জাতীয়তাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারণা। যুগে যুগে মানবজাতির ঐতিহাসিক উন্নয়ন ও সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে এটি। জাতীয়তাবাদ কেবল একটি জাতির স্বাধীনতা ও ঐক্যের প্রতীক নয়, বরং ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি গভীর সংযোগ স্থাপনের এক অনন্য প্রচেষ্টা। এর শিকড় প্রাচীন সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে বিস্তার করলেও, আধুনিক যুগে এটি নতুন মাত্রা ও দিকনির্দেশনা লাভ করেছে। এই প্রবন্ধে আমরা জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের বিকাশ ও পরিবর্তনগুলোর সাথে পরিচিত হব। পাশাপাশি, জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ আলোচনা করব।
জাতীয়তাবাদ কী?
জাতীয়তাবাদ এমন একটি ধারণা যা একটি জাতির সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, এবং রাজনৈতিক ঐক্য ও স্বাধীনতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এর শিকড় ল্যাটিন শব্দ “Natio” থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ জন্ম। জাতীয়তাবাদ মূলত মানুষের মধ্যে ঐক্য, পরিচিতি এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে।
জাতীয়তাবাদ কী জানতে আরো পড়ুনঃ জাতীয়তাবাদঃ ধারণা, গুরুত্ব ও আধুনিক সভ্যতায় প্রভাব
ইতালির দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করলেও, এর পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব তৈরি করেননি। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন তার Imagined Communities বইতে জাতীয়তাবাদকে “কাল্পনিক সম্প্রদায়” হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যেখানে মানুষ নিজেদের একটি ঐতিহাসিক গোষ্ঠী হিসেবে কল্পনা করে। অন্যদিকে, হেগেল জাতীয়তাবাদকে “আধ্যাত্মিক শক্তি” হিসেবে দেখেছেন এবং রুশো গণতান্ত্রিক আদর্শের সাথে যুক্ত করেছেন। ।
জাতীয়তাবাদের ইতিহাস
জাতীয়তাবাদকে একটি জাতির ঐক্য, পরিচিতি, এবং স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতীয়তাবাদের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এর উৎপত্তি মূলত মধ্যযুগের শেষদিকে রেনেসাঁ যুগে। পরবর্তীতে আধুনিক যুগের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে যুক্ত হয়ে একটি বিস্তৃত ধারণায় পরিণত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয়তাবাদের ধারণা ছিল অস্পষ্ট এবং এটি বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষমতাবৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত ছিল। সেসময় জাতীয়তাবাদ ছিল মূলত আধিপত্য ও শাসনের প্রতীক। মধ্যযুগে রাজা বা সামন্তশ্রেণির অধীনে জনগণের মধ্যে কোনো সুসংহত জাতীয় চেতনা গড়ে ওঠেনি। “জাতি” শব্দটি তখন নির্দিষ্ট রাজ্য বা সাম্রাজ্য নির্দেশ করত, যেখানে জনগণের পরিচয় রাজপরিবার ও শাসকদের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
রেনেসাঁ এবং আধুনিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ
পঞ্চদশ শতাব্দীতে আধুনিক রাষ্ট্রের সূচনা এবং সাম্রাজ্যগুলোর পতনের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমবারের মতো জাতীয়তাবাদী ধারণার প্রসার ঘটে। রেনেসাঁ যুগে মানুষের স্বাধীনতা এবং নিজস্ব পরিচয়ের প্রতি নতুন আগ্রহ তৈরি হয়।
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তার বিখ্যাত রচনা দ্য প্রিন্স (The Prince)-এ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধারণা উপস্থাপন করেন, যা জাতীয় ঐক্যের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তবে তিনি সরাসরি জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রদান করেননি।
জঁ-জাক রুশো তার বিখ্যাত রচনা দ্য সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্ট (১৭৬২)-এ সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে জাতির আত্মনির্ভরশীলতা ও স্বাধীনতার ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। যদিও এটি সরাসরি জাতীয়তাবাদ নয়, তবু এটি জনগণের ইচ্ছা ও স্বাধীনতার মাধ্যমে জাতির ঐক্য গড়ে তোলার ধারণাকে শক্তিশালী করে। এরপর, ১৭৭৬ সালের আমেরিকান বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের স্বাধীনতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যা জাতীয়তাবাদের আধুনিক রূপের ভিত্তি স্থাপন করে। এই ধারাবাহিকতায়, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব “স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব” এর মূলনীতিকে তুলে ধরে। এই বিপ্লবটি ইউরোপে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা করে এবং অনেক রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা অর্জনের অনুপ্রেরণা দেয়।
১৯শ শতক এবং এর পরবর্তী সময়ে, ইউরোপ এবং অন্যান্য অঞ্চলে জাতি রাষ্ট্রের ধারণা আরও বিকশিত হতে শুরু করে। বিশেষত ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) এবং স্বাধীনতা সংগ্রামগুলোর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। ফরাসি বিপ্লবে জাতির স্বাধীনতা ও জনগণের একতা ধারণাগুলি প্রথমবারের মতো আধিকারিক রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়। এই সময়টায় ইম্পিরিয়ালিজম এবং কোলোনিয়ালিজম পরবর্তী সময়েও জাতীয়তাবাদ একটি মূল প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে দেখা দেয়, যেখানে উপনিবেশিত দেশগুলো তাদের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই শুরু করে।
১৮২১ সালে গ্রিস ওসমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সফল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনা করে। এরপর, ১৮৬১ সালে ইতালির একীকরণ এবং ১৮৭১ সালে জার্মানির একীকরণ ঘটে, যা আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের বিকাশের মাইলফলক। ১৮শ শতকের শেষ থেকে ১৯শ শতকের শুরুতে জার্মান দার্শনিক জর্জ উইলহেম ফ্রিডরিখ হেগেল জাতি এবং রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। তার চিন্তাধারায় ঐতিহ্য, ভাষা, এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে একটি জাতির স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
বিশ্বযুদ্ধের পর, ২০শ শতকে জাতীয়তাবাদের ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ হয়। এসময় জাতীয়তাবাদ আরো জোরালো হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী বহু দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে এবং জাতি রাষ্ট্রের ধারণা আরও শক্তিশালী হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতা, ১৯৫৭ সালে ঘানা, ১৯৬০ এর দশকে আফ্রিকার অধিকাংশ দেশের স্বাধীনতা অর্জন—এই সবই জাতীয়তাবাদের পক্ষে বড় সাফল্য হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এখন, ২১শ শতকে, যদিও অনেক দেশ রাষ্ট্রীয় সীমানা এবং জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে একীভূত হয়েছে, কিন্তু জাতীয়তাবাদ এখন অনেক সময় বৈষম্য, সহিংসতা, এবং অন্য জাতির প্রতি শত্রুতা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, ভারতের বিজেপি ও আরএসএস-এর মতো গোষ্ঠীগুলি “অখণ্ড ভারত” বা বৃহত্তর ভারতকে প্রতিষ্ঠিত করার যে প্রচেষ্টা করছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং এই ধরনের একত্রীকরণ কোনো জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা যায়। একইভাবে, ইসরাইলের অব্যাহত ফিলিস্তিনবিরোধী কার্যক্রম এবং তার জাতীয়তাবাদী মনোভাবও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
এইভাবে, জাতীয়তাবাদের ইতিহাস একদিকে যেমন জাতির ঐক্য এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতিফলন, তেমনি এটি কখনও কখনও মানুষের মধ্যে ঘৃণা, বৈষম্য এবং সংঘর্ষের কারণও হয়ে উঠেছে।
জাতীয়তাবাদের প্রকারভেদ
প্রাথমিকভাবে একটি জাতির আত্মপরিচয়ের বিষয় হলেও জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। জাতীয়তাবাদের দুটি প্রধান ধারা হলো সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ জাতির ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয়, আর রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ জাতির সার্বভৌমত্বের উপর জোর দেয়। এখানে জাতীয়তাবাদের প্রকারভেদ আলোচনা করা হলোঃ
১. সিভিক জাতীয়তাবাদ (Civic Nationalism)
সিভিক জাতীয়তাবাদ বা রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ হলো একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে সংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকারভিত্তিক একাত্মতা স্থাপন করা। এই জাতীয়তাবাদ দেশের সবার জন্য সমান অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্য রাখে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই জাতীয়তাবাদের প্রভাব সুস্পষ্ট, যেখানে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোতে নাগরিকদের মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠা করা হয়, নির্ভরযোগ্যতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মাধ্যমে।
২. জাতিগত জাতীয়তাবাদ (Ethnic Nationalism)
জাতিগত জাতীয়তাবাদ একটি জাতি বা জনগণের বংশগত বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ভিত্তিক জাতীয়তা। এটি একটি নির্দিষ্ট জাতিগত বা ভাষাগত গোষ্ঠীকে একীকৃত করার জন্য কাজ করে এবং সাধারণত ঐতিহাসিক কিংবা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর গুরুত্ব দেয়। এই জাতীয়তাবাদের ধারণা কিছু ক্ষেত্রে জাতিগত বিভেদকে উসকে দেয় এবং সাম্প্রদায়িক হিংসার সৃষ্টি করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ ইসরায়েলি জাতীয়তাবাদ, যেখানে ইহুদি জনগণের ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আবার, চীনেও একধরনের জাতিগত জাতীয়তাবাদ রয়েছে, যেখানে হান চীনা জনগণের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের ভিত তৈরি করা হয়েছে।
৩. আধিপত্যবাদী জাতীয়তাবাদ (Imperial Nationalism)
আধিপত্যবাদী জাতীয়তাবাদ বা সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদ এক জাতির দ্বারা অন্য জাতিকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করার ধারণাকে সমর্থন করে। এই জাতীয়তাবাদ সাধারণত বৃহত্তর ভূখণ্ডের অধিকারী হওয়া এবং শক্তি ও আধিপত্য বিস্তার করাকে উদ্দেশ্য করে।
ভারতীয় উপমহাদেশে বিজেপি ও RSS’র “অখণ্ড ভারত” ধারণা এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির অতীতের সামরিক আগ্রাসনের উদাহরণ এ ধরনের জাতীয়তাবাদের প্রচলনকে নির্দেশ করে। এই জাতীয়তাবাদটি এক জাতির আধিপত্য এবং আগ্রাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
৪. স্বাধীকার জাতীয়তাবাদ (Self-Determination Nationalism)
স্বাধীকার জাতীয়তাবাদ হল একটি জাতির আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম। এই জাতীয়তাবাদ সাধারণত উপনিবেশিত বা শোষিত জনগণের মধ্যে প্রচলিত, যারা তাদের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করতে চায়। বিশ্বের বহু জাতি, যেমন ভারত, বাংলাদেশ, আফ্রিকার বহু দেশ, এই জাতীয়তাবাদী ধারণার অধীনে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়েছে। এখানে জাতীয়তাবাদ মানে শুধু একত্রীকরণ বা সম্মিলন নয়, বরং একটি জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করা।
৫. ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ (Religious Nationalism)
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ হল এমন একটি জাতীয়তাবাদ, যা একটি বিশেষ ধর্মের অনুসরণকারী জনগণের উপর ভিত্তি করে। যেমন, “আমরা শুধুমাত্র হিন্দু, মুসলিম বা ইহুদি, আমাদের ধর্মই আমাদের জাতীয়তাবাদ।” এই জাতীয়তাবাদ বিশেষ করে ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে মনোনিবেশ করে। ভারতে, হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, যেখানে হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়। পাকিস্তানে ইসলামী জাতীয়তাবাদ এবং ইসরায়েলে ইহুদি জাতীয়তাবাদ তার উদাহরণ। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সাধারণত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে, কারণ এটি অন্যান্য ধর্মের মানুষের অধিকারকে খর্ব করে।
৬. আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ (Regional Nationalism)
আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলের প্রতি সম্পর্কিত, যেখানে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল তার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বা স্বকীয়তা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে। এই জাতীয়তাবাদ সাধারণত কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকার বা নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে আসে।
What is the Gender Pay Gap? Does it really exist?
স্পেনের কাতালোনিয়া, ব্রিটেনের স্কটল্যান্ড, এবং কানাডার কুইবেক প্রদেশের মতো উদাহরণগুলি আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের চমৎকার উদাহরণ, যেখানে অঞ্চলগুলো নিজেদের অধিকারের জন্য স্বাধীনতা দাবি করে।
কেন জাতীয়তাবাদ গুরুত্বপূর্ণ?
জাতীয়তাবাদ একটি জাতির সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তি। এটি কেবলমাত্র একটি তাত্ত্বিক ধারণা নয়, বরং একটি শক্তিশালী সামাজিক ও মানসিক চেতনা, যা একটি জাতিকে অভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পথে এগিয়ে যেতে প্রেরণা জোগায়। জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব বহুমাত্রিক এবং একে মানবসমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য শক্তি হিসেবে দেখা হয়।
১. জাতীয় ঐক্য ও পরিচয় প্রতিষ্ঠা
জাতীয়তাবাদ একটি জাতিকে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐক্যের মধ্যে আবদ্ধ করে। এটি জাতির সদস্যদের মধ্যে এক অভিন্ন আত্মপরিচয়ের ধারণা গড়ে তোলে। যখন মানুষ একটি অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি গর্ব অনুভব করে, তখন তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এই ঐক্য রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ভিত্তি।
২. স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতার প্রেরণা
জাতীয়তাবাদ জাতিকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করে। এটি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং আফ্রিকার দেশগুলোর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
৩. সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণ
জাতীয়তাবাদ একটি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও যত্ন প্রদর্শন করে। এটি বহিরাগত সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রতিরোধ করে একটি জাতির নিজস্ব ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে সহায়তা করে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এর এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
Who are China’s Uighur Minority? What’s happening with them?
৪. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন
জাতীয়তাবাদ জনগণ ও সরকারের মধ্যে একটি সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করে। এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে সাহায্য করে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। জাতীয়তাবাদী চেতনা জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে, যা নাগরিক দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করে এবং সামাজিক একতা বৃদ্ধি করে।
৫. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি
জাতীয়তাবাদ একটি জাতিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার অবস্থান সুসংহত করতে সাহায্য করে। এটি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক প্রভাব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
৬. সংকটকালীন মনোবল ও ঐক্য সঞ্চার
জাতীয়তাবাদ সংকটকালীন সময়ে জাতির মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও ঐক্যের সঞ্চার করে। এটি যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক সংকটের সময় জনগণকে একত্রিত করে এবং সমস্যার মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উদ্বুদ্ধ করে।
জাতীয়তাবাদ একটি জাতির টিকে থাকা, বিকাশ এবং প্রগতির মূল শক্তি। এটি কেবল একটি দেশপ্রেম নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি, যা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে। জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন একটি জাতির ঐক্য এবং স্বাধীনতার প্রতীক, অন্যদিকে এটি সংঘাত এবং বিভেদের কারণও হতে পারে। জাতীয়তাবাদের চর্চা এমন ভাবে করতে হবে, যেন এটি সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য বা সহিংসতার হাতিয়ার না হয়ে ওঠে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ জাতীয়তাবাদই জাতির দীর্ঘমেয়াদী শান্তি, উন্নয়ন এবং প্রগতির জন্য আদর্শ।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রেরঃ নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা
গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ
গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।
পিকেকে-র বিলুপ্তি: তুরস্কের জন্য সুযোগ নাকি কুর্দিদের জন্য নতুন সংকট?
পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা: তুরস্কের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ, নাকি কুর্দিদের জন্য অধিকার হারানোর নতুন ঝুঁকি?
অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুসঃ ভারতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা
পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে "অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস" নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটির অর্থ "গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর"।
আদালতের এখতিয়ারঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও বাংলাদেশে প্রয়োগ
বিচারিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আদালতের এখতিয়ার। আদালতের এখতিয়ার তিন প্রকারঃ আদি এখতিয়ার, আপীল এখতিয়ার, এবং পরিদর্শন এখতিয়ার।