান ক্ষমতা বদল করেন এবং প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। দাউদ খান আফগানিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন।
আফগানিস্তানের দীর্ঘ ইতিহাসে রাজনৈতিক দিক থেকে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী যেমন আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল তেমনি, সময়ের প্রয়োজনেই আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের পতন এবং প্রজাতন্ত্রের উত্থান সংঘটিত হয়। আফগানিস্তানের এই নতুন প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দাউদ খান নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। যদিও তিনি আফগানিস্তনের ভাগ্যাকাশে এক বিপদকে সরাতে নতুন বিপদ ডেকে এনেছেন কিনা সেটা অন্য এক আলোচনায় জানা যাবে।