রাষ্ট্র কি তা নিয়ে আমার আপনার ধারণা মোটামুটি স্পষ্ট। আজকে রাষ্ট্রের দুইটা বিশেষ ক্রাইটেরিয়া সম্পর্কে ধারণা নেব যেগুলো রাজনৈতিক পর্যালোচনায় বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলকারী। এই নিবন্ধে আমি স্যাটেলাইট স্টেট বা Satellite State বা পোষ্য রাষ্ট্র ও ন্যানী স্টেট বা Nanny State বা উপড়ে পড়া কিংবা গায়ে পড়া রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা করব। চলুন শুরু করা যাক।
স্যাটেলাইট স্টেট বা Satellite State বা পোষ্য রাষ্ট্র
কখনো খেয়াল করেছেন, বাংলাদেশ ভারতের রাজনীতি অর্থনীতি দিয়ে কি পরিমান প্রভাবিত? কখনো চোখে পড়েনি গায়ানার রাজনীতি এবং অর্থনীতি কিভাবে ভেনিজুয়েলার সিস্টেমের স্বীকার? পড়েছে হয়তো কিংবা না। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভারত,যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্র যেমন আছে, আছে বাংলাদেশ ভুটানের মতো ছোট, দুর্বল রাষ্ট্রও। বৃহৎ এই রাষ্ট্র গুলো সবসময় প্রভাব বিস্তার করে দুর্বল রাষ্ট্রের অর্থনীতি কিংবা রাজনীতিতে।

যদি কোনো বৃহৎ রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও রাজনীতি দ্বারা অন্য কোনো রাষ্ট্র(বিশেষত,দুর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো) কিংবা রাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং রাজনীতি প্রভাবিত হয় তাহলে প্রভাবিত সেই রাষ্ট্র গুলোকে Satellite State বা পোষ্য রাষ্ট্র বলে। যেমন, বাংলাদেশ ও ভুটান রাষ্ট্র দুইটি ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। সুতরাং,বাংলাদেশ এবং ভুটান এক্ষেত্রে ভারতের স্যাটেলাইট স্টেট।
A satellite state is a political term for a country that is formally independent, but under heavy political, economic, and military influence or control by another country.
আরো কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক:
- মিয়ানমারের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সিস্টেম চীনের রাজনীতি ও অর্থনীতি দিয়ে প্রভাবিত।
- আফ্রিকান দেশ এসওয়াতিনি ও লেসেথো দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বলয় দ্বারা প্রভাবিত। তাই এই দুইটি দক্ষিণ আফ্রিকার “Satellite State”
- পাপুয়া নিউগিনি ও নাউরু অস্ট্রেলিয়ার সিস্টেম অর্থনীতি ও রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত।
- একই ভাবে আমরা ভ্যাটিকান সিটি ও এন্ডোরা লা ভিলার কথা বলতে পারি।যারা ফ্রান্সের স্যাটেলাইট স্টেট।
- সম্প্রতি বেলারুশ রাশিয়ার স্যাটেলাইট স্টেট হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
আপনার চোখে কোন দেশ কোন দেশের স্যাটেলাইট স্টেট মনে হয় তা কমেন্টে জানাতে পারেন। বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
ন্যানী স্টেট বা Nanny State বা উপড়ে পড়া কিংবা গায়ে পড়া রাষ্ট্র
এবার বহুল বিতর্কিত এবং সময়োপযোগী Nanny State নামক এই টার্মটি নিয়ে সহজসাধ্য বিস্তারিত আলোচনা থাকবে।
ভালোই তো আছেন বেশ! পকেটে দুই টাকা থাকলে চুইংগাম কিনে খেতে খেতে হাটতে পারছেন। পকেট ভারি তো একটু বারে গিয়ে উঁকি দিয়ে আসা যায় হরহামেশাই। আবার বয়স একটু বেড়েছে তো ইন্টারনেটে এডাল্ট পেজ কিংবা ম্যানুয়াল এডাল্ট ম্যাগাজিন কিনে পড়তে পারছেন। বাহ,বেশ ভালোই তো আছি তাহলে আমরা!
ধরুন, কাল সকালে আপনার চুইংগাম, চকলেট দাঁতের জন্য ক্ষতিকর ঘোষণা দিয়ে চুইংগামের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। বললো, এডাল্ট ম্যাগাজিন প্রকাশ করা যাবে না, কারণ এটা যুবসমাজ কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সকালে মামার টংয়ের দোকানে আর বা হাতে চা নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে ডান হাতের সিগারেটে ফুক দেয়া যায়না, সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে তাতে। ধরা খেলেই আইনি পাঠশালায়। কেমন হবে তখন? এতোক্ষণ গল্প করছিলাম, চলুন একটু মূল আলোচনায় নজরপাত করি।
কথা বলছিলাম Nanny State নিয়ে। কাকে বলে Nanny State? এর স্বরূপ কিংবা বৈশিষ্ট্য কিরকম? চলুন জেনে নেই;
যদি কোনো রাষ্ট্রের ধরণ এমন হয় যে তার জনগণ কিভাবে চলবে, জীবনব্যবস্থা কেমন হবে, নাগরিকদের জন্য কোনটা ভালো কোনটা খারাপ হবে সেটা নির্ধারণ করার মাধ্যমে নাগরিকদের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে(নাগরিকদের ভালোর জন্য)বসে তখন সেই ধরণের রাষ্ট্রকে Nanny State বা উপড়ে পড়া কিংবা গায়ে পড়া রাষ্ট্র বলে।
A state that tries to give too much advice or make too many laws about how people should live their lives, especially about eating, smoking, or drinking alcohol is Nanny State.
মরক্কোর জাতীয়তাবাদি আন্দোলন ও সুলতান মুহাম্মাদ
অধিক ক্লিয়ারেন্সের জন্য একটু উদাহরণ দেয়া যাক; উপরে বলেছি, ধরুন চকলেট খেতে আইনি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, আপনি চাইলে ই যেকোনো ওয়েবসাইটে ঢুকে এডাল্ট ম্যাটারিয়ালস দেখতে পারেন, এডাল্ট ম্যাগাজিন পড়তে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্র যদি এগুলো জনগণের ক্ষতির কারণ হিসেবে তুলে ধরে ব্যান করে দেয়, নাগরিক কি করবে না করবে সেই ব্যাক্তি পর্যায়ে হস্তক্ষেপ করে তাহলে আপনি নিঃসন্দেহে সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে Nanny State এর কাতারে ফেলতে পারবেন।
পৃথিবীব্যাপী বহু রাষ্ট্রের ধরণ Nanny State এর মতো। নরওয়ে অনেক আগে থেকেই এই আওতায় পড়েছে। সিঙ্গাপুর একটা স্পষ্ট Nanny State। দেশটিতে চুইংগাম পর্যন্ত নিষিদ্ধ আর স্মোকিংকে সেই দেশি সরকার সবসময়ই নিরুৎসাহিত করে আসছে। নেই তেমন কোনো এডাল্ট ম্যাগাজিনের প্রবেশাধিকারও।
আসি ফিনল্যান্ডের কথায়, সেখানে একটা শিশু জন্মের আগে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত দায় দায়িত্ব সে দেশীয় সরকার নিয়ে নেয়। নাগরিকের ব্যক্তি জীবনে হস্তক্ষেপ অনেক বেশি, তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড়ো Nanny State বলা হয় এই ফিনল্যান্ড কে।
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড,যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো এখন Nanny State এর কাতারে চলে এসেছে এবং বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে (Federal Parliament or Commonwealth Parliament) সরকারি এবং বিরোধী দলের মধ্যে এই নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। বিরোধী দল সরকারের সমালোচনা করে বলছেন একটা দেশের সরকারের কোনোই অধিকার নেই নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের যদি রাষ্ট্র সেটা ভালোর জন্য মনে করে তবুও। কারণ একটা নাগরিক নিজেই তার ভালো মন্দ বুঝতে পারে সেটা নিয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অশোভনীয়।
বাংলাদেশ কি Nanny State?
সম্প্রতি এবারের ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পেশের পর টুকটাক এই নিয়ে আলোচনার মঞ্চ বসছে। সিগারেটের দাম বৃদ্ধি করে জনমনে অসন্তোষ তৈরি করেছে, জনগণকে সিগারেট খাওয়া থেকে বিরত রাখতেই। সংসদে পাবজি, ফ্রি ফায়ার অনলাইন গেমিং নিষিদ্ধের নোটিশ পেশ হয়েছে। কারণ এসব গেমিং এপ যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাড় করাচ্ছে ধীরে ধীরেই। অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে সিঙ্গাপুর, নরওয়ের মতো Nanny State হতে যাচ্ছে।
সে যাইহোক, Satellite State কিংবা Nanny State নিয়ে আপনার মতামত কি? একটা রাষ্ট্র Nanny State হলে জনগনের জন্য খারাপ নাকি ভালো, মতামত জানান।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।