বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসন পতনের পর থেকে ভারতীয় প্রশাসন ও তাদের গণমাধ্যম এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় খেঁটে যাচ্ছে। হাসিনাকে দীর্ঘদিন ধরে তাদের কৌশলগত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এই পতনের প্রতিক্রিয়ায় তারা গুজব ও প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে “হিন্দু নিপীড়নের” একটি গল্প তৈরিতে ব্যস্ত। হাসিনার পতনের পর, তার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের সাথে জড়িত নির্যাতকদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ জনগণ বিদ্রোহ শুরু করে, যেখানে কিছু নির্যাতিত ব্যক্তি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও ভারতীয় গণমাধ্যম তাদের রাজনৈতিক পরিচয় উপেক্ষা করে কেবল সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হিসেবে চিত্রিত করছে। এই পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদনগুলো সংখ্যালঘু নিপীড়নের বিষয়টি তুলে ধরে পশ্চিমাদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং যুক্তরাজ্যের চরমপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলো এই প্রোপাগান্ডাকে আরও উসকে দিচ্ছে, বিক্ষোভ ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে পশ্চিমা দেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, যেমন ভয়েস অব আমেরিকা, জানিয়েছে যে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে বাংলাদেশের হিন্দুরা আগের চেয়ে অনেক নিরাপদ ও আত্মবিশ্বাসী। শুরু থেকেই এই প্রশাসন সকল সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের এই মিথ্যাচারই মূল সমস্যা, যা বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় ভয় ও উত্তেজনা ছড়াচ্ছে।

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় হিন্দু মৌলবাদী নেতা চিন্ময় দাসের গ্রেফতার পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তোলে। আওয়ামী লীগের কর্মী ও উগ্রপন্থীরা চট্টগ্রামে এক মুসলিম আইনজীবীকে হত্যার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে, যা স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে করা হয়। তবে আইনজীবীর শোকাহত পিতা সংযমের আহ্বান জানান, এবং হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় পরিণতিপূর্ণ আচরণ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখে।

চার মাস ধরে ভারতীয় গণমাধ্যমের ধারাবাহিক আক্রমণের মুখে ঢাকার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তাদের ক্যাম্পাস গেটে মেঝেতে ভারতীয় পতাকা আঁকিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ জানায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা শুরু করে, আর কলকাতায় সহিংস বিক্ষোভ হয় যেখানে বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো হয় এবং আগরতলায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আক্রমণ চালানো হয়।

বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়নের মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য ভারতীয় সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো ভুয়া খবর ও বিকৃত ছবি প্রচার করছে। ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে মুসলিমদের উস্কে দেওয়া এবং হিন্দুদের উপর আক্রমণ ঘটানোর চেষ্টা করছে। প্রো-হাসিনা হিন্দুদের প্রায়শই ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে ভারতীয় গণমাধ্যম এই ঘটনাগুলোকে চাঞ্চল্যকর করে উপস্থাপন করতে পারে।

বাংলাদেশে হাসিনা সরকার টিকিয়ে রাখতে ভারতের এত বিনিয়োগের প্রতিফলনই তাদের এই হতাশা। আঞ্চলিক আধিপত্যের ভ্রান্ত ধারণা ভারতকে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। বাংলাদেশ তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে রয়ে গিয়েছিল, যা ৫ আগস্ট হাসিনার শাসন পতনের পর পাল্টে যায়। ভারতীয় গণমাধ্যমের অস্থির প্রতিবেদন এখন “দ্বিমুখী সাংবাদিকতার” একটি ধারা প্রদর্শন করছে—চাঞ্চল্যকর, কিন্তু বাস্তবতার থেকে বিচ্যুত।

মুসকান খানের হিজাব ও ভারতের অসাম্প্রদায়িকতা

নিজ দেশে ভারত বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে চরমপন্থী হিন্দু এজেন্ডার সঙ্গে লড়াই করছে। মুঘল যুগের মসজিদগুলোর নিচে মন্দির থাকার দাবির মতো অযৌক্তিক দাবিগুলোকেও বিচার বিভাগ সমর্থন করছে। উদাহরণস্বরূপ, ঐতিহাসিক আজমির শরিফ দরগাহকে প্রাক-ইসলামী যুগের মন্দির হিসেবে দেখার চেষ্টা চলছে। এই মন্দির পুনরুদ্ধারের মোহ সহিংসতা ও ইসলামোফোবিয়াকে তীব্র করেছে। যখন ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে নাক গলাতে ব্যস্ত, ভারতে তখন চারজন মুসলিম যুবককে হিন্দু চরমপন্থীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে। ধর্মীয় কারণে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করার পরেও বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গরুর মাংস রপ্তানিকারক হওয়ার এই দ্বিচারিতা ভারতের চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে মৌলবাদ নিয়ে ভারতের অভিযোগগুলো ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়। হাসিনা শাসনে বিভক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে উসকে দেওয়া হয়েছিল ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য, যেখানে মুসলিম ও হিন্দু উভয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীকে ভারতীয় প্রোপাগান্ডা প্রমাণে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তার বিদায় আরো ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের রূপ দেখিয়েছে, যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায় উগ্রপন্থাকে প্রত্যাখ্যান করছে।

Secular India and the Nature of its so-called Secularism

মৌলবাদ বিরোধী শক্তি হিসেবে হাসিনার মিথ ভেঙে পড়েছে। এখন হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার দাবিতে একতাবদ্ধ। ফলে, বাংলাদেশকে একটি অনানুষ্ঠানিক উপনিবেশ হিসেবে ধরে রাখার ভারতের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। আপাতত, ভারতের হতাশা তাদের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বক্তৃতায় প্রকাশ পাচ্ছে।

ঔপনিবেশিক আচরণে নয়, বরং, ভবিষ্যতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সম্মান ও সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা আবশ্যক।  কেবল তখনই এই দুই প্রতিবেশী প্রকৃত সমতার ভিত্তিতে উন্নতি করতে পারবে।

মূল লেখাঃ মাসকওয়াইথ আহসান

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক রাজনীতি রাকিবুল ইসলামের বিশেষ আগ্রহের বিষয়। তাঁর লেখালেখির মূল বিষয়বস্তু হলো রাজনীতি, সরকার, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • বিবিসির প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিওতে হাসিনা স্বয়ং নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

বিবিসির তদন্তে শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও: ‘যেখানে পাবে সেখানেই গুলি করো’

বিবিসির প্রতিবেদনে প্রমান মিলেছে যে, শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিওতে হাসিনা স্বয়ং নিরাপত্তা বাহিনীকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

  • কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল? আন্তর্জাতিক বিচারের হাত থেকে বাঁচতে, গাজার নিপীড়ন থেকে দৃষ্টি সরাতে ও ইহুদি আধিপত্য জাহিরের হতাশাজনক প্রচেষ্টা।

কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল তার প্রকৃত কারণ

কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেছিল? আন্তর্জাতিক বিচারের হাত থেকে বাঁচতে, গাজার নিপীড়ন থেকে দৃষ্টি সরাতে ও ইহুদি আধিপত্য জাহিরের হতাশাজনক প্রচেষ্টা।

  • গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।

সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রেরঃ নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা

গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।

  • গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ

গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।

  • পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা: তুরস্কের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ, নাকি কুর্দিদের জন্য অধিকার হারানোর নতুন ঝুঁকি?

পিকেকে-র বিলুপ্তি: তুরস্কের জন্য সুযোগ নাকি কুর্দিদের জন্য নতুন সংকট?

পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা: তুরস্কের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ, নাকি কুর্দিদের জন্য অধিকার হারানোর নতুন ঝুঁকি?