মামলায় সাক্ষ্য ও সাক্ষী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি মামলার মীমাংসা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে হয়। তাই, সাক্ষ্য ও সাক্ষী সম্পর্কে প্রত্যেকেরই সঠিক ধারণা থাকা উচিত।চাইলেই সবাই সাক্ষ্য দিতে পারে না। যার সাক্ষ্য দেয়ার যোগ্যতা আছে কেবল তিনিই সাক্ষ্য দিতে পারেন। সাক্ষ্য প্রদান করার এই যোগ্যতা আইনের মাধ্যমে সুস্পষ্ট করে বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ১১৮ ধারায় সুস্পষ্ট করে বলা আছে কে সাক্ষ্য দিতে পারে এবং কিসের ভিত্তিতে তারা সাক্ষ্য দিতে পারবে। আজকের আলোচনায় আমরা জানার চেষ্টা করব কে সাক্ষ্য দিতে পারে।
সাক্ষী কাকে বলে?
সাক্ষী শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ সাক্ষ্য থেকে। সাক্ষী শব্দের আভিধানিক অর্থ হল “দর্শক”, “দর্শী”, “প্রত্যক্ষদর্শী”, “অভিজ্ঞ ব্যক্তি”, “যার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়”। মূলত, সাক্ষী বলতে সেই ব্যক্তিকে বোঝায় যে, কোনো ঘটনা বা কার্যকলাপের প্রত্যক্ষদর্শী এবং আদালতে তা সম্পর্কে বর্ণনা দিতে সক্ষম। সাক্ষী হতে হলে তাকে অবশ্যই ঘটনা বা কার্যকলাপের প্রত্যক্ষদর্শী হতে হবে। অর্থাৎ, সে ঘটনা বা কার্যকলাপটি নিজের চোখে দেখে, শুনে, বা অনুভব করে থাকতে হবে।
জেরেমি বেন্থেমের মতে, একজন সাক্ষী হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক কিছু পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছেন এবং তার পর্যবেক্ষণ অন্যদের কাছে জানাতে সক্ষম হয়েছেন। আবার, উইলিয়াম ব্লাকস্টোনের মতে, একজন সাক্ষী হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি ঘটনা ঘটার সময় উপস্থিত থাকার কারণে আদালতের আদেশে সেসব বর্ণনা করার জন্য হাজির হন। অর্থাৎ, কোনো ঘটনা বা তথ্য সম্পর্কে আদালতে যিনি বক্তব্য দেন তাকেই সাক্ষী বলা হয়। সাক্ষীর বক্তব্যকে সাক্ষ্য বলা হয়।
কে সাক্ষ্য দিতে পারে?
সাধারণত, যেকোনো বয়সী, জ্ঞানসম্পন্ন, এবং ঘটনা বা কার্যকলাপের প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তি সাক্ষ্য দিতে পারে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে সাক্ষ্য প্রদানের যোগ্যতা সুস্পষ্ট করা হয়েছে। যেমন, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১১৮ ধারায় সাক্ষীর যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। কে সাক্ষ্য দিতে পারেন সে প্রশ্নে বলা হয়েছে যে, সকল ব্যক্তিই সাক্ষ্য দিতে পারবেন যদি না আদালত বিবেচনা করেন যে তারা তাদের অপ্রাপ্ত বয়স, চরম বার্ধক্য, শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা, অথবা এধরনের অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন প্রশ্নগুলি বুঝতে বা এই প্রশ্নগুলির যৌক্তিক উত্তর দিতে সক্ষম নন। অর্থ্যাৎ, জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন বুঝতে ও যুক্তিসংগত উত্তর দিতে সক্ষম যে কোন ব্যক্তি সাক্ষ্য দিতে পারে।
সাক্ষ্য কাকে বলে? সাক্ষ্য কত প্রকার ও কি কি?
সাধারণত অল্প বয়স্ক শিশু, অতিবৃদ্ধ, দৈহিক বা মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি, মাতাল বা পাগল ব্যক্তি সাক্ষী হিসেবে অযোগ্য হলেও যদি তারা জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর প্রদান করতে পারেন তবে তারা যোগ্য সাক্ষী হিসেবে বিবেচিত হবেন। উদাহরণস্বরূপ এস.আর. চৌধুরী বনাম সরকার (১৯৮৫)মামলা আলোচনা করা যায়। এই মামলায় এস.আর. চৌধুরী একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি একটি দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আদালত তাকে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করে। কারণ, তিনি ছিলেন একজন অতিবৃদ্ধ ব্যক্তি। আবার, স্টেট বনাম স্মিথ (১৯৮৯) মামলায় বলা হয়েছে, একটি পাঁচ বছরের শিশুও যদি সত্য মিথ্যার তফাৎ বুঝতে পারে তাহলে সে যৌন নির্যাতনমূলক মামলায় সাক্ষ্য দিতে পারে।
আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এস.আর. চৌধুরী আপিল করেন। আপিল বিভাগ তার আপিল মঞ্জুর করে। আদালত রায় দেন যে, এস.আর. চৌধুরী যদি জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর প্রদান করতে পারেন, তাহলে তিনি সাক্ষ্য দিতে পারেন।
সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ অনুযায়ী নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ সাক্ষ্য দিতে পারবেন। যথাঃ
বোবা সাক্ষী (Dumb Witness)
সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ১১৯ ধারা অনুযায়ী, যিনি কথা বলতে অক্ষম, তিনি যদি অন্য যে কোনও উপায়ে যেমন প্রকাশ্য আদালতে লেখার মাধ্যমে বা চিহ্নের মাধ্যমে তার বক্তব্য বা সাক্ষ্যকে বোধগম্য করতে পারেন, তাহলে একজন বোবা সাক্ষ্য দিতে পারেন। তবে এভাবে প্রদত্ত সাক্ষ্য মৌখিক সাক্ষ্য হিসাবে বিবেচিত হবে।
স্বামী বা স্ত্রী (Husband or Wife)
সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ১২০ ধারা অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে একে অন্যের বিরুদ্ধে অথবা তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে যেকোন মামলায় ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী উপযুক্ত সাক্ষী হবেন। তবে, ১২২ ধারায় স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষ্য প্রদানের শর্ত হিসেবে বলা আছে, স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের মামলায় বিবাহ চলাকালীন যোগাযোগ, হোক সেটা পত্রালাপ, বা ই মেইল, প্রকাশ করা যাবে। কিন্তু, তৃতীয় পক্ষের মামলায় স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ চলাকালীন যোগাযোগ, হোক সেটা পত্রালাপ, বা ই মেইল, জোরপূর্বক বা তাদের পূর্বানুমতি ছাড়া প্রকাশ করা যাবে না।
অপকর্মের সহযোগী (Accomplice)
সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ১৩৩ ধারা অনুযায়ী, অপকর্মের সহযোগী ব্যক্তি একই মামলায় অপর অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষী হবেন। অর্থাত, অপকর্মের একজন সহযোগী তার অপর সহযোগীর বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারেন।
আসামী (Accused)
ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৩৪০ ধারাতে বলা আছে, কোন ফৌজদারি মামলার আসামীও সাক্ষী হতে পারেন। কোন ফৌজদারি মামলায় আসামী চাইলে আত্মপক্ষ সমর্থণ করে অথবা সহযোগী অন্যান্য আসামীর পক্ষেও সাক্ষ্য দিতে পারেন।
‘কে সাক্ষ্য দিতে পারে’ এই আলোচনা শেষে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আদালতের প্রশ্ন বুঝতে পারে এবং সেই প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে পারে যে কেউ সাক্ষ্য দিতে পারেন। সেই ব্যক্তি একজন শিশুও হতে পারে আবার একজন বোবা, বধির ব্যক্তিও হতে পারেন। ব্যক্তি সাক্ষ্য দিতে পারেন কিনা কিংবা সাক্ষীর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আদালতই তার বিচার শক্তি দ্বারা নির্ধারণ করবেন সাক্ষীর সাক্ষ্য দেয়ার যোগ্যতা আছে কিনা।
One Comment
Leave A Comment
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।
[…] সাক্ষী কাকে বলে? কে সাক্ষ্য দিতে পারে? […]