মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে ইরান ও ইসরায়েল অন্যতম দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান উত্তেজনা শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। ইসরায়েল তার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং উচ্চ প্রশিক্ষিত বাহিনীর মাধ্যমে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অসামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে, ইরান তার বৃহৎ জনবল, আঞ্চলিক প্রভাব এবং প্রতিনিয়ত ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নের মাধ্যমে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তুলেছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সামরিক শক্তির এই তুলনা শুধুমাত্র তাদের বাহিনীর সংখ্যা নয়, বরং তাদের কৌশল, আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক মিত্রদের ওপরও নির্ভর করে। এই নিবন্ধে আমরা ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক শক্তির বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করব, বিশেষ করে আধুনিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কোন দেশ কতটা সক্ষম এবং কোথায় তাদের দুর্বলতা রয়েছে।
সামরিক বাজেট ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা
সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে প্রথম যে বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি, তা হলো বাজেট। সামরিক বাজেট একটি দেশের সামরিক উন্নয়ন, প্রযুক্তি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং আধুনিকীকরণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
ইসরায়েল ২০২৪ সালে $২৪.৪ বিলিয়ন সামরিক বাজেট বরাদ্দ করেছে, যেখানে ইরানের সামরিক বাজেট $১০ বিলিয়ন। অর্থাৎ, ইসরায়েলের সামরিক বাজেট ইরানের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি, যা ইসরায়েলের প্রযুক্তিগত ও আধুনিক সামরিক সজ্জায় বিনিয়োগ করার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে।
সামরিক কর্মী সংখ্যা ও রিজার্ভ ফোর্স
ইসরায়েলের সক্রিয় সামরিক কর্মীর সংখ্যা ১,৬৯,৫০০, যেখানে ইরানের সংখ্যা ৬১০,০০০। এ থেকে বোঝা যায়, জনবল নির্ভরতার ক্ষেত্রে ইরান অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। ইরান তার বড় সংখ্যক জনবলের মাধ্যমে সামরিক অভিযানে ব্যাপক শক্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম, যেখানে ইসরায়েল তার আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিশেষায়িত বাহিনীর উপর নির্ভরশীল।
ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান
ইসরায়েলের কাছে ৪০০ ট্যাঙ্ক রয়েছে, যেখানে ইরানের ট্যাঙ্ক সংখ্যা ১,৫১৩। এছাড়া, সাঁজোয়া কর্মী বাহিনী (APCs/IFVs)-এর সংখ্যা ইসরায়েলে ৭৯০ এবং ইরানে ১,২৫০। ইরানের ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বাহিনীর আধিক্য তাদের স্থলযুদ্ধের ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা প্রদান করে, যদিও ইসরায়েল তার অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক এবং মিসাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিরক্ষায় শক্তিশালী।
আর্টিলারি ও হেলিকপ্টার বাহিনী
আর্টিলারি বা গোলাবারুদের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের কাছে ৫৩০ ইউনিট রয়েছে, কিন্তু ইরানের রয়েছে ৬,৭৯৮টিরও বেশি। এই ক্ষেত্রে ইরান এগিয়ে থাকলেও ইসরায়েলের উচ্চ-প্রযুক্তির হামলা হেলিকপ্টার (৪৬ বনাম ইরানের ৫০) এবং উচ্চ-কর্মক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা প্রতিপক্ষের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম।
বিমান বাহিনী ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা
যুদ্ধবিমান সংখ্যা এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েল তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী। ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান রয়েছে ৩৪০টি, যেখানে ইরানের রয়েছে ২৮৮টি। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে, ইসরায়েল অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থেকে লাভবান হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক ও কার্যকরী করে তুলেছে।
সাবমেরিন ও সমুদ্রপথ প্রতিরক্ষা
আক্রমণ সাবমেরিনের ক্ষেত্রে ইরান ও ইসরায়েলর মধ্যে ইসরায়েল পরিষ্কারভাবে এগিয়ে রয়েছে। ইসরায়েলের হাতে রয়েছে ৫টি আক্রমণ সাবমেরিন, যেখানে ইরানের রয়েছে মাত্র ১টি। এছাড়া, উপকূল ও সমুদ্রপথে টহল দিতে সক্ষম জাহাজের সংখ্যা ইরানের তুলনায় ইসরায়েলের কম হলেও তাদের সমুদ্রপথে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক সুসংহত এবং আধুনিক।
উপগ্রহ ক্ষমতা ও তথ্য সংগ্রহ
উপগ্রহের দিক থেকে ইসরায়েল অনেক এগিয়ে রয়েছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে। ইসরায়েলের ৮টি উপগ্রহ রয়েছে, যা তাদের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং নজরদারি সক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করেছে। ইরানের হাতে মাত্র ২টি উপগ্রহ রয়েছে, যা তাদের তুলনামূলকভাবে সীমিত নজরদারি ও গোয়েন্দা ক্ষমতা নির্দেশ করে।
ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক শক্তির তুলনামূলক টেবিল (২০২৪)
সূচক | ইসরায়েল | ইরান |
সামরিক বাজেট (২০২৪) | $২৪.৪ বিলিয়ন | $১০ বিলিয়ন |
সক্রিয় সামরিক কর্মী | ১,৬৯,৫০০ | ৬১০,০০০ |
ট্যাঙ্ক | ৪০০ | ১,৫১৩ |
সাঁজোয়া বাহিনী (APCs/IFVs) | ৭৯০ | ১,২৫০ |
মার্টিলারি | ৫৩০ | ৬,৭৯৮+ |
হামলা হেলিকপ্টার | ৪৬ | ৫০ |
যুদ্ধবিমান | ৩৪০ | ২৮৮ |
আক্রমণ সাবমেরিন | ৫ | ১ |
টহল জাহাজ | ৫১ | ৭০ |
উপগ্রহ | ৮ | ২ |
আধুনিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক শক্তি
আধুনিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক শক্তির আলোচনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দুটি দেশ সামরিক প্রযুক্তি, কৌশল, এবং কার্যক্ষমতার দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা পন্থা অনুসরণ করে। তাদের সামরিক সক্ষমতা কেবলমাত্র বাহিনী সংখ্যা বা অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণে নয়, বরং তাদের সামগ্রিক কার্যক্ষমতা, কৌশলগত প্রযুক্তি, এবং বিশ্বশক্তির সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতেও নির্ধারিত হয়।
ইসরায়েলকে আধুনিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে অন্যতম সেরা সামরিক প্রযুক্তির অধিকারী দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর অস্ত্র ব্যবস্থা, যেমন আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে, যা আকাশে শত্রুপক্ষের রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম। এই ব্যবস্থা ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষায় বিপ্লব এনেছে এবং তাদের বেসামরিক জনসংখ্যা রক্ষা করেছে।
ইসরায়েলের বিমান বাহিনী অত্যন্ত দক্ষ এবং আধুনিক। তাদের হাতে F-35 এবং F-16-এর মতো উন্নত মার্কিন যুদ্ধবিমান রয়েছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়। এছাড়া, ইসরায়েলের বিশেষ বাহিনী যেমন মোসাদ এবং সায়ারেট মাতকাল আধুনিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গোপন অভিযান ও সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রশিক্ষিত জনবল এবং প্রযুক্তিগত সামর্থ্য তাদের প্রতিপক্ষের তুলনায় অত্যন্ত অগ্রসর করে রেখেছে।
ইরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকান্ড
অন্যদিকে, ইরান তাদের সামরিক কৌশলে জনবল ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যদিও তাদের প্রযুক্তিগত সুবিধা ইসরায়েলের তুলনায় কম, তবুও ইরান তার নিজস্ব সামরিক শক্তি এবং আঞ্চলিক মিত্রদের মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধি করেছে। ইরান তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, যা তাদের আঞ্চলিক শত্রুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে সক্ষম। ইরানের শাহাব-৩ এবং সিজিল-২ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ২০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত আঘাত হানতে পারে, যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারকে বাড়িয়ে তোলে।
তবে ইরানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো তাদের প্রক্সি যুদ্ধের কৌশল। ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস, এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের মতো গ্রুপগুলোর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে এবং তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। এই গ্রুপগুলো ইরানের পক্ষ থেকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালায়, যা ইরানের সামরিক প্রভাবকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করেছে।
প্রযুক্তিগত দিক থেকে ইসরায়েলের শ্রেষ্ঠত্ব
যদিও ইরানের নিজস্ব সামরিক শক্তি বড় এবং প্রভাবশালী, তবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে ইসরায়েল এখনো অনেক এগিয়ে। ইসরায়েলের অস্ত্রের উন্নত মান, ড্রোন প্রযুক্তি, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে।
কৌশলগত সহযোগিতা ও বৈশ্বিক সম্পর্কের প্রভাব
এছাড়া, ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত সামরিক সরঞ্জাম ও অর্থনৈতিক সহায়তা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বমানের করে তুলেছে। অন্যদিকে, ইরান তার সামরিক শক্তি বাড়াতে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতা গড়ে তুলেছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের প্রেক্ষাপটে।
ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক শক্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইরান সংখ্যায় বড় হলেও ইসরায়েল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে সামরিক ক্ষমতায় এগিয়ে রয়েছে। ইসরায়েল আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে উন্নত মানের প্রযুক্তি, গোয়েন্দা উপগ্রহ এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তার সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, ইরান তার ব্যাপক জনবল, আঞ্চলিক মিত্রতা, এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে স্থলযুদ্ধে এবং প্রতিরক্ষা ক্ষমতায় নিজেদের শক্তিশালী করেছে।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রেরঃ নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা
গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ
গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।
পিকেকে-র বিলুপ্তি: তুরস্কের জন্য সুযোগ নাকি কুর্দিদের জন্য নতুন সংকট?
পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা: তুরস্কের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ, নাকি কুর্দিদের জন্য অধিকার হারানোর নতুন ঝুঁকি?
অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুসঃ ভারতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা
পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে "অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস" নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটির অর্থ "গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর"।
আদালতের এখতিয়ারঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও বাংলাদেশে প্রয়োগ
বিচারিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আদালতের এখতিয়ার। আদালতের এখতিয়ার তিন প্রকারঃ আদি এখতিয়ার, আপীল এখতিয়ার, এবং পরিদর্শন এখতিয়ার।