রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনের অনেকখানি অধিকার করেছিলো পদ্মা নদী৷ পদ্মার নদীর ভয়ংকর সৌন্দর্য্য – প্রকৃতি তাঁর রচনায় বিমুগ্ধভাবে ফুটে উঠেছে৷তিনি অকপটে মেনে নিয়েছেন ‘বাস্তবিক, পদ্মা নদীকে আমি ভালবাসি;…আমি যখন শিলাইদহ বোটে থাকি, তখন পদ্মা আমার কাছে স্বতন্ত্র মানুষের মতো’৷আবার ‘পদ্মা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হে পদ্মা আমার/ তোমায় আমায় দেখা শত শত বার’৷ সেই খরস্রোতা পদ্মা, ভয়ংকর কীর্তিনাশা আজ হাজার হাজার বছর বাদে মৃতপ্রায় দশায়!

১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের প্রধান নদীই হলো পদ্মা। কোমলতা ও কঠোরতা দুই রুপেই পদ্মা যেন মিশে আছে এ দেশের জনজীবনে। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে পদ্মার রয়েছে বিশেষ অবদান। এই একই নদী বয়ে চলছে দুই নামে দুই দেশে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়কার বণিক এবং ঢাকা-ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের ভূস্বামী রাজা রায়বল্লভের অনেক সৌধ ও কীর্তি ধ্বংস করেছিল বলে রাজা রায়বল্লভ এর নামকরণ করেন কীর্তিনাশা। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদী প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গে কুষ্টিয়ার গা ঘেঁষে চাপাইনবাবগঞ্জের মোহনপুর দিয়ে। এখান থেকেই নদীটি পদ্মা নাম ধারণ করেছে। বাংলাদেশে ঢুকে ২৫৮ কি.মি. পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে গোয়ালন্দ পর্যন্ত, গোয়ালন্দ থেকে যমুনার পানি বুকে নিয়ে পদ্মা নামে আরো ১২০ কি.মি. পার হয়ে মিশেছে চাঁদপুরের মেঘনায়। তারপর পদ্মা ও মেঘনা একত্রিত প্রবাহ গিয়ে পৌঁছেছে বঙ্গোপসাগরে।

How Sikkim became a part of India?

পদ্মা নদী, বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গে চাপাইনবাবগঞ্জের মোহনপুর দিয়ে পদ্মা প্রবেশ করেছে। ছবিঃ নাসা,

বাংলাদেশে পদ্মার সর্বোচ্চ গভীরতা ৪৭৯ মিটার এবং গডে ২৯৫ মিটার গভীরতা ধারণ করে বয়ে চলছে। গড়ে ১০ কি.মি. প্রস্থের পদ্মার শাখা প্রশাখা নদীর সংখ্যাও কম নয়। শাখা নদীগুলো হলো গড়াই, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব ইত্যাদি। আর এর প্রধান উপনদী হলো মহানন্দা ও পুনর্ভবা। পদ্মার কিছু প্রশাখা নদীও রয়েছে, সেগুলো হলো, মধুমতী, পশুর, কপোতাক্ষ ইত্যাদি।এই নদীগুলো চলার পথে ছুঁয়েছে চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার অসংখ্য জনপদ। পদ্মার শাখানদী আড়িয়াল খাঁ মাদারীপুর জেলায় অবস্থিত। সুনীল তাঁর ‘আমাদের ছোট নদী’ বইটিতে তাঁর শৈশব ও কৈশরের স্মৃতিচারণ করেছেন এই আড়িয়াল খাঁ নদীটিকে ঘিরে।


পন্ডিতদের মতে, পদ্মা একসময় গৌড় দিয়ে বয়ে যেত। বিশিষ্ট ইংরেজ ঐতিহাসিক ও জরিপবিদ মেজর হার্স্ট মনে করেন, ১৫০৫ সালে ভয়ানক এক ভূমিকম্পের ফলে পদ্মা গৌড় থেকে দক্ষিণে সরে যায়। গৌড় হচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রাচীন জনপদ অধুনা মুর্শিদাবাদ, মালদহ প্রভৃতি অঞ্চল ছিল গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত। মেজর রেনল্ড (ইতিহাসবিদ ও ভূ-জরিপবিদ) ও মেজর হার্স্ট দুজনেই মনে করেন এক সময় পদ্মা নাটোর অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্রের সাথে এসে মিশেছিল। কিন্তু ১৫০৫ সালের ভূমিকম্পে সেটি দক্ষিণে সরে এসে প্রথমে রাজশাহী পরে কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী ও পাবনার রাজবাড়ি প্রভৃতি জেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনায় গিয়ে মিশেছে।

What is cultural aggression? How does it threaten world cultural diversity?

ঋতু বৈচিত্রের এই দেশে ষড় ঋতুর ছোঁয়ায় কখনো শান্ত আবার কখনো চঞ্চল রুপ ধারণ করে আমাদের চিরচেনা এই পদ্মা। শুকনো মৌসুমে পদ্মার জলপ্রবাহ ১৫ হাজার কিউসিক থাকলেও ভরা বর্ষায় তা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৭ লাখে। কৃষি প্রধান এই সোনার বাংলার সেঁচ কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই পদ্মা। দেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জমির সেচ কাজ চলে এই নদীর পানি দিয়েই।


পদ্মা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নৌপথ। এই পথেই নানান নৌযানের তাই নিত্ত আসা যাওয়া। রোদের খড়তাপ, বৃষ্টির আগমন কোনো কিছুতেই যেন থেমে নেই পদ্মা। বয়ে চলছে তার আপন গতিতে। এই নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে অনেক নদী বন্দর, খেয়াঘাট, ফেরিঘাট। দ্রুতগতির স্পিডবোর্ড, দূর পাল্লার লঞ্চ, ফেরি প্রতিদিনই সেতুবন্ধন করে এঘাট ওঘাট চলাচলে। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ফেরিঘাট অন্যতম। ঢাকা থেকে এটি মাত্র ৩৭ কি.মি. দক্ষিণে। পদ্মার কারণে আলাদা হওয়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সাথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই ফেরিঘাট। যদিও বর্ষাকালেই নদী তার স্বাভাবিক নাব্যতা ফিরে পায়।

পদ্মা নদী, উইকিমিডিয়া


পদ্মার নাম শুনলেই যেন জিভে পানি চলে আসে,পদ্মার ইলিশের জন্য। পদ্মার এই ইলিশের জুড়ি নেই সারা পৃথিবী জুড়ে। পস্মা ও ইলিশ এ দুতো একে অপরের জন্য বিশ্বখ্যাত। কিন্তু নাব্যতা কমে যাওয়ায় পদ্মায় চলাচল কমে গেছে সাগর ফেরত ইলিশের। পরিবেশের বিপর্যয়,নিয়ম মেনে মাছ না ধরা,পানি দুষণমূলক নানা ধরনের কাজের জন্য কমে গেছে অন্য মাছেরও প্রাচুর্য।


নৌকায় করে পানির উপর ভেসে বেড়ানোর মজাই আলাদা, অনেকেই প্রিয় মানুষটির সাথে প্রকৃতি উপভোগ করতে নৌকা ভ্রমণ করেন। কত গল্প,কত স্বপ্নের আনাগোনা চলে সেই মধুময় ক্ষণে। নদীর ধারে বসে প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখে রচিত হয় হাজারে জীবন গল্প আর সেসবের সাক্ষী এই পদ্মা। বৃষ্টির আগমনে পদ্মা যেন রিমঝিম ছন্দ তুলে নাচতে থাকে। গড়ে ২ হাজার মি. মিটার বৃষ্টি বুকে নেয় পদ্মা। ভয়ংকর সুন্দর এই পদ্মার জীবনরূপ ফুটে উঠেছে কবি-সাহিত্যিকদের বর্ণনায়। পদ্মার রূপে বিমোহিত হয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছিন্ন পত্রাবলীতে’ লিখেছেন-“এই নদীর উপরে,মাঠের উপরে,গ্রামের উপরে সন্ধ্যেটা কি চমৎকার,কী প্রকান্ড,কী প্রশস্ত,কী অগাধ,সে কেবল স্তব্ধ হয়ে অনুভব করা যায় কিন্তু ব্যক্ত করতে গেলেই চঞ্চল হয়ে উঠতে হয়।” পদ্মার কঠোরতার কারণে অনেকের কাছেই তা যেন সর্বনাশা পদ্মা। গীতিকার তার গানে গানে বলেছেন-  “সর্বনাশা পদ্মা নদী,তোর কাছে শুধাই বল আমারে তোর কি রে আর কুল কিনারা নাই?” এছাড়াও পদ্মা পাড়ের জীবনের গল্প সর্ব প্রথম উঠে এসেছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের “পদ্মা নদীর মাঝি” উপন্যাসে।পদ্মার জোয়ার-ভাটা,সুখ-দুঃখের গল্প উঠে আসে এই উপন্যাসের কুবের মাঝির জীবনের গল্প দিয়ে। পদ্মার ভয়ংকর রুপ গ্রাস করে হাজারো নদী পাড়ের মানুষের কষ্টে লালিত স্বপ্নকে,প্রবল স্রোতে হারিয়ে যায় বহু মানুষের প্রাণ।

Let’s call Israel’s violence what it is: terrorism, not clashes

পদ্মার সেই রুপ বদলে গেছে অনেকটাই। পদ্মার করাল গ্রাসে কত শত একর ভূমি হয়েছে নিশ্চিহ্ন। কত শত মানুষকে এককালে ভিটে ছাড়া করেছে এই নদীটি। আজ পদ্মা হারিয়ে ফেলেছে তার যৌবন। পদ্মার এমন রুগ্ন ও বয়োবৃদ্ধ অবস্থার জন্য দায়ী আন্তঃনদী সংক্রান্ত আইন ভেঙে ভারতের নির্মাণ করা ফারাক্কা বাঁধ। রবীন্দ্রনাথ আজ বেঁচে থাকলে হয়ত বিদীর্ণ হতো তাঁর মানসপট,হয়তো হত না! কে জানে!

1672584521.Padma%20River%201

ফারাক্কা বাঁধের কারণে উত্তাল পদ্মা এখন মরা খাল [বাংলানিউজ২৪]

নদী তার আপন গতিতে চলতে চলতে লিখে যায় পরিবর্তনের নানা গল্প। কখনো সে গল্প জীবিকার কখনোবা প্রবল ছোঁবলে প্রাণনাশের,কখনো বা সেই গল্প কোনো জাতির উন্নয়নের কখনোও বা ধ্বংসের। সবকিছু সাথে নিয়ে পদ্মা এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু সেই খরস্রোতা সর্বানাশা পদ্মা আর নেই। এখন ধুকে ধুকে বেঁচে আছে। যদিও পদ্মাকে বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল কিন্তু ভারতের প্রত্যক্ষ অসহযোগিতার কারণে সেইসব চুক্তি নামসর্বস্ব চুক্তিই হয়ে পড়ে আছে আন্তঃচুক্তিকে তোয়াক্কা করেই। অতি দ্রুত নদী বাঁচানোর কোন কার্যকরি পদক্ষেপ না নিলে পদ্মার মাধ্যমেই এদেশে মরুকরণ শুরু হয়ে যাবে!

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Shanjida Shima is a graduate student at the University of Rajshahi's Department of Islamic History and Culture. She writes from her college days, with a focus on history and literature. She contributes to MaroonPaper on a regular basis. Her articles can be found on MaroonPaper.

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

  • আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

  • ইক্যুইটির ম্যাক্সিম

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা

  • আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা

আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

  • পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয়

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।