গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকারসমূহ কি কি?

ফৌজদারি কার্যবিধি পুলিশকে যেমন একজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দিয়েছে, তেমনি একজন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকারও দিয়েছে। একজন অভিযুক্ত বা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সাংবিধানিক ও আইনি কতকগুলো অধিকার সুপষ্ট করা আছে। তাদের চিন্তা, বিবেক ও বাক প্রকাশের অধিকার রয়েছে যদিও সেসব অধিকার ন্যায় বিচারের স্বার্থে সীমিত করা হয়েছে। যেমন, সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কয়েদিদের ক্ষেত্রে জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধের বিধান প্রযোজ্য হবেনা। আবার, ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চলাচলের স্বাধীনতা একজন কয়েদি বা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবেনা। যাইহোক, একজন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার সমূহ নিম্নরূপঃ

গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার

ক) গ্রেফতারের কারণ জানার অধিকারঃ সংবিধানের ৩৩(১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক পুলিশ অথবা অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক বিনা পরোয়ানায় কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পর ওই ব্যক্তিকে তার অপরাধ ও গ্রেফতারের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানাবে।

গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার, Close-Up Photography of a Person in Handcuffs

উদয়ভান সুকি বনাম স্টেট অব উত্তর প্রদেশ মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট বিভাগ মত দেন যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির গ্রেফতারের কারণ জানার অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। এরফলেই গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি তার জামিনের জন্য উপযুক্ত আদালতে যেতে পারেন, হ্যাবিয়াস কর্পাসের জন্য রিট পিটিশন দায়ের করতে পারেন অন্যকথায়, তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারবেন।

সাক্ষী কাকে বলে? কে সাক্ষ্য দিতে পারে?

খ) জামিনের অধিকারঃ ফৌজদারি কার্যবিধির ৬০ ধারা অনুযায়ী, জামিনযোগ্য অপরাধ হলে অনতিবিলম্বে মুক্তি পাওয়ার অধিকার রয়েছে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির। এছাড়া কোন পুলিশ অফিসার বিনা পরোয়ানায় জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্র ব্যতিত ভিন্ন কোন ব্যক্তিকে আটক করবেন, তখন উক্ত পুলিশ অফিসার উক্ত গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে জানাবেন যে তিনি জামিনে মুক্তি পাবার অধিকারী এবং নিজেই মুচলেকার ব্যবস্থা করতে পারেন।

গ) বিলম্ব ব্যতিত ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হবার অধিকারঃ সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৬১ ধারা অনুযায়ী গ্রেফতারের স্থান থেকে আদালতে পৌঁছানোর জন্য যৌক্তিক ও পারিপার্শ্বিক কারণ এবং ১৬৭ ধারার অধীন ম্যাজিস্ট্রের বিশেষ আদেশ ব্যতীত কোন পুলিশ অফিসার গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার বেশি সময় পুলিশ হেফাজতে আটক রাখতে পারবে না।

ক্ষত্রী (২) বনাম স্টেট অব বিহার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্ট করে বলেন যে, কোন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে বিচারিক ম্যজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার সাংবিধানিক ও আইনী দায়িত্ব রাষ্ট্র এবং পুলিশকে নিশ্চিত করতে হবে। এর অন্যথায় ম্যাজিস্ট্রেট যেকোন মূল্যে পুলিশকে এই দায়িত্ব পালনে বাধ্য করবেন।  এছাড়া শরিফবাঈ বনাম আব্দুল রাজ্জাক মামলায় সুপ্রিমকোর্ট বলেন যে, যদি কোন পুলিশ অফিসার গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২ ঘন্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে ব্যর্থ হলে তিনি অবৈধ আটকের দায়ে অভিযুক্ত হবেন।

ঘ) আইনজীবির সাথে পরামর্শের অধিকারঃ সংবিধানের ৩৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ফৌজদারি আদালতে বা এই আইনের অধীন দায়েরকৃত কোন কার্যক্রমে বিচারাধীন অপরাধের দায়ে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন আইনী পরামর্শকের মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থণ করার অধিকার রাখেন।

What is Judicial Review? How does it shape the Law and Society?

ঙ) বিনা খরচে আইনি সহায়তা পাবার অধিকারঃ যদি দায়রা আদালতে বিচারাধীন কোন অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করার মত কোন আইনজীবি না থাকেন এবং আদালতের কাছে এটি প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত অভিযুক্তের আইনজীবি নিযুক্ত করার কোনরূপ সামর্থ্য নেই তাহলে আদালতই একজন আইনজীবি নিযুক্ত করে দেবেন। আদালতে বিচারাধীন একজন অসহায় ব্যক্তির বিনামূল্যে আইনি সেবা পাবার এই অধিকার জানানোর দায়িত্ব সকল ধরণের আদালত ও ম্যাজিস্ট্রেটের।

রেস জুডিকাটা বা বিচারকৃত সিদ্ধান্ত নীতি (Res Judicata) কি? রেস জুডিকাটার শর্তাবলী ও কনস্ট্রাকটিভ রেস জুডিকাটা

চ) বন্ধু বা স্বজনদেরকে গ্রেফতারের খবর জানানোর অধিকারঃ সংবিধানের ৩৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ধারা অনুযায়ী, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে থানায় হাজির করার পর পুলিশ অবশ্যই গ্রেফতারের খবর তার স্বজন, বা বন্ধু বা তার পছন্দের অন্য যেকোন ব্যক্তিকে জানাবে। কোথায় আটক রাখা হয়েছে সে সম্পর্কেও জানাবে। যে ব্যক্তিকে গ্রেফতারের খবর জানানো হয়েছে তার নাম ও ঠিকানা পুলিশ লিপিবদ্ধ করবে।

ছ) ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ ও অন্যান্য মামলায় হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন যে, চিকিৎসক কর্তৃক পরীক্ষিত হবার অধিকারঃ একজন পুলিশ অফিসার কর্তৃক গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে নিবন্ধিত চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষা করার এখতিয়ারের সাথে সাথে অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বেচ্ছায় একজন নিবন্ধিত চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষিত হতে পারেন। গ্রেফতারের সময় থেকে শুরু করে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে, হেফাজিতে আটক থাকার সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি পরীক্ষিত হতে পারেন যদি না ম্যজিস্ট্রেট মনে করেন অভিযুক্ত ব্যক্তি বিরক্তিকর, বা বিলম্ব বা ন্যায় বিচারে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইছে।  শীলা বরষ বনাম স্টেট অব মহারাষ্ট্র মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেন যে, চিকিৎসক কর্তৃক পরীক্ষিত হবার অধিকারের কথা অভিযুক্তকে জানানো ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব।

জ) জব্দকৃত জিনিসপত্র ফেরত পাবার অধিকারঃ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫১ ধারা অনুযায়ী গ্রেফতারের সময় আটকৃত বা জব্দকৃত জিনিসপত্র নিরাপদে ফেরত পাওয়া বা হেফাজতে রাখার অধিকার।

ঝ) নির্যাতন থেকে মুক্ত থাকার অধিকারঃ সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জিজ্ঞাসাবাদ বা তদন্তকালীন সময়ে পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার রয়েছে খারাপ আচরণ, অপব্যবহার বা নির্যাতন থেকে মুক্ত থাকার।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫০ ধারা অনুযায়ী, গ্রেপ্তারকৃত যেন পলায়ন করতে না পারে সে জন্য যতটুকু প্রয়োজন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে তবে অধিক বাধা প্রদান করা যাবে না। যেমন অধিক বাধা প্রদান করে শারীরিক কষ্ট দেওয়া যাবে না। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের অধিকার লঙ্ঘন যেমন হেফাজতে নিয়ে গ্রেফতারকৃতদের  নির্যাতন, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়, ইত্যাদি ন্যায় বিচারকে বিঘ্নিত করবে। যার ফলে, নিরীহরা শাস্তি পেতে পারে এবং সত্যিকারের অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। দন্ডবিধির ২২০ বিধির অধীন পুলিশ কর্তৃক অন্যায়ভাবে, বিদ্বেষপূর্ণভাবে অথবা বেআইনিভাবে কাউকে গ্রেফতার ও আটক করা ৭ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা অর্থদন্ড না উভয় উপায়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top