বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিওতে হাসিনা স্বয়ং নিরাপত্তা বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত মার্চ মাসে অনলাইনে ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপের অডিও রেকর্ডিং বিবিসি কর্তৃক যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া গেছে। হয়েছে।
গত বছরের জুলাইয়ে চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল প্রতিবাদ। কিন্তু এই আন্দোলন দ্রুত সরকারবিরোধী রূপ নেয়। ফলে দেশজুড়ে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘের তদন্ত অনুসারে, এই সংঘর্ষে প্রায় ১,৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষ করে, ৫ অগাস্ট ২০২৪-এ ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে ৫২ জন আন্দোলনকারী নিহত হন।
শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিওতে কী বলেছেন?
বিবিসির অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৮ জুলাই ২০২৪ তারিখে ঢাকা শহরের গণভবনে অবস্থান করছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সময় তার একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। ফোনালাপের সময় দেশের বিক্ষোভ পরিস্থিতি তীব্র ছিল। পুলিশি গুলিতে নিহত বিক্ষোভকারীদের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়েছিল। ফোনালাপের কয়েক দিনের মধ্যে, পুলিশি নথি অনুযায়ী, ঢাকা শহরে সেনাবাহিনীর অস্ত্র মোতায়েন করা হয় এবং তা ব্যবহার করা হয়। এই তথ্য বিবিসি পেয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের নথি থেকে।
ফোনালাপটি বাংলাদেশের ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (NTMC) দ্বারা রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও প্রকাশ্যে আসে, তবে এটি কার দ্বারা ফাঁস হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। এরপর থেকে শেখ হাসিনার ফোনালাপের অনেক ক্লিপ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু তার অধিকাংশই যাচাই-বাছাই হয়নি।
শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিংয়ে হাসিনাকে বলতে শোনা যাচ্ছে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে “মারণাস্ত্র ব্যবহারের” অনুমোদন দিয়েছেন এবং “যেখানে পাবে সেখানেই গুলি করবে” বলে নির্দেশ দিয়েছেন। ১৮ জুলাই ২০২৪ তারিখে গণভবন থেকে এক অজ্ঞাত সরকারি কর্মকর্তার সাথে এই ফোনালাপ হয়েছিল।
অডিও যাচাইকরণ প্রক্রিয়া
বিবিসি তাদের নিজস্ব তদন্তে শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান ইয়ারশট (Earshot) এর সাহায্য নিয়েছে। তারা বলেছে, রেকর্ডিংয়ে কোনো সম্পাদনা বা কৃত্রিম পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়া, রেকর্ডিংটি সম্ভবত একটি ঘরে ফোনের স্পিকার থেকে প্লেব্যাকের সময় নেওয়া হয়েছে, কারণ এতে টেলিফোনিক ফ্রিকোয়েন্সি ও পটভূমির শব্দ পাওয়া গেছে।
ইয়ারশটের বিশ্লেষণে শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরের লয়, স্বরস্বর এবং শ্বাসের শব্দ সবই প্রাকৃতিক এবং কোনো কৃত্রিম সৃষ্টি নয়। তারা বলেছে, শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও ব্যাকগ্রাউন্ডে পাওয়া ইলেকট্রিক নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি (ENF) প্রমাণ করে এটি কোনোভাবেই ম্যানিপুলেটেড নয়।
বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) এই ১৮ জুলাইয়ের রেকর্ডিংয়ের কণ্ঠস্বর শেখ হাসিনার সঙ্গে মিলিয়ে নিশ্চিত করেছে।
আওয়ামী লীগের মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, তারা শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিংয়ের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেননি। আওয়ামী লীগ দাবি করেছে যে, তাদের নেতারা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের জন্য দায়ী নন। দলের মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা স্পষ্টভাবে অস্বীকার করি যে, প্রধানমন্ত্রীসহ কোনো সিনিয়র নেতা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারী কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত ছিল আনুপাতিক এবং জীবন রক্ষায় নিবেদিত।”
বিবিসি আইয়ের প্রতিবেদন যাত্রাবাড়ী গণহত্যার চিত্র
বিবিসি আই ৩৬ দিনের বিক্ষোভের সময় পুলিশি হামলার শত শত ভিডিও, ছবি ও নথি বিশ্লেষণ ও যাচাই করেছে, যা বিক্ষোভ দমন অভিযানের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেছে।
যদিও শুরুতে জানা গিয়েছিল যাত্রাবাড়ী গণহত্যায় ৩০ জনকে হত্যা করা হয়। বিবিসি আইয়ের তদন্তে নতুন তথ্য উঠে এসেছে যাত্রাবাড়ী গণহত্যার শুরু ও শেষের বিষয়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভিডিও, সিসিটিভি ফুটেজ এবং ড্রোনের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেনাবাহিনী পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার পরই পুলিশ নির্বিচারভাবে গুলি চালাতে শুরু করে। বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশনের প্রতিবেদনে ৫ আগস্ট ২০২৪, একদিনেই পুলিশি হত্যাকাণ্ডে যাত্রাবাড়ী এলাকায় ৫২ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন।
৩০ মিনিট ধরে পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে
সিসিটিভি ও ড্রোন ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সেনাবাহিনীর চলে যাওয়ার পর পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালায়। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে, পুলিশ পালিয়ে যাওয়া আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ চালায়।
আন্দোলনকারীরা গলিঘুটিতে এবং হাইওয়ের দিকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। পরে পুলিশ কর্মকর্তারা আশ্রয় নেন নিকটবর্তী একটি সেনা ক্যাম্পে। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর, বিক্ষোভকারীরা প্রতিবাদের স্বরূপ যাত্রাবাড়ী থানা আগুনে ভস্মীভূত করে। এই উত্তেজনায় কমপক্ষে ছয়জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা
জাতিসংঘের তদন্তকারীদের মতে, জুলাই-আগস্ট ২০২ৄ সালের বিক্ষোভের সময় ১,৪০০ জন পর্যন্ত মানুষ নিহত হয়েছেন। এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সহিংসতা। প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে, কিন্তু পরবর্তীতে তা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনে রূপ নেয়।
গত মাসে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই বিচার পরিচালনা শুরু করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি গণহত্যা, সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে লক্ষ্যভিত্তিক সহিংসতা, উস্কানি, ষড়যন্ত্র এবং গণহত্যা রোধে ব্যর্থতার মতো গুরুতর অপরাধ করেছেন। আদালত অবমাননার দায়ে জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT) শেখ হাসিনাকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিংকে মূল প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছেন।
হাসিনার বর্তমান অবস্থান
৫ আগস্ট ২০২৪ সালে আন্দোলনকারীরা গণভবন দখল করার পর হাসিনা হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান। হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার কূটনৈতিক ভিসা বাতিল করেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানো হলেও, এখন পর্যন্ত ভারত তা বাস্তবায়নে রাজি হয়নি। ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান জানিয়েছেন, হাসিনা সম্ভবত দেশে ফিরে বিচার সম্মুখীন হবেন না।

বাংলাদেশের বর্তমান সরকার নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী বছর জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জনগণের ‘না’ বোধক সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মনে হচ্ছে।