“আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য” পৃথিবীর মানচিত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশের মিলনস্থলে মধ্যপ্রাচ্য অবস্থিত। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রণালী হলো হরমুজ প্রণালী। মার্কিন ভূখন্ডের বাইরে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক রুট হলো এই প্রণালী। সমকালীন বিশ্ব অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই প্রণালীর উপর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, অর্থনৈতিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক বাণিজ্যের সফলতা নির্ভর করে।
নামকরণের ইতিহাস
আমরা জানি যে, যদি কোনো জলরাশি দুটি উপসাগর বা সাগরকে এক করে দেয় তখন তাকে প্রণালী বলে। তেমন একটি প্রণালী হলো হরমুজ যা ইংরেজিতে Strait of Hormuz বা Hormuz Strait নামে পরিচিত। ফার্সি ভাষায় একে বলা হয় তাঙ্গেহ-ইয়ে হরমজ।
জানা যায়, হরমুজ প্রণালী নামকরণ করা হয়েছে ওরমাস বা হরমুজ রাজ্যের নাম অনুসারে। ১০ম থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত পারস্য উপসাগরের পূর্বে অবস্থিত ছিল হরমুজ রাজ্য। হরমুজ রাজ্য প্রথমে মুসলিম সেলজুক সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। এরপর চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খান এবং এরপরে পর্তুগীজদের অধীনে যায় হরমুজ। ১৭ শতকে হরমুজ আবার ইরানের সাফাভি সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।
কোনো কোনো তথ্যসূত্র হতে জানা যায়, উক্ত রাজ্যের নামানুসারে খ্রিষ্টীয় একাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে এর নামকরণ করা হয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, হরমুজ শব্দটি ফার্সি শব্দ “ওরমজ” থেকে আগত যার অর্থ খেজুর গাছ। স্থানীয়ভাবে বলা হয়, প্রাচীন পারস্যের প্রধান দেবতা “আহুর মাজদা” এর সাথে হরমুজ প্রণালীর নামকরণের সাদৃশ্য রয়েছে।
হরমুজ প্রণালীর ভৌগলিক অবস্থান
হরমুজ প্রণালী মূলত একটি সরু জলপথ যা পশ্চিমের পারস্য উপসাগরকে পূর্বে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে এবং আরব উপদ্বীপ থেকে ইরানকে পৃথক করেছে। অপরদিকে ৩৪ কি.মি. দীর্ঘ এই প্রণালীটি পারস্য উপসাগরের মধ্য দিয়ে ওমান ও ইরানকে সংযুক্ত করেছে।

হরমুজ প্রণালীর সর্বনিম্ন প্রশস্ত পয়েন্ট ২১ মাইল ও দৈর্ঘ্য ১০৩ মাইল। হরমুজের সর্বনিম্ম প্রশস্ততা ২১ মাইল হলেও শিপিং লাইনের প্রশস্ততা মাত্র ১ দশমিক ৮৬ মাইল ( আনুমানিক ২ মাইল )। এটি একটি আন্তর্জাতিক জলপথ।পারস্য উপসাগর ও ওমান সাগরকে সংযুক্তকারী এই প্রণালীটি ভৌগলিকভাবে গুরুত্ব বহন করে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। এই সরু জলপথটি আরব দ্বীপে অবস্থিত দেশসমূহ থেকে ইরানকে আলাদা করেছে।
এর একপাশে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল বন্দর আব্বাস এবং অন্যপাশে ওমান, আরব আমিরাত ও সৌদি আরব অবস্থিত এই প্রণালীর যে বিষয়টি বিষ্ময় সৃষ্টি করে তা হলো এর শিপিং লাইনের প্রশস্ততা আনুমানিক দুই মাইল ( ৩ কি.মি. ) হওয়া সত্বেও সবচেয়ে বড় আকারের জাহাজও এর মধ্য দিয়ে চলাচল করতে সক্ষম।
আরো পড়ুন মরক্কোর জাতীয়তাবাদি আন্দোলন ও সুলতান মুহাম্মাদ
হরমুজ প্রণালীতে দ্বীপ ও বন্দরসমূহ
হরমুজ প্রণালীতে বেশ কয়েকটি দ্বীপ রয়েছে তারমধ্যে হরমুজ দ্বীপ, কাসেম দ্বীপ অন্যতম। এসব দ্বীপ এবং হরমুজ প্রণালীর উত্তর ও দক্ষিণ উপকূলজুড়ে রয়েছে কয়েকটি বন্দর। জানা যায়, প্রাচীন কাল থেকে চীন, ভারত ও আফ্রিকার সাথে মধ্য প্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যক কেন্দ্র ছিল। হরমুজ প্রণালীতে যে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ দ্বীপ রয়েছে তা ইরান থেকে ৫ মাইল দূরে এবং এটি ইরানের হরমমোজগান প্রদেশের অন্তর্গত। হরমুজ প্রণালী উপকূলে অবস্থিত ইরানের সবচয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কৌশলগত নৌ বন্দর ‘বন্দর আব্বাস’ এবং ‘বন্দর আব্বাস’ শহর। বন্দর আব্বাস হরমোজগান রাজ্যের রাজাধানী।
ভৌগলিক অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এর গুরুত্ব বহু বছর ধরেই বিদ্যমান।
বর্তমানে যেমন নৌ-শক্তিতে হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব রয়েছে তেমনি বাইবার্স, মামলুক, উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলেও এর গুরুত্ব ছিল। হরমুজ প্রণালীকে কেন্দ্র করেই ১৪৫৩ সালে কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করেন ওসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ।
সামরিক ভাষায় এ ধরনের ভূখন্ডকে বা জলখন্ডকে Checkpoint বা প্রধানকেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্রের সুবিধা নিয়েই উইলিয়াম ওয়ালেস ইংরেজদের বিরুদ্ধে আর গ্রীকরা পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। অবস্থানগত সুবিধার কারণে দুর্বল এবং অল্পসংখ্যক শক্তি দিয়ে বিশাল কোনো বাহিনীকে সহজেই রুখে দেওয়া যায়।
সমকালীন বিশ্ব অর্থনীতিতে হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব
হরমুজ প্রণালী সংকীর্ণ হতে পারে কিন্তু জ্বালানী তেল বহনের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ চলাচল করার জন্য হরমুজ প্রণালী যথেষ্ট গভীর এবং চওড়া। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জালানি পন্য পরিবহন রুট হলো হরমুজ প্রণালী। বিশ্ব জ্বালানি নিরাপত্তা মূলত নির্ভরশীল হরমুজ প্রনালীর ওপর। কারণ সমুদ্রপথে বিশ্বে যত পেট্রোলিয়াম বা জ্বালানি পন্য পরিবহন করা হয় তার তিন ভাগের এক ভাগ বহন করা হয় এ প্রণালী দিয়ে।
পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতিতে হরমুজ প্রণালী
ইরাক, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমুদ্র যোগাযোগ এ প্রণালীর ওপর সম্পূর্ণরুপে নির্ভরশীল । এসব দেশগুলোর উন্মুক্ত সমুদ্র পথে বের হওয়ার আর কোনো জলপথ নেই। সৌদি আরবও আরব সাগরের যাতায়াতের জন্য এ প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল । Energy Information Administration বা EIA এর তথ্যানুসারে, পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের রপ্তানীর প্রায় ৮০ শতাংশ হরমুজ প্রণালী দিয়ে সরবরাহ করে থাকে।
ওপেকভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, তেল রপ্তানিকারক ওপেকভুক্ত দেশগুলোর তেল বাণিজ্য প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল হরমুজ প্রণালীর ওপর। ফলে কৌশলগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ জলপথ।
অন্যদিকে এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে, চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরসহ এশিয়ার বাজারে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি পণ্য রপ্তানী নির্ভরশীল হরমুজ প্রণালীর ওপর।এশিয়ার ৭৬ ভাগ জ্বালানি পন্য বহন করা হয় হরমুজ প্রণালী দিয়ে।
তেল পরিবহণ
বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিবহণের একটা বিশাল অংশ জলপথে পরিচালিত হয়ে থাকে। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলির নৌ-পথে আমদানি-রপ্তানি, বৈদেশিক বাণিজ্য হরমুজ প্রণালীর উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। এ প্রণালীটি ৬০ কিমি এর বেশি লম্বায় না হলেও এ পথ দিয়ে প্রতি ১০ মিনিটে একটি তেলবাহী ট্যাংকার বের হয়ে আসে। এই তেল সারা বিশ্বের প্রয়োজনীয় তেলের ৬২%। প্রতি ১০ মিনিটে যে তেলবাহী ট্যাংকার বের হয়ে আসে তা জাপানের প্রয়োজনীয় তেলের ৫০%, পশ্চিম ইউরোপীয়দের প্রয়োজনীয় তেলের ৪০%, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় তেলের ৫%। এছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশ, এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ছাড়াও নিকটপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ ওশেনিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে তেল রপ্তানীর অন্যতম রুট। এই প্রণালী দিয়ে ১৪ টি তেলবাহী সুপার ট্যাংকার ১৫.৫ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল নিয়ে যাতায়াত করতে পারে। হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমে সরবরাহকৃত তেল পাশ্চাত্য দেশসমূহের উন্নয়নশীল কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। বিশ্বের অপরিশোধিত তেলের ৫৭% মজুদ এই দেশগুলোতে রয়েছে। এছাড়া এই অঞ্চলে বিশ্বের ৪৫% গ্যাস মজুদ রয়েছে।
আরো পড়ুনঃ আমাদের কাছে আফগানিস্তানের কী পাওনা?
গ্যাস রপ্তানীতে হরমুজ প্রণালী
বিশ্বের তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের তিন ভাগের এক ভাগ বহন করা হয় হরমুজ প্রণালী দিয়ে। বিশ্বের অন্যতম বড় তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদক কাতার এই গ্যাসের প্রায় পুরোটাই হরমুজ প্রণালী দিয়ে বহির্বিশ্বে রপ্তানি করে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
হরমুজ প্রণালী বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম সমুদ্রপথ। এই প্রণালী হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিদিন ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল সরবরাহ করে থাকে আরব দেশগুলো, যার ৭৬ ভাগেরই গন্তব্য চীন, জাপান, ভারতসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে। অর্থের হিসেবে প্রতিদিন হরমুজ প্রণালী দিয়ে ১.১৯৭ বিলিয়ন ডলারের তেল রপ্তানি করে ওপেকভুক্ত আরব দেশগুলো। প্রতি বছর বিশ্বের মোট তেল চাহিদার ২০ শতাংশই হরমুজ প্রণালী দিয়ে যায়।
পশ্চিমা বিশ্বে তেল রপ্তানীতে হরমুজ প্রণালী
হরমুজ প্রণালী হয়ে সিংহভাগ তেল এশিয়ার দেশগুলোতে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর জন্যও এই সমুদ্রপথ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই এলাকার তেল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সিংহভাগ শেয়ার মার্কিন ও পশ্চিম ইউরোপের ধনী দেশগুলোর হওয়ায় এসব দেশের অর্থনীতি কোনো না কোনোভাবে তেল উত্তোলন ও বিপণনের সাথে জড়িত। সুপার ট্যাংকারগুলির কোনোটা নির্ভয়ে পূর্বদিকে জাপান, চীন, ভারত এবং পশ্চিম দিকে ইয়েমেনের উপকূল ধরে লোহিত সাগর ও সুয়েজখাল হয়ে ইউরোপে যাত্রা করে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে ৩০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রপ্তানি হয়ে থাকে, যার মূল্য প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ডলার এবং দেশটির মাসিক আমদানিকৃত তেলের ১০ শতাংশ। মার্কিন জ্বালানী তথ্য প্রশাসন মতে, ২০০৯ সালে সমুদ্রপথে বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের ৩৩ শতাংশ হরমুজ প্রণালী দিয়ে সম্পাদিত হয়। ২০১০ সালে হরমুজ প্রণালী প্রথমবারের মতো জঙ্গিদের হামলার শিকার হয়। এ অঞ্চল দিয়ে তেল পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে।
একনজরে হরমুজ প্রনালী:
- ২০০৭ সালে বিশ্বের ৪০ ভাগ জ্বালানি পন্য বহন করা হয় হরমুজ প্রনালী দিয়ে;
- ২০০৭ সালে বিশ্বের ৪০ ভাগ জ্বালানি পন্য বহন করা হয় হরমুজ প্রনালী দিয়ে;
- যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন এডমিনিস্ট্রেশন এর তথ্য অনুসারে, ২০১১ সালে সমুদ্র পথে বহনকৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ৩৫ ভাগ বহন করা হয় হরমুজ প্রণালী দিয়ে;
- যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন এডমিনিস্ট্রেশন এর তথ্য অনুসারে, ২০১৮ হরমুজ প্রণালী দিয়ে দৈনিক ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল তেল পরিবহন করা হয়;
- ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ ভাগ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানী হয় এ প্রণালী দিয়ে;
- ২০১৮ সালে বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের ৫ ভাগের এক ভাগ পরিবহন করা হয়েছে এ প্রণালী দিয়ে;
- ২০১৯ সালে হরমুজ প্রণালী দিয়ে একদিনে ১ কোটি ৯০ লক্ষ ব্যারেল খনিজ তেল পরিবাহিত হয়।
হরমুজ প্রণালীর উপর ইরানের প্রভাবঃ ইরান কি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করতে পারে?
ভৌগলিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রণালী। যদিও ইরানের অনেকাংশ জুড়েই হরমুজ প্রণালীর অবস্থান, তবুও শুধু ইরানের জন্য নয়, ইরানের প্রতিবেশি, প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রণালী।
হরমুজ প্রণালীর একদিকে আছে আমেরিকার মিত্র আরব দেশগুলো, অন্য পাশে রয়েছে ইরান। হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সংকীর্ণ যে অংশ সেখানে ইরান এবং ওমানের দূরত্ব মাত্র ২১ মাইল। এই স্থানটির মাত্র ৩ কিমি এর মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল করতে পারে। স্থানটিতে ইরানের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে এটি ( ৩ কিমি) ইরানের প্রাণস্বরুপ।
এছাড়াও স্বাভাবিকভাবেই হরমুজ প্রণালী ইরানের জ্বলানী তেল রপ্তানীর প্রধান রুট। ইরানের মোট রপ্তানী আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ আসে জ্বালানী তেল রপ্তানীর মাধ্যমে। ২০১৭ সালে ইরান ৬৬০০ কোটি ডলারের তেল রপ্তানী করেছে। যার প্রায় পুরোটাই এই পথেই রপ্তানি করা হয়েছে। ইরান প্রতিদিন ২২ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল তেল রপ্তানি করে থাকে।
এছাড়াও হরমুজ প্রণালীর প্রবেশপথে আবু মূসা বড় টাম্ব ও ছোট টাম্ব দ্বীপগুলোর অবস্থানের কারণে এই প্রণালীর গুরুত্ব তাৎপর্যভাবে বেড়ে গেছে। এদের তুলনা করা যায় জিব্রাল্টার বা এডেন এর গুরুত্বের সাথে। হরমুজ প্রণালীসহ এই দ্বিপগুলো যে শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে সে দেশ বা শক্তি এই অঞ্চলটির রাজনীতি, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে লাভবান হবে।
হরমুজ প্রণালী বন্ধের প্রশ্নে ইরান আনুপাতিকহারে ক্ষমতাশালী হলেও, ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী জোটের কাছে ইরানও আটকা পড়ে আছে। ১৯৮২ সালে স্বাক্ষরিত সমুদ্র আইন সম্পর্কিত কনভেনশনে ইরান সরকার ১৯৮২ সালে তাতে স্বাক্ষর করলেও সেদেশের সংসদে অনুমোদিত হয়নি৷ এক্ষেত্রে হরমুজ প্রণালী বন্ধে আইনের মারপ্যাঁচে ইরান নিজেদের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে পারে। যদি ইরান কোনোভাবে কয়েক সপ্তাহের জন্য এই স্থানটি বন্ধ করে দেয় তাহলে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাবে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারতের মতো দেশগুলো। একইসাথে মধ্যপ্রাচ্যের তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
তবে এই প্রণালী ব্যবহারে বাধা দিয়ে ইরান তাঁর প্রতিবেশি দেশ এবং শত্রুর ক্ষতি করলেও নিজেরাও বেশ বিপদে পড়ে যাবে। যদি বন্ধ করে তাহলে ইরানের তেল বাণিজ্যও সীমিত এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। কারণ প্রণালীর অপর পাশেই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র তথা ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থান আর তাদের পেছনে বড় ভাই সৌদি আরব, কুয়েতের অবস্থান। এসব দেশ ইরানকে ছাড় দেবেনা এটা নিশ্চিত। তবে ইরানের নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই ইরান হরমুজ প্রণালীর ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। এটা ইরানকে নিজের স্বার্থেই করতে হবে, এ স্বাধীনতা ইরানের আছে।
শেষকথা
হরমুজ প্রণালীকে তেলের প্রণালী বললেও ভুল হবে না কারণ এই হরমুজ প্রণালীর স্থবিরতা ও উত্তেজনার উপরই বিশ্ব বাজারে তেলের দাম উঠানামা করে। মাত্র এই ৩৪ কিলোমিটার এলাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করাটাও বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্য ও বিশ্ব রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, সমকালীন বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর অবদান কম নয়। বিশ্ব অর্থনীতি যতদিন তেলের উপর নির্ভরশীল থাকবে ততদিন এই প্রণালী থেকে তেল পরিবহনে কিছুটা বা অল্প সময়ের জন্য বিঘ্ন ঘটলেও তেলের বাজারে সেটির নাটকীয় প্রভাব পড়তে বাধ্য। হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা ও আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব চলে আসছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হরমুজ প্রণালীর আংশিকও যদি বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ব জ্বালানী বাজার উলট-পালট হয়ে যাবে।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।