শুরুতেই বলে নেই যে, ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত (১৬ মে ২০১৬) হেড টু হেডে আসা ৩০ জন অতিথির প্রত্যকের প্রতি আমার পরম শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা। অক্সফোর্ড ইউনিয়নে ৩০০ বা তারও বেশি লোক এবং বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেলের সামনে বসে, প্রথমে আমার, এরপর প্যানেলিস্ট এবং তারপরে দর্শকদের দ্বারা ঘন্টাব্যাপি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়াটা এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। ইতোপূর্বে যারা অতিথি হয়ে এসেছেন তারা হেড টু হেড শো’য়ের অভিজ্ঞতাকে “কঠিন”, “উত্তপ্ত”, “চ্যালেঞ্জিং” এবং “উচ্চ মাত্রার” বলে বর্ণনা করেছেন। তাই সমস্ত কৃতিত্ব আমেরিকার ডেমোক্রাট এবং সাবেক কূটনীতিক মার্টিন ইন্ডিককে হেড টু হেডের সর্বশেষ বিতর্কে আমন্ত্রণ গ্রহণ ও মার্কিন-ইসরাইল জোটের পক্ষ নেয়ার জন্য।
শান্তি প্রক্রিয়া ইতিহাসের পুণর্লিখন
হেড টু হেড– ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিষয়ে আমেরিকার কি নিরপেক্ষ থাকা উচিৎ?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অধীনে ইসরাইল-ফিলিস্তিনের বিশেষ দূত এবং প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের অধীনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করা ইন্ডিক, বেশ হাসিখুশী, বাকপটূ এবং বলিষ্ঠতার সাথে বলেছেন যে, “শেষঃনিশ্বাস” পর্যন্ত তিনি “সংঘাত সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।”
তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সহজভাবেই অকপট ছিলেনঃ আমেরিকার নিরপেক্ষতার অভাব থেকে (“আমরা নিরপেক্ষ নই; আমরা নিজেদের নিরপেক্ষ বলে দাবি করিনা”) শুরু করে ইসরাইলি সেটেলমেন্ট ইস্যুতে (“হ্যা, আমাদের ডাবল স্টান্ডার্ড আছে”) আমেরিকার ডাবল স্ট্যান্ডার্ড পর্যন্ত (“সেটলমেন্টই আলোচনাটাকে [জন কেরির] নষ্ট করে দিয়েছে”)।
সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত (ইন্ডিক) এমনকি গত তিন দশকেরর কূটনৈতিক ব্যর্থতার জন্য নিজের দায় স্বীকার করেছেন।
ক্লিনটন প্যারামিটার
তবে যুক্তরাজ্যে ইসরাইলি দূতাবাসের মূখপাত্র ইফতাহ কুরিয়েল, এইসব স্বীকারোক্তি এড়িয়ে যাওয়াটাই বেছে নিয়েছেন।
কুরিয়েল বরং, ৪৮ মিনিটের সাক্ষাতকার থেকে ২৯ সেকেন্ডের ক্লিপ শেয়ার করেছেন যেখানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত “ক্লিনটন প্যারামিটারস” নামে পরিচিত মার্কিন শান্তি উদ্যোগ, ডিসেম্বর ২০০০ এর কথা তুলে ধরেছেন।
ইসরাইলের মুখপাত্র ওই ক্লিপটিকে শো’য়ের “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৩০ সেকেন্ড” বলে শেয়ার করেছেন কারণ, স্পষ্টভাবেই তা “শান্তি বিষয়ে ইসরাইলের প্রমাণপত্র”।
কুরিয়েলের টুইটটি এ পর্যন্ত কয়েকজন ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত শেয়ার করেছেন, তার মধ্যে না বললেই নয় এমন একজন মার্কিন ইসরাইলী সমর্থক, বুশের বক্তৃতা লেখক, ডেভিভ ফ্রাম। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বিদেশ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রধান পিটার লার্নার ওই টুইটটি রিটুইট করেছেন এই দাবী করে যে, মার্টিন ইন্ডিক “ভ্রান্ত মেহেদি হাসানের বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করেছেন”।
শরণার্থী সংকট নিয়ে নোয়াম চমস্কি
সাধারণত, একবার সম্প্রচার হয়ে গেলে হেড টু হেডের শো’য়ের কোন বিষয় নিয়ে আমি পূনরায় তর্ক করিনা, কিন্তু এবার, আমি আর উত্তর না করে পারলাম না।
প্রথমত, এখানেই কুরিয়েল এবং অন্যান্য ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মধুর বিড়ম্বনা, যারা “ক্লিনটন প্যারামিটার” সমর্থন করে বলে মনে হচ্ছে, যেখানে ইসরাইলি সেটলমেন্টকে সংযুক্ত করে ইসরাইল রাষ্ট্রের বিনিময়ে পশ্চিম তীরের একটা বড় অংশকে নিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেছে।
ভুলে যাওয়া যাবে না যে, কুরিয়েল যে সরকারের মুখপাত্র, নেতানিয়াহুর বর্তমান ইসরাইল সরকার, যার লিকুদ পার্টি সেই সময় ক্লিনটন প্যারামিটারের বিরোধিতা করেছিল এবং যারমধ্যে প্রায় ডজন খানেক উচ্চপদস্থ মন্ত্রী প্রকাশ্যে এবং গর্বের সাথে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এবং সর্বোপরি, যেকোন ধরণের দ্বৈত-রাষ্ট্র সমাধানকে নাকচ করেছিলেন, যেমনটা আমি আগেই তুলে ধরেছিলাম।
স্পষ্টতই ভুল
দ্বিতীয়ত, যেমনটি ভিডিও ক্লিপটিতে, জোরপূর্বক এগোনোর যুক্তিটি সম্পূর্ণ এবং প্রমাণিতভাবে ভুল। এখানে ইন্ডিক এবং আমার মধ্যে সম্পূর্ণ কথোপকথনের একটি প্রতিলিপি রয়েছে, যেমনটি টুইটারে কুরিয়েলের শেয়ার করা ক্লিপটিতে রয়েছে:
মার্টিন ইন্ডিকঃ “না, ক্লিনটন তাদের [ফিলিস্তিনিদের] যা প্রস্তাব করেছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিতেই এটি রয়েছে।“
মেহেদি হাসানঃ “এবং উভয় পক্ষই ক্লিনটন প্যারামিটার, ডিসেম্বর, ২০০০-এ শর্ত রাখার প্রস্তাব করেছিল, যেমনটা আপনিই ভাল জানেন।“
মার্টিন ইন্ডিকঃ “না, বারাক[ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী] সেসব মেনে নিয়েছিলেন।“
মেহেদি হাসানঃ এটা সত্য নয়, তবে এব্যপারে সম্মতি জানাতে আমাদের অসম্মতি জানাতে হবে।
ইউক্রেন রাশিয়া সংকটের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
মার্টিন ইন্ডিকঃ “ আমি সেখানে ছিলাম…”
মেহেদি হাসানঃ “ঠিক আছে।“
মার্টিন ইন্ডিকঃ “…যখন ক্লিনটন প্যারামিটার মেনে নিয়ে বারাকের অফিস থেকে ফ্যাক্সে
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর সইসহ ইসরাইলের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত আসে। তাই আমাকে বলবেন না যে, আমি যা নিয়ে কথা বলছি তা আমি জানিনা।“
পরিষ্কার করা উচিতঃ ইন্ডিক দাবি করছেন যে, কোন ধরণের শর্ত ছাড়াই ইসরাইল ক্লিনটন প্যারামিটার মেনে নিয়েছে যেখানে ফিলিস্তিন শর্তসহ কিংবা ছাড়া কোনটাই মেনে নেয়নি।
বাস্তবে এটা অসত্য। এর জন্য আমার কথা গোনায় ধরবেন না। মরহুম ইয়াসির আরাফাতের কথাও গোনায় ধরবেন না। এমনকি হারেৎযের কূটনৈতিক সংবাদদাতা ইসরাইলি সাংবাদিক বারাক রাভিদের কথাও গোনায় ধরবেন না যিনি, কুরিয়েলের টুইটের প্রতিউত্তর করেছিলেন যে, “মার্টিনই [ইন্ডিক] ভুল এবং আমার কাছে প্রমাণ আছে। বারাকের উত্তর ছিল ‘হ্যা, তবে’।“
বরং ক্লিনটন এডমিনিস্ট্রেশনের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিকে গোনায় ধরুন যেখানে ইন্ডিক কাজ করেছে। ক্লিনটন, বারাক এবং আরাফাতের কয়েকদফা ফোনকলের পর ২০০১ সালের ৩ জানুয়ারিতে, হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জ্যাক স্যুয়ার্টকে উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার বলেছেনঃ “ চেয়ারম্যান আরাফাত প্রেসিডেন্টকে বলেছেন তিনি প্রেসিডেন্টের প্যারামিটার মেনে নিয়েছেন। একইসাথে তিনি কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছেন। তার মানে দাড়ালো, এখন দুই পক্ষই কিছু শর্তসাপেক্ষে প্রেসিডেন্টের মত মেনে নিয়েছেন। এটা একধাপ এগিয়ে যাবার প্রতীক।
মার্কিন পররাষ্ট্র মুখপাত্র রিচার্ড বাউচার একই দিনে সাংবাদিককের ব্রিফ করার সময়ে স্যুয়ার্টের কথারই পূণরাবৃত্তি করেছেন প্রায় একই ভাষায়ঃ
“উভয় পক্ষই প্রেসিডেন্ট প্যারামিটা, প্রেসিডেন্টের মত মেনে নিয়েছেন, তবে উভয় পক্ষেরই শর্ত আছে।“
ক্লিনটন নিজেও ৭ই জানুয়ারি ২০০১-এ অনুষ্ঠিত ইসরাইলের প্লিসি ফোরামের বক্তব্যে তার কর্মকর্তাদের ভাষাই ব্যবহার করেছেনঃ “প্রধানমন্ত্রী বারাক ও চেয়ারম্যান আরাফাত উভয়ই প্যারামিটারকে পরবর্তি পদক্ষেপের ভিত্তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। উভয়ই কিছু শর্ত আরোপ করেছেন।“
যদি ইন্ডিক এবং কুরিয়েল বিশ্বাস করেন যে, ফিলিস্তিন কখনোই প্যারামিটার মেনে নিতে ও ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তি করতে চায়নি, ভাল। তারা তা মনে করুক। যদিও ঐতিহাসিক সত্য ভিন্ন কথা বলে।
অন্যতম মার্কিন কূটনীতিবিদ ও ইসরাইলের কট্টর সমর্থক প্রয়াত ড্যানিয়েল প্যাটরিক ময়নিহানের উক্তি উদ্ধৃতি করতে হয়ঃ “প্রত্যেকের নিজস্ব মতামতের অধিকার রয়েছে, কিন্তু তার নিজের তথ্যের জন্য নয়।”
মেহেদী হাসানের 'Rewriting the history of the peace process'-এর মূল প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করা
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।
গাজায় যুদ্ধবিরতিঃ সহিংসতার সাময়িক বিরতি নাকি স্থায়ী শান্তির পথ?
যুগ যুগ ধরে সংঘাত চলমান গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এক গভীর প্রশ্ন উঠে আসে: এটি কি সহিংসতার একটি সাময়িক বিরতি, নাকি একটি স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা?
গাজা যুদ্ধ বিরতি চুক্তিঃ ইসরায়েল ও হামাসের ঐতিহাসিক সমঝোতা
দীর্ঘ ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর, অবশেষে ইসরায়েল ও হামাস গাজায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। কাতারের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় দোহায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।