ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পদে সমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত। প্রাচীন গৌড়ের রাজধানী হিসেবে শিবগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও দর্শনীয় নিদর্শন হিন্দু শাসন আমলে বিশেষ করে সেন বংশের শেষ রাজাদের খননকৃত দিঘী ও সুলতানী আমলে মুসলিম সুলতানদের নির্মিত মসজিদই এ উপজেলার প্রধান ঐতিহাসিক স্থাপনা। প্রাচীন গৌড়ে সুলতানী আমলের স্থাপত্যকর্ম সমূহের মধ্যে ছোট সোনা মসজিদ, খনিয়া দীঘি ও মসজিদ, দারাসবাড়ি মাদ্রাসা ও মসজিদ, তাহাখানা কমপ্লেক্স উল্লেখযোগ্য। এই স্থাপত্যগুলো নির্মিত হয়েছিল মূলত দেশীয় ও দিল্লির রাজকীয় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে।
প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় বর্তমান ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল মালদা-চাপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে অবস্থিত। গঙ্গার ৪০ কিলোমিটার ভাটিতে ও মালদার ১২ কিলোমিটার দক্ষিনে এর অবস্থান ছিল। তবে ধীরে ধীরে গঙ্গার প্রবাহ শহর থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। সেন আমলে এই শহর উন্নতি লাভ করে। সেন রাজা লক্ষণের নামানুসারে এই শহরের নামকরণ করা হয়।
বাংলায় সুলতানী শাসনামলের স্থায়িত্ব ছিল ১৪, ১৫ ও ১৬ শতক জুড়ে। এসময় সুলতানি শাসকেরা অনেক ইমারত নির্মাণ করেছিলনে। তারমধ্যে গৌড়ে নির্মিত উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যসমূহ হলোঃ
সুলতানী আমলের স্থাপত্যসমূহ
খনিয়া দিঘি মসজিদ
প্রাচীন গৌড়ে সুলতানী আমলের স্থাপত্যকর্ম সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন হলো এই খনিয়া দিঘি মসজিদ। রাজবিবি মসজিদ নামেও পরিচিত খনিয়া দিঘি মসজিদটি বর্তমান নবাবগঞ্জ জেলার প্রাচীন গৌড় নগরে অবস্থিত। মসজিদটির পূর্বদিকে রয়েছে বিশালাকৃতির একটি দিঘি যা খনিয়া দিঘি নামেই খ্যাত।

ভূমি নকশা ও গঠনশৈলী
আয়তাকৃতির এই মসজিদটি প্রধানত ইটের দ্বারা তৈরি। পূর্বদিকে রয়েছে তিনটি খিলান পথ, এ পথ দিয়ে প্রবেশ করেই উল্টানো চারির মতো তিনটি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত একটি বারান্দা রয়েছে যার পরিমাপ ৯×৩ মিটার। বারান্দা থেকে নামাজ গৃহে প্রবেশের জন্য তিনটি খিলানপথ রয়েছে। ৯ মিটার পার্শ্ববিশিষ্ট এই নামাজ কক্ষটি বর্গাকৃতির। নামাজঘরের উপর নির্মিত বিশাল গম্বুজটি স্কুইঞ্জ, চার প্রধান পার্শের বদ্ধ খিলান ও খিলানগুলির মধ্যবর্তী পেন্ডন্টিভ এর উপর স্থাপিত।
ইমারতের চারকোণে রয়েছে চারটি অষ্টভূজাকৃতির বুরুজ, আরও দুটি বুরুজ প্রার্থনা কক্ষ ও বারান্দার মিলিত স্থানকে চিহ্নিত করেছে। ইমারতের কার্নিশ সামান্য বক্রাকারে তৈরী। খাঁজকাটা খিলান সম্বলিত তিন মিহরাব বিশিষ্ট এই মসজিদের মধ্যবর্তী মিহবারটি পার্শ্বস্থ দুই মিহরাবের চেয়ে বড় এবং বাইরের দিকে আয়তাকারে বর্ধিত।
আরো পড়ুনঃ প্রাচীন গৌড়ে মুঘল আমলের স্থাপত্যকর্ম
অলঙ্করণ
টেরাকোটা অলঙ্করণে শোভিত এই মসজিদটির চতুর্দিকে দুটি কার্নিশপট্টির মধ্যবর্তী স্থানসমূহে রয়েছে লতাপাতার নকশাসমৃদ্ধ ক্ষুদ্রাকৃতির খিলানসারি। এর নিচে একজোড়া সমতল পট্টিবলয় লক্ষণীয় যা হীরকখন্ডাকৃতি ও বুটিদার নকশায় সজ্জিত। চার দেওয়ালের সম্মুখভাগে আছে স্পষ্টভাবে অভিক্ষিপ্ত আয়তাকার প্যানেলের দুটি সারি যা জানালার ধারণা দেয়। এর প্রত্যেকটি প্যানেল আবার স্তম্ভের উপর খাছকৃত খিলান দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়েছে যা ভেতরে ঝুলন্ত মোটিফ এবং স্প্যানড্রিল গোলাপ নকশা প্রদর্শন করে।
কিবলা দেওয়ালের অভ্যন্তরভাগে মূল অলঙ্করণের বেশিরভাগ এখনও অক্ষতভাবে সংরক্ষিত আছে। খোদাই করা অলঙ্কৃত স্তম্ভগুলি যার উপর মিহরাব খিলানগুলি স্থাপিত, চিরাচরিত ঝুলন্ত মোটিফ ও অন্যান্য নচশাসমূহ প্রদর্শন করে। মিহরাব খিলানগুলির স্প্যান্ড্রিল পূর্ণপ্রস্ফুটিত গোলাপ নকশায় অলঙ্কৃত। দ্রাক্ষালতার প্যাঁচানো নকশা দ্বারা চমৎকারভাবে শোভিত খিলানের আয়তাকার ফ্রেমগুলি।
দরস বাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা
দরসবাড়ি মসজিদ গৌড় লখনৌতির বাংলাদেশ অংশের মধ্যে সর্ববৃহৎ মসজিদ। এটি ছোট সোনা কোতোয়ালী দরওয়াজা রোডের পশ্চিমে মধ্যযুগীয় শহরের দরসবাড়ি এলাকায় নির্মিত। দরসবাড়ি নামটি দরসবাড়ি বা বিদ্যাপীঠ শব্দ থেকে উদ্ভুত যা একটি মাদ্রাসাকে নির্দেশ করে। মসজিদের পূর্বদিকে একটি মাদ্রাসা আছে যা একটি বড় জলাধার দ্বারা মসজিদ থেকে বিচ্ছিন্ন। মসজিদ, মাদ্রাসা ও জলাধার মিলিয়ে একটি মুসলিম শিক্ষা কমপ্লেক্সের রুপ দেওয়া হয়েছে।

ভূমি নকশা ও গঠনশৈলী
মধ্যযুগীয় বাংলার বৈশিষ্ট্য ধারণকারী একটি জামে মসজিদ এটি, এর বাইরের ও ভেতরের দিকের পরিমাপ যথাক্রমে ৩৪মি. × ২০.৬ মি. এবং ৩০.৩ মি. ×১১.৭ মি.। মসজিদটি দুটি অংশে বিভক্ত। সম্মুখে ভেঙ্গে পড়া বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ।
সম্পূর্ণ ইমারতটি পূর্ব-পশ্চিমে টানা একটি চওড়া নেভ দ্বারা বিভক্ত। মূল প্রার্থনা কক্ষের নেভের উপরের আচ্ছাদন তিনটি চৌচালা ভল্টের সাহায্যে তেরী। মসজিদের উপরে সর্বমোট চারটি চৌচালা আচ্ছাদন ও ২৪ টি গম্বুজ নির্মিত হয়েছে যার সবকটি এখন নিশ্চিহ্ন।
মসজিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বেশিষ্ট্য হলো মূল কক্ষের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত রাজকীয় গ্যালারি। বাইরে থেকে প্রবেশের জন্য ছিল সিঁড়িযুক্ত মঞ্চ। মসজিদের প্রতি কোণে অষ্টভূজাকৃতির বুরুজ নির্মাণ করে একে মজবুত করা হয়েছিল।

অলঙ্করণ
অত্যন্ত জমকালোভাবে এই মসজিদ অলঙ্করণ করা হয়েছে। বাইরের দেয়াল বিন্যস্ত অফসেট ও ইনসেট নকশায়। এছাড়াও দেখা যায় পোড়ামাটির ফলকের প্যানেল যার মধ্যে রয়েছে ঝুলন্ত মোটিফের প্রাধান্য। ভেতরের দিকে খিলান ও পেন্ডেন্টিভগুলো ইটের গাঁথনির মাধ্যমে সজ্জিত করা হয়েছে। মিহরাবগুলির খিলান লতাগুল্ম, পত্রসম্ভার, গোলাপ, চারাগাছ ও ঝুলন্ত নকশায় সজ্জিত পোড়ামাটির ফলকের ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত। মসজিদের বক্র কার্নিশে ধাবমান সাড়িতে পতাকার আকারে পোড়ামাটির ফলক স্থাপনের মধ্যে রয়েছে একটি আকর্ষণীয় উদ্দেশ্য যা ঘোষণা করে মসজিদের নির্মাতা ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান ও বিশ্বাসীদের নেতা আমীর-উল-মুমিনীন।
ছোট সোনা মসজিদ
ছোট সোনা মসজিদ ‘সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন’ বলে আখ্যাত। এটি বাংলার রাজধানী গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর কোয়াটার্স এর তাহখানা কমপ্লেক্স থেকে অর্ধ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং কোতোয়ালী দরওয়াজা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত।
বিশাল এক দিঘির দক্ষিণপাড়ের পশ্চিম অংশ জুড়ে এর অবস্থান। মসজিদের কিছু দূর পশ্চিমে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিপ্তর কর্তৃক কয়েক বছর পূর্বে নির্মিত একটি আধুনিক দ্বিতল গেষ্ট হাউস রয়েছে। গেষ্ট হাউস ও মসজিদের মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে একটি আধুনিক রাস্তা চলে গেছে। মনে হয় রাস্তাটি পুরনো আমলের এবং একসময় এটি কোতোয়ালী দরওয়াজা হয়ে দক্ষিণের শহরতলীর সঙ্গে গৌড়-লখনৌতির মূল শহরের সংযোগ স্থাপন করেছিল।
ভূমি নকশা ও গঠনশৈলী
এ মসজিদের মূল ইমারত আয়তাকার এবং বাইরের দিকে উত্তর-দক্ষিণে ২৫.১ মিটার এবং পূর্ব পশ্চিমে ১৫.৯ মিটার। চারটি দেওয়ালই বাইরের দিকে এবং কিছুটা অভ্যন্তরভাগেও গ্রানাইট পাথরখন্ডের আস্তরণ শেভিত। দেশজ বৈশিষ্ট্য বহনকারী বাইরের দিকে চার কোণে চারটি বহুভুজাকৃতির বুরুজের সাহায্যে মসজিদটির কোণগুলিকে মজবুজ করা হয়েছে।মসজিদটির মধ্যবর্তীস্থলের কেন্দ্রীয় যে মিহরাবটি রয়েছে তা বাইরের দিকে উদগত।
মসজিদের পূর্বদিকের সম্মুখভাগে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে রয়েছে তিনটি করে প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বার বরাবর পশ্চিম দেওয়ালের অভ্যন্তরে রয়েছে পাঁচটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব। মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে মোট পনেরটি ইউনিট যার মধ্যে তিনটি আয়তাকার ইউনিট চৌচালা খিলান ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত। বাকি বারোটি বর্গাকৃতি ইউনিটের প্রত্যেকটি উল্টানো চারির মতো গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। ইউনিটগুলির খিলানের মধ্যবর্তী উপরের কোণগুলি গম্বুজ বসানোর উপযোগী করার জন্য করবেল পদ্ধতিতে ইটের পেন্ডন্টিভ দ্বারা বন্ধ করা হয়েছে।
একটি রাজকীয় গ্যালারিও রয়েছে যা মসজিদটির উত্তর-পশ্চিম কোণের উপরিভাগে দৃশ্যমান এবং উক্ত গ্যালারিতে প্রবেশের জন্য ঐ কোণেই রয়েছে একটি সোপানযুক্ত প্লাটফর্ম। গ্যালারির সম্মুখভাগে একটি মিহরাব রয়েছে।
অলংকরণ
মসজিদের অলংকরণের ক্ষেত্রে খোদাইকৃত পাথর, ইটের বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের গিল্টি ও চকচকে টালির ব্যবহার লক্ষণীয়। তবে এগুলির মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে খোদায়কৃত পাথর। লতাপাতার নকশা সম্বলিত প্যানেল এবং হিন্দু আমলের শিকল ও ঘন্টার মোটিফ অনুসারে বিভিন্ন ধরনের ঝুলন্তরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এছাড়াও অলঙ্করণের ক্ষেত্রে আমরা গোলাপ নকশার ব্যবহারও দেখতে পাই।
গম্বুজ ও খিলান ছাদের অভ্যন্তরভাগ পোড়ামাটির ফলক দিয়ে অলঙ্কৃত তবে খিলান ছাদের অলঙ্করণ করা হয়েছে স্থানীয় কুঁড়েঘরের বাঁশের ফ্রেমের অনুকরণে। সবচেয়ে লক্ষণীয় অলঙ্করণ হলো কোণের বুরুজের খোদাইকৃত পাথরের বেষ্টনী এবং দ্বারপথ ও ফ্রেমের উপরে বসানো পাথরের কার্নিশ ও অলঙ্করণ রেখা। মসজিদের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে সম্মুখের খিলানপথ ও মিহরাবের খিলানগুলি যার উভয়ই খাঁজবিশিষ্ট।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।