দীর্ঘ ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর, অবশেষে ইসরায়েল ও হামাস গাজায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। কাতারের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় দোহায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চুক্তির ফলে ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধঃ ৭ অক্টোবর
১৯৪৮ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে শত শত নারী-শিশু নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কিংবা দখলদার ইসরায়েলিদের হাতে বিনা বিচারে আটক রয়েছেন। তারই প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ১২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। এরপর থেকে গাজায় ইসরায়েল ব্যাপক হামলা চালানো শুরু করে।
গত ১৫ ই জানুয়ারি পর্যন্ত এসব হামলায় গাজায় ৪৬ হাজার ৭০৭ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ১০৯৬৬০ জনেরও বেশী আহত এবং ১১১৬০ জনেরও বেশি নিখোঁজ হয়েছেন। পশ্চিম তীরে ৮৫২ জন নিহত হয়েছেন যাদের মধ্যে ১৭৫ জন শিশু রয়েছেন। এছাড়া ৬৭০০ জন আহত হয়েছেন। ইউনিসেফের মতে, অন্ততপক্ষে ১৪ হাজার পাঁচশ শিশু মারা গেছে, কয়েক হাজার আহত হয়েছে, ১৭ হাজার তাদের পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন, ১০ লাখ গৃহচ্যূত হয়েছে।”
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় অফিস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ফিলিস্তিনি সরকারের জানুয়ারি ১৫ তারিখের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় প্রায় সব বসতবাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮০ শতাংশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮৮ শতাংশ স্কুল ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রেও বড় আঘাত এসেছে, যেখানে ৫০ শতাংশ হাসপাতাল আংশিক কার্যকর অবস্থায় রয়েছে। ৬৮ শতাংশ সড়ক নেটওয়ার্ক ধ্বংস হয়েছে এবং একই পরিমাণ কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০২৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত গাজা যুদ্ধে ২০০ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সাংবাদিক সুরক্ষা কমিটির তথ্য অনুযায়ী, চলমান এই সংঘর্ষে অন্তত ২১৭ জন ফিলিস্তিনি, তিনজন লেবানিজ এবং দুইজন ইসরায়েলি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
গাজায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তির শর্তাবলী
গাজায় যুদ্ধ বিরতির খবর জানার পর গাজায় ফিলিস্তিনিদের অনেককে রাস্তায় উল্লাস করতে দেখা গেছে। এই চুক্তির ফলে গাজা শহর এবং দক্ষিণ গাজা থেকে লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা এখন তাদের নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে পারবেন। আগামী ১৯ জানুয়ারি, রোববার থেকে এই চুক্তি কার্যকর হওয়ার কথা চুক্তিটি তিনটি পর্যায়ে বাস্তবায়িত হবে:
প্রথম পর্যায় (৬ সপ্তাহ)ঃ
- ইসরায়েল গাজার ভেতরে ৭০০ মিটার পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার করবে।
- হামাস ৩৩ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে।
- ইসরায়েল ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে, যার মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত।
- রাফাহ সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক ত্রাণ ও চিকিৎসা সামগ্রী প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।
- গাজার হাসপাতালগুলো সচল রাখতে ৫০টি জ্বালানী ভর্তি লরি পাঠানো হবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ
- হামাস বাকি জীবিত ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দেবে।
- ইসরায়েল গাজা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার শুরু করবে।
তৃতীয় পর্যায়ঃ
- বাকি বন্দিদের দেহ হস্তান্তর করা হবে।
- আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে তিন থেকে পাঁচ বছরের পুনর্গঠন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।
গাজায় যুদ্ধ বিরতির পর গাজার প্রশাসন কে চালাবে সে বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংস্কারকৃত প্যালেস্টাইনিয়ান অথরিটিকে এই দায়িত্ব দেওয়ার পক্ষে।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান আল থানি বলেছেন, ”ইসরায়েল ও হামাস দুই পক্ষই গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং কিছু বন্দিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে।” আল থানি বলেছেন, ”চুক্তির আগে গাজায় শান্তি বহাল রাখতে হবে। তিনটি মধ্যস্থতাকারী দেশ চুক্তি রূপায়ণের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।”
চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, “এই যুদ্ধ বিরতি চুক্তি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র নভেম্বরের ঐতিহাসিক বিজয়ের কারণে”। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, ”আমি গত মে মাসে চুক্তির যে কাঠামোর কথা বলেছিলাম, সেই কাঠামো অনুযায়ী চুক্তি হয়েছে।” বাইডেনের দাবি, ”এই চুক্তি শুধুমাত্র হামাসের উপর অসম্ভব চাপ বা লেবাননে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল এবং ইরানের দুর্বল হয়ে পড়ার জন্য হয়নি, এর পিছনে অ্যামেরিকার কূটনীতিকদের কষ্টকর প্রয়াসও রয়েছে।” তিনি বলেছেন, ”আমার কূটনীতিকরা কখনই তাদের প্রয়াস থেকে সরে আসেননি।” ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল আন্তেনিও গুতেরেস বলেছেন, ”গাজায় অবিলম্বে মানবিক ত্রাণ শুরু করতে হবে।যুদ্ধ বিরতি শুরু হওয়ার পরই রাজনৈতিক ও সামরিক বাধা চলে যাবে, ফলে আমরাও গাজার মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারব।”
ইউনিসেফ বলেছে, ”এই চুক্তি অনেকদিন ধরে বকেয়া ছিল। এই যুদ্ধের ফলে গাজার শিশুদের অবস্থা শোচনীয় হয়েছে। অন্ততপক্ষে ১৪ হাজার পাঁচশ শিশু মারা গেছে, কয়েক হাজার আহত হয়েছে, ১৭ হাজার তাদের পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন, ১০ লাখ গৃহচ্যূত হয়েছে।””
গাজায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও স্থায়িত্ব নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে, তবুও এটি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই চুক্তির সফল বাস্তবায়নের জন্য উভয় পক্ষকে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।
গাজায় যুদ্ধবিরতিঃ সহিংসতার সাময়িক বিরতি নাকি স্থায়ী শান্তির পথ?
যুগ যুগ ধরে সংঘাত চলমান গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এক গভীর প্রশ্ন উঠে আসে: এটি কি সহিংসতার একটি সাময়িক বিরতি, নাকি একটি স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা?
গাজা যুদ্ধ বিরতি চুক্তিঃ ইসরায়েল ও হামাসের ঐতিহাসিক সমঝোতা
দীর্ঘ ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর, অবশেষে ইসরায়েল ও হামাস গাজায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। কাতারের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় দোহায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।