বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের বীর সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অনেক ভিনদেশী বীর সন্তানও সংগ্রাম করেছেন নিজের জীবন বাজি রেখে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম এক ব্যক্তির গল্পই বলবো যার প্রত্যক্ষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীর প্রতীক প্রদান করে। একটি ভিনদেশের নাগরিক এদেশের হয়ে যুদ্ধ করেছেন, এমন দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃপ্রেমের উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখা বিদেশীদের মধ্যে বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র ব্যক্তি তিনি। বাংলাদেশের প্রতি অপরিমেয় ভালবাসার জন্য বাঙ্গালী জাতির কাছে তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বলছি উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড এর কথা।

প্রারম্ভিক জীবন

উইলিয়াম ওডারল্যান্ডের পুরো নাম উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড। ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম শহরে জন্ম তাঁর। অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া ছেড়ে বাটা সু কোম্পানিতে সু-শাইনার বা জুতা পালিশকরের চাকুরি নেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে। দু’বছর পর চাকুরি ছেড়ে তিনি জাতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত রয়্যাল সিগন্যাল কোরে সার্জেন্ট পদে কর্মরত থাকেন। তিনি একজন ওলন্দাজ-অজি সামরিক কমান্ডো অফিসার ছিলেন। এরপরে সেনাবাহিনীর চাকুরি ছেড়ে ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কমান্ডো হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অসীম সাহসিকতার এই ব্যক্তিটি ঢাকায় বাটা স্যু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নেদারল্যান্ডস থেকে ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রথম ঢাকায় আসেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডঃ ব্রিটিশ সভ্যতার নৃশংস উপহার

স্বাধীনতা যুদ্ধে ওডারল্যান্ড

টঙ্গীর বাটা জুতো কারখানায় কর্মরত অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শ্রমিক-জনতার মিছিলে ইপিআর-এর সদস্যদের গুলিবর্ষণের ঘটনা অনে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৭১-এ মার্চের গণ আন্দোলন, ২৫ মার্চ এর অপারেশন সার্চলাইট এবং এর পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকান্ড ও নৃশংস বর্বরতা দেখে হন ব্যথিত ,মর্মাহত এবং সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার। বাটা স্যু কোম্পানীর মত বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়াতে পশ্চিম পাকিস্তানে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল তাঁর। এই সুবিধার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারক মহলে অনুপ্রবেশ করার এবং বাংলাদেশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার।

উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড ছিলেন একজন ওলন্দাজ-অজি সামরিক কমান্ডো অফিসার। ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম শহরে জন্ম তাঁর। অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া ছেড়ে বাটা সু কোম্পানিতে সু-শাইনার বা জুতা পালিশকরের চাকুরি নেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে।  maroonpaper.com

ওলন্দাজ গোপন প্রতিরোধ আন্দোলনের হয়ে গুপ্তচর হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ওডারল্যান্ড প্রথমে অন্তরঙ্গ সখ্যতা গড়ে তোলেন ঢাকা সেনানিবাসের ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্ণেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে। সেই সুবাদে ঢাকা সেনানিবাসে অবাধ যাতায়াত শুরু হয় তাঁর। এতে তিনি পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হতে থাকলেন আরো বেশি সংখ্যক সিনিয়র সেনা অফিসারদের সাথে। এর এক পর্যায়ে লেফট্যানেন্ট জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, এডভাইজার সিভিল এফেয়ার্স মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি সহ আরো অনেক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার তাকে ‘সম্মানিত অতিথি’ হিসাবে সম্মানিত করে। এই সুযোগে তিনি সব ধরনের ‘নিরাপত্তা ছাড়পত্র’ সংগ্রহ করেন। এতে করে সেনানিবাসে যখন তখন যত্রতত্র যাতায়াতে তার আর কোন অসুবিধা থাকল না। ওডারল্যান্ড প্রায়শঃ সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানীদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করলেন। এসকল সংগৃহীত সংবাদ তিনি গোপনে প্রেরণ করতেন ২নং সেক্টর এর ক্যাপ্টেন এ. টি. এম. হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার মেজর (পরবর্তীতে লেফটেনেন্ট জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমান এর কাছে। তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতেন।

Noam Chomsky: the most heated and unpleasant spokesperson of this Century

অকুতোভয় উইলিয়াম ওডারল্যান্ড ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্যরূপে তার কর্মস্থল বাটা কারখানা প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই যুদ্ধে নেমে পড়েন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তার পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। মেজর হায়দারের দেয়া এক সনদপত্রের সূত্রে জানা যায় যে, ওডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, নগদ অর্থ, চিকিৎসা সামগ্রী, গরম কাপড় এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলোকচিত্র তুলে গোপনে বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন তথ্যমাধ্যমে পাঠাতে শুরু করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। এ বিষয়ে ওডারল্যান্ড নিজেই লিখেছেন, “ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানো উচিত।” ইউরোপে ফেলে আসা যুদ্ধস্মৃতির ২৯ বছর পর ১৯৭১ সালে টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানী সেনাদের মধ্যে আবার তিনি সাক্ষাৎ পেলেন নাৎসি বাহিনীর। টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা নৃশংস হত্যাকাণ্ড, বীভৎস মরণযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে তিনি ব্যথিত হন। তাই ওডারল্যান্ড ছবি তোলা রেখে সরাসরি যুদ্ধে অংশ্রগহণের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকার তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনারের পরামর্শ পেতেন।

আমাদের কাছে আফগানিস্তানের কী পাওনা?

স্বীকৃতি

ওডারল্যান্ডের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য নৈপুণ্যতার কারণে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরপ্রতীক সম্মাননায় ভূষিত করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর প্রতীক পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় তার নাম ২ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর তালিকায় ৩১৭ নম্বর। ১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে ওডারল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু অসুস্থ থাকার কারণে তিনিআসতে পারেননি। তিনি বীর প্রতীক পদকের সম্মানী ১০,০০০ টাকা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে দান করে দেন। একমাত্র বিদেশি হিসেবে তাকে বাংলাদেশ সরকার এই খেতাবে ভূষিত করেছে। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত অত্যন্ত গর্ব ভরে ও শ্রদ্ধার্ঘ্য চিত্তে নামের সঙ্গে বীর প্রতীক খেতাবটি লিখেছিলেন তিনি।

২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গুলশান-২-এর ৮৪ নম্বর সড়টির নামকরণ করা হয় অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক বীর প্রতীক ডাব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড সড়ক। maroonpaper.com

জীবনের সমাপ্তি

১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পূর্বতন কর্মস্থলে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে নিজ দেশ অস্ট্রলিয়ায় চলে যান। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পার্থের এক হাসপাতালে ২০০১ সালের ১৮ মে উইলিয়াম ওডারল্যান্ড মৃত্যুবরণ করেন; রেখে যান তাঁর স্ত্রী মারিয়া ও একমাত্র কন্যাকে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে প্রায়ই তিনি তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে বলতেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের ভালবাসা; পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আবেগের এ ধারা অব্যাহত রেখো।’(মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান)

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক রাজনীতি রাকিবুল ইসলামের বিশেষ আগ্রহের বিষয়। তাঁর লেখালেখির মূল বিষয়বস্তু হলো রাজনীতি, সরকার, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

  • আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

  • ইক্যুইটির ম্যাক্সিম

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা

  • আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা

আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

  • পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয়

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।