প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের রাজধানী হিসেবে শিবগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও দর্শনীয় নিদর্শন হিন্দু শাসন আমলে বিশেষ করে সেন বংশের শেষ রাজাদের খননকৃত দিঘী ও সুলতানী আমলে মুসলিম সুলতানদের নির্মিত মসজিদই এ উপজেলার প্রধান ঐতিহাসিক স্থাপনা। ছোট সোনা মসজিদ, খনিয়া দীঘি ও মসজিদ, দারাসবাড়ি মাদ্রাসা ও মসজিদ, তাহাখানা কমপ্লেক্স উল্লেখযোগ্য। গৌড়ের সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্য নির্মান কৌশল ছিল মূলত দেশীয় ও দিল্লির রাজকীয় স্থাপত্যরীতির এক অপুর্ব সংমিশ্রণে।

সুলতানী আমল

বাংলায় সুলতানী শাসনামলের স্থায়িত্ব ছিল ১৪, ১৫ ও ১৬ শতক জুড়ে। এসময় তারা অনেক ইমারত নির্মাণ করেছিলেন। তারমধ্যে ছোট সোনা মসজিদ, খনিয়া দীঘি ও মসজিদ, দারাসবাড়ি মাদ্রাসা ও মসজিদ উল্লেখযোগ্য।

মুঘল আমল

মুঘল শাসকগণ ১৫২৬ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এসময় তারা অসংখ্য স্থাপত্য নির্মাণ করেন। গৌড়ের মুঘল আমলে নির্মিত স্থাপত্যসমূহের মধ্যে তাহখানা কমপ্লেক্স, শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর মসজিদ ও সমাধি অন্যতম।

সুলতান, মুঘল, স্থাপত্য নির্মান কৌশল, ছোট সোনা মসজিদ/সুলতানি আমল ©Wikimedia
ছোট সোনা মসজিদ/সুলতানি আমল ©Wikimedia

স্থাপত্য নির্মান কৌশল

গৌড়ের মুসলিম স্থাপত্যগুলোতে দিল্লির রাজকীয় নির্মান কৌশলের পাশাপাশি দেশীয় নির্মান কৌশলও অনুসরন করা হয়। নিচে এই দুটি নির্মান কৌশল সম্পর্কে তুলে ধরা হল।

আরো পড়ুনঃ প্রাচীন গৌড়ে সুলতানী আমলের স্থাপত্যকর্ম

স্বদেশীয় উপাদান

মধ্য এশিয়ার ঐতিহ্যগত ইসলামী স্থাপত্যের ধারক ও বাহক হিসেবে মুসলিম শাসকগণ ইসলামী স্থাপত্যের মূল উপাদানগুলো (গম্বুজ, মিহরাব, মিনার, খিলান) ঠিক রেখে দেশীয় কারিগরদেরসহায়তায় স্বদেশীয় উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে যে স্থাপত্যকলা গড়ে তোলে তা বাংলার মুসলিম স্থাপত্য নামে পরিচিত। বাংলার এই মুসলিম স্থাপত্য কাঠামোগত অবয়ব ও অলঙ্করণ ক্ষেত্রে তদানীন্তন মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের ইসলামী স্থাপত্য হতে বহুলাংশে পৃথক ও স্বাতন্ত্রের দাবীদার। স্বদেশীয় উপাদানগুলো হলোঃ

স্বদেশীয় কুঁড়েঘরের আদলে বক্রাকার কার্নিশ

অতি প্রাচীনকাল থেকেই আবহমান বাংলায় সাধারণ মানুষের বসবাসের জন্য তৈরী কুঁড়েঘরগুলোতে বাঁশের কাঠামো দিয়ে তৈরী বক্রাকার কার্নিশের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। অতি সাধারণ এই পরিকল্পনা ও আকৃতি মুসলিম শাসনামলে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ও কারিগরদেল সহযোগিতায় চুন-সুরকির মসলা সহযোগে ইটের ইমারতে রুপান্তরিত হয়। সুলতানী আমালের প্রায় প্রতিটি ইমারতেই ঈষৎ বক্রাকার কার্নিশের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।

চৌচালা ছাদ

এদেশীয় চৌচালা কুঁড়ে ঘরের ছাদের ন্যায় মসজিদে চৌচালা খিলান ছাদের ব্যবহার দেখা যায়। উদাহরণ- ছোট সোনা মসজিদ, লট্টন মসজিদ (গৌড়।

দোচালা

মোগল আমলে নির্মিত ফতেহ্খানের সমাধিতে (১৬৬০) । এদেশের দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে রচিত দোচালা ছাদেরও পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে।

ইমারতের চারকোণায় বিশেষ ধরনের বুরুজ নির্মাণ

গ্রামাঞ্চলে বাঁশ, খড় বা ছনে নির্মিত কুঁড়েঘরের চারকোণে স্থাপিত চারটি বাঁশের খুঁটির সাথে সঙ্গতি রেখে মুসলিম স্থাপত্যের চারকোণে চারটি বুরুজ ব্যবহৃত হয়।

প্রাচীন গৌড়ে মুঘল আমলের স্থাপত্যকর্ম

ছই আকৃতির ছাদ বা ব্যারেল ভল্ট

বাংলার নদ-নদীতে চলমান নৌকার ছই বা উত্তরবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে গরুর গাড়ীতে ব্যবহৃত ছই আকৃতির ছাদ বা ব্যারেল ভল্ট দেশজ উপাদানের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। উদাহরণ- পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ, মোগল আমলে নির্মিত ঢাকার বড় কাটরা ও ছোট কাটরা।

দ্বিকেন্দ্রিক কৌণিক বা ছুঁচালো খিলান ও খাঁজ খিলানের ব্যবহার

দ্বিকেন্দ্রিক খিলান ও খাঁজ খিলান ভারত-উপমহাদেশের স্থাপত্য ইতিহাসে সর্বপ্রথম বাংলার মুসলিম স্থাপত্যেই দেখা যায় যা এদেশীয় এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য।

অলঙ্করণে দেশজ ঐতিহ্য পোড়ামাটির ফলক নকশা

সুলতানী স্থাপত্যে ব্যবহৃত পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটা অলঙ্করণ একান্তই বাংলার নিজস্ব সম্পদ।জীবন্ত প্রতীক ও ভাস্কর্যের স্থলে ইসলামী বিষয়বস্তুর বিমূর্ত প্রতীক, আরব্য নকশা, লিপিকলা, গোলাপ নকশা, জ্যামিতিক নকশা ইত্যাদির প্রচলন করে। উদাহরণ- গৌড়ের দরসবাড়ি মসজিদ, বাঘা মসজিদ ইত্যাদি

গম্বুজশীর্ষে কলসচূড়া,বিষয়বস্তুতে শিকল-ঘন্টা

দেয়ালগাত্রালঙ্কারে খোপনকশা

বাঁশ-খড়ের নির্মিত কুড়েঘরের দেয়াল হিসেবে ব্যবহৃত বেড়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মুসলিম স্থপতিরা মসজিদে আয়তাকার সারির প্যানেল বা খোপ নকশার ব্যবহার করেন। উদাহরণ- টাঙ্গাইলের আতিয়া মসজিদ, ঢাকার লালবাগ দুর্গ মসজিদ ইত্যাদি।

পদ্ম নকশা ফলবতী বৃক্ষ ও দেশজ লতাগুল্মের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।

দিল্লির রাজকীয় স্থাপত্যরীতি

দেশীয় ও দিল্লির রাজকীয় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠা মধ্যযুগীয় বাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য এদেশের সাংস্কৃতিক জীবনে যেমন বিবর্তনের সৃষ্টি করেছে তেমনি জন্ম দিয়েছে নতুন এক স্থাপত্য ধারার। রাজকীয় স্থাপত্যরীতিসমূহঃ

  • খিলান ও গম্বুজ নির্মাণ ঐতিহ্য (আর্কুয়েট) ।
  • পিপার উপর গম্বুজ স্থাপন।
  • অবস্থান্তর পর্যায়ে পান্দানতিফ ও স্কুইঞ্জের ব্যবহার।
  • দ্বিকেন্দ্রিক ও চতুষ্কেন্দ্রিক খিলান, খিলান নির্মাণে ভূঁসোয়া পদ্ধতির প্রয়োগ।
  • পলেস্তারার অলঙ্করণ; বেগমপুরি মসজিদের অনুকরণে করা হয়েছে।
  • ইউয়ান-ই-প্রবেশদ্বার বা প্রশস্ত গলিপথ; নামাজঘরকে প্রশস্ত গলিপথ দ্বারা বিভক্ত করা হয়েছে এটি তুঘলক আমলের বেগমপুরি মসজিদে লক্ষ করা যায়।
  • মুকার্ণাস নকশা; তাহখানার মুকার্ণাস নকশা আকবরের সমাধির অনুকরণে নির্মিত হয়েছে।
  • প্রস্তর খোদাই বা ইনলে পদ্ধতি; এটি লক্ষ্য করা যায় কুওয়াতুল ইসলাম বা আড়াই দিনকা ঝোঁপড়া মসজিদে।
  • উত্থিত বুরুজ; তাহখানা মসজিদে ব্যবহৃত উত্থিত বুরুজের ব্যবহার হয়েছে তা লাহোরের বাদশাহী মসজিদে লক্ষ্য করা যায়।
  • ফিনিয়াল বা শীর্ষদন্ড; তাহখানা মসজিদে দৃশ্যমান ফিনিয়ালের ব্যবহার গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের সমাধির অনুকরণে নির্মিত।

গৌড়ীয় স্থাপত্যকীর্তি বাংলার স্থাপত্য ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। এসব স্থাপত্যকীর্তি ছিল একটি মিশ্র স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধি। এ সকল স্থাপত্যে যেমন রয়েছে রাজকীয় বৈশিষ্ট্য তেমনি রয়েছে স্বদেশীয় উপাদানের ব্যবহার। নির্মাণশৈলীর এই বহুমাত্রিকতা গৌড়ীয় স্থাপত্যকীর্তিকে স্থাপত্যশিল্প মানে এক অনন্য জায়গায় নিয়ে গেছে।

এই সকল স্থাপত্যকীর্তি মানুষকে গৌরবজ্জল সোনালী অতিত সম্পর্কে শিক্ষা দেয় এবং সৃষ্টিশীল চিন্তাধারাকে বিকশিত করে। পরিশেষে বলা যায়, গৌড়ীয় স্থাপত্যকীর্তি স্বদেশীয় ও দিল্লীর স্থাপত্য বৈশিষ্টের এক চমৎকার সংযোজন।

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Shanjida Shima is a graduate student at the University of Rajshahi's Department of Islamic History and Culture. She writes from her college days, with a focus on history and literature. She contributes to MaroonPaper on a regular basis. Her articles can be found on MaroonPaper.

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

  • আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

  • ইক্যুইটির ম্যাক্সিম

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা

  • আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা

আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

  • পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয়

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।