ঘটনা আর উপাদান যদি একই হয় তবে সে গল্পের লেখনী কিংবা কথনে কতোইবা রং মেশানো যায়?স্বাদ আর ভিন্নতা আমদানির জায়গাই বা কতো প্রশস্ত? তবু আমি সে গল্পে ভিন্নতা আর স্বাদ মেশাতে রাগ জাগা কলম চালাই অবিরাম, অবলীলায়। উপরে আকাশ ভারি, প্রিয় পাখি ডাকছে, প্রকৃতি নিশ্চুপ,কানে বাতাসের গান বাজছে বটে আর আমি? আমি নিভু নিভু আলোতে চেয়ারি হয়ে এই ভার্চুয়াল স্ক্রিনে বুড়ো আঙুলে গল্প সাজাই। পরিণামের গল্প। ওহ হ্যাঁ! কারো কারো আবার সফলতার গল্প। আজকে একটা ছবির গল্প বলবো। যাকে আপনারা ছবিগল্প কিংবা ছবিকথন ও বলতে পারেন। যুদ্ধের তাণ্ডবলীলায় উত্তরের বাতাস যখন মোড় ঘুরিয়ে নেয় তখন এরই মধ্যে কেউ একজন মৃত্যুমুহুর্ত ক্যামেরাবন্দি করে হয়ে যায় জগৎশেঠ! ওদিকে নিয়ম ভাঙতে না চেয়ে সৈনিকের স্যালুট পেতে আরেকজনকে বোচা নাকের বন্দুক থেকে গুলিটা বের করতেই হয়! কি আশ্চর্য! মাথায় দামামা বাজছে? মধ্য আকাশে উড়ন্ত পাখিটাও দেখি থমকে গেলো! দক্ষিণ দুয়ার খুলছে না এখনো? তাহলে আমি থামলাম রসের কলম আগানো।গল্পে চলি তবে? পাঠকের তো আবার যুদ্ধ যুদ্ধ সালের গল্প রসভারী লাগেনা, দু চার লাইন পড়তে পাতা উল্টায়।তাই একটু আলাপ জুড়লাম আরকি। চলুন নুয়েন ভ্যান লেমের হত্যাকান্ডর গল্পে যাই তবে তার আগে নিচের ছবি গুলোতে চোখ দিয়ে আসেন।

“ভোঁতা নাকের পিস্তল থেকে গুলিটি বেরিয়ে গেছে। যে হাতে পিস্তলটি ধরা, গুলি বেরিয়ে যাওয়ার পরের মূহুর্তের ধাক্কা সামলাচ্ছে সেই হাত। আর যার মাথার খুলিতে গিয়ে গুলিটি ঢুকছে, সেই বন্দীর মুখ কুঁকড়ে যাচ্ছে গুলির আঘাতে।ছবির ফ্রেমে বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে এক সৈন্য। ঘটনার আকস্মিকতায় তার মুখ যেন বিকৃত হয়ে গেছে।একটা মানুষ যে মুহুর্তে মারা যাচ্ছে, ঠিক সেই মূহুর্তের এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে অনেকের মনেই হয়তো বিচিত্র সব অনুভূতি খেলা করবে: একটা ধাক্কা, এক ধরণের মানসিক পীড়ন এবং কিছুটা অপরাধবোধ।”
-বিবিসি বাংলা
ঘটনাটি ১৯৫৫ সালে শুরু হওয়া দক্ষিণ ও উত্তর ভিয়েতনামের যুদ্ধকালীন সময়ের কোনো এক মুহূর্তের বর্ণনা। আদর্শের প্রশ্নে দক্ষিণ ও উত্তর ভিয়েতনাম প্রায় বিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে(১৯৫৫-১৯৭৫) লিপ্ত ছিলো।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণ
সকলেরই জানা,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদের উত্থান ঘটে। অপরদিকে রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বে কমিউনিজম বা সাম্যবাদের বিকাশ ঘটে। আমেরিকাসহ সকল পুঁজিবাদি দেশগুলো তখন কমিউনিজমের উত্থান রুখে দেওয়ার পক্ষে একজোট ছিল। এর মধ্যেই রাশিয়া তার কমিউনিজম প্রভাব বলয়ের মধ্যে পূর্ব ইউরোপসহ বুলগেরিয়া এবং জার্মানিকে টেনে আনে। অপরদিকে চীন ও কোরিয়াসহ এশিয়ার বেশ কিছু অংশে রাশিয়া তার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। পুঁজিবাদী আমেরিকা ও তার পশ্চিমা সহযোগীরা কমিউনিজমকে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিকাশের হুমকিস্বরূপ মনে করে। এই পুঁজিবাদ আর কমিউনিজম আদর্শকে কেন্দ্র করেই যুদ্ধের দামামা বাজে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামেও। এটিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জীবনে কলঙ্ক লেপনকারী সবচেয়ে কালো অধ্যায়। যুদ্ধটি দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ নামেও পরিচিত। একটা স্থিরচিত্র কিভাবে অনন্ত জীবনে পাপের ভাগীদার হয় কিংবা অন্য কাউকে করে তোলে জগৎ সেরা পুরস্কারের দাবিদার তাও এই স্থিরচিত্রের উল্লেখ্য বিষয়। একইভাবে একটা ক্যামেরাবন্দি চিত্রই পারে বিশ্বমানবতার সহানুভূতি কায়েম করে নিতে। এই লেখাটিতে ছবিকথার মাধ্যমে কিছুটা আন্দাজ পাবেন কি ছিলো দক্ষিণ ও উত্তর ভিয়েতনাম যুদ্ধের সারমর্ম। পরবর্তী কোনো লেখায় স্পষ্ট কলম ধরবো দক্ষিণ ও উত্তর ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণ,বর্বরতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ যুদ্ধে লজ্জা জনক হারের কাহিনিসম্ভার নিয়ে।
নুয়েন ভ্যান লেমের হত্যাকান্ড
সালটি ১৯৬৮, পহেলা ফেব্রুয়ারি। যুদ্ধ চলছে পুরোদমে।ফলাফলের আঁচ নেই এখনো পর্যন্ত। উত্তর ভিয়েতনামের “ভিয়েতকং গেরিলা বাহিনী“র নেতা নুয়েন ভ্যান লেম। নেমেছিলেন “টেট অফেন্সিভ” নামক আকস্মিক অপারেশনে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিভিন্ন শহরে। উদ্দেশ্য,হঠাৎ আক্রমনে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সৈন্যবাহিনী আর তাদের সহযোগী মার্কিন বাহিনীকে পর্যদুস্ত করা। তখন যুদ্ধের মাঝামাঝি অবস্থা। লেম তখন সায়গন শহরের (দক্ষিণ ভিয়েতনামর রাজধানী)একটা গণকবরের পাশে দাঁড়ানো। হঠাৎ সৈন্যরা এসে তাকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে যায় জড়াজড়ি করে। ধরে নিয়ে রাখা হয় দক্ষিণ ভিয়েতনামের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুয়েন নক লোয়ানের জিপের সামনে। লোয়ান বন্দুক বের করে মাথা তাক করলেন লেমের খুলির দিকে। মুহূর্তটা এরই মধ্যে ক্যামেরাবন্দি হয় ফটো সাংবাদিক এডি এডামসের ক্যামেরায়।

“আমি ভেবেছিলাম হয়তো লেমকে ভয় দেখানোর জন্যই তিনি পিস্তল তুলেছেন। তাই আমি স্বাভাবিকভাবেই আমার ক্যামেরা দিয়ে ছবিটা তুলি”দ
-এডি এডামস
মাটিতে মরে পড়ে আছেন লেম
বলা হয়ে থাকে লেম নাকি লোয়ানের বন্ধুর স্ত্রী সহ ছয়জনকে হত্যা করেছেন। যুদ্ধের পর কোনো এক বিবৃতিতে লোয়ান বলেন, “যদি আপনি দ্বিধা করেন, যদি আপনি আপনার দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলে সৈন্যরা আপনাকে মানবে না”, নিজের কাজের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন তিনি।এমনিতেও মার্কিনীরা বুঝতে পারছিলো এ যুদ্ধে তাদের জয় অনিশ্চিত। এডি এডামসের ক্যামেরাবন্দি ছবি ছড়িয়ে যাওয়ার পর সে সুর আরো জোরালো হয় মার্কিন সরকারের সে যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিপরীতে।এই একটা ছবিতেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রায় বিশ বছরব্যাপি যুদ্ধের বর্বরতা উন্মোচিত হয়েছিলো ভিয়েতনাম যুদ্ধের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং বিখ্যাত ছবিগুলোর এটা একটা যেটা তুলেছিলেন এডি এডামস। এই ছবি বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং পত্রিকায় চাপা হয় সে সময়। রীতিমত বিখ্যাত হয়ে পড়েন ফটো সাংবাদিক এডি এডামস।পরবর্তীতে এর জন্য তাকে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডঃ ব্রিটিশ সভ্যতার নৃশংস উপহার

ছবির জন্য প্রচুর প্রশংসা কুড়ালেও সারা জীবন এটির স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফিরেছে। তাই পুরস্কার গ্রহণকালে এডামস দুঃখ করে বলেছিলেন, “একজন মানুষ আরেক মানুষকে হত্যা করছে, আর এই ছবি দেখিয়ে আমি অর্থ পাচ্ছি”
পুলিৎজার পুরস্কার গ্রহণকালে এডি এডামস
যুদ্ধ পরবর্তিতে লেমের হত্যাকারীর জীবনযাপন
ঐদিকে এডি এডামস এবং ব্রিগেডিয়ার লোয়ানের মধ্যে যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিল আরও বহু বছর। ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষের দিকে ব্রিগেডিয়ার লোয়ান পালিয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে মার্কিন ইমিগ্রেশন তাকে গ্রহণ করতে চায়নি বিখ্যাত ওই ছবির কারনে। মার্কিনীরা এডি এডামসকে অনুরোধ করেন লোয়ানের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে কিন্তু এডামস লোয়ানের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন!! শেষ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার লোয়ান যুক্তরাষ্ট্রে থাকার অনুমতি পেলেও অতীত তাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে বাকি জীবন।যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ভিয়েতনামী খাবারের একটা রেস্টুরেন্ট খোলেন কিন্তু তাতে সফলতা ধার ঘেষে নি। তার ইতিহাস আমেরিকাব্যাপি জানাজানি হবার পর ব্যবসায় মার খেতে থাকে এবং অনেকে নাকি তার রেস্টুরেন্টের টয়লেটে তার বিরুদ্ধে আজে বাজে কথা লিখে আসতো। যে কোন প্রতীকের মতোই এই একটি ছবি আসলে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত সব যুদ্ধের বর্বরতাকে মূর্ত করে রেখেছে।
নোট: পুলিৎজার পুরস্কার (ইংরেজিতে: Pulitzer Prize ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং সঙ্গীতের সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে বহুল সমাদৃত। হলুদ সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম জোসেফ পুলিৎজার নামক এই হাঙ্গেরীও মার্কিন সাংবাদিক এই পুরস্কারের প্রচলন করেন। মোট ২১টি ক্ষেত্রে এই পুরস্কার দেয়া হয়।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।