প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় বর্তমান ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল মালদা-চাপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে অবস্থিত। গঙ্গার ৪০ কিলোমিটার ভাটিতে ও মালদার ১২ কিলোমিটার দক্ষিনে এর অবস্থান ছিল। তবে ধীরে ধীরে গঙ্গার প্রবাহ শহর থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। সেন আমলে এই শহর উন্নতি লাভ করে। সেন রাজা লক্ষণের নামানুসারে এই শহরের নামকরণ করা হয়। মুঘল শাসকগণ ১৫২৬ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এসময় তারা অসংখ্য স্থাপত্য নির্মাণ করেন। প্রাচীন গৌড়ে মুঘল আমলের স্থাপত্যকর্ম সমূহের মধ্যে তাহখানা কমপ্লেক্স, শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর মসজিদ ও সমাধি অন্যতম। বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

তাহখানা কমপ্লেক্স

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শাহাবাজপুর ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী মুঘল তাহখানা (Mughal Tahakhana) বা তাহখানা কমপ্লেক্সের অবস্থান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তাহখানার দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। ফার্সি শব্দ তাহখানার অর্থ ঠান্ডা ভবন বা প্রাসাদ। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পু্ত্র সুলতান শাহ সুজা তাঁর মুর্শিদ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহর শীতকালীন বসবাসের সুবিধার্থে ফিরোজপুরে তাপনিয়ন্ত্রিত ৩ তলা বিশিষ্ট এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র মতে, ১৬৩৯-১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে এই তাহখানাটি নির্মিত হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শাহাবাজপুর ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী মুঘল তাহখানা (Mughal Tahakhana) বা তাহখানা কমপ্লেক্সের অবস্থান। প্রাচীন গৌড়ে মুঘল আমলের স্থাপত্যকর্ম
তাহখানা কমপ্লেক্স

ভূমি নকশা ও গঠনশৈলী

আয়তাকার নকশা পরিকল্পনায় নির্মিত দ্বিতলাকৃতি বিশিষ্ট এ ইমারতটি একটি বৃহদাকারের দিঘির পশ্চিমপাড় ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত এ ইমারতের বাইরের দৈর্ঘ্য ৩১.৭০ মি. × ১০.৩০ মি.। দ্বিতলাকার এ ইমারতটির নিচতলায় চারটি আয়তাকার কক্ষ রয়েছে। কক্ষগুলোর ছাদ চৌচালাকৃতির স্বচ্ছ উচ্চ ভল্ট দ্বারা আবৃত (বর্তমানে ছাদ ধসে পড়েছে)। কক্ষগুলো চতুর্কেন্দ্রিক খিলানের দ্বারা দিঘি অভিমুখে উন্মুক্ত। এগুলো শীতলকক্ষ হিসেবে পরিচিত। ইমারতের দ্বিতীয়তলা প্রধানত তিনটি অংশে বিভক্ত-

  • উত্তরাংশে মসজিদ বা এবাদতখানা,
  • মধ্যবর্তী স্থানে হলঘর ও আবাসন প্রকোষ্ঠ এবং
  • দক্ষিণাংশে স্নানাগার

এবাদত কক্ষটি খুব সম্ভবত সুবেদারের ব্যক্তিগত এবাদত কক্ষ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। হলঘর ও আবাসিক প্রকোষ্ঠরূপে পরিচিত ইমারতের মধ্যবর্তী অংশে ৮ টি রয়েছে। আয়তাকার বৃহৎ কক্ষটি হলঘর রুপে চিহ্নিত। বর্তমানে এর ছাদ ধ্বসে পড়েছে।

তাহখানা ইমারতের সর্বদক্ষিণে বাথ কমপ্লেক্স বা স্নানাগার। দুটি ছোট বড় কক্ষের সমন্বয়ে এ অংশ গঠিত। কক্ষগুলোর ছাদ গম্বুজ, অর্ধ-গম্বুজ, চৌচালা ভল্ট এবং অর্ধ পিপাকৃতির ভল্ট দ্বারা আচ্ছাদিত। উষ্ণ ও শীতল জলাধারসহ পাকা চৌবাচ্চা এ অংশের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। স্নানাগার সংলগ্ন অষ্টভুজাকার (অভ্যন্তরভাগ গোলায়িত) বুরুজ সদৃশ অবকাঠামোটি প্রধান জল-ভান্ডারের ভূমিকা পালন করতো।

আরো পড়ুনঃ প্রাচীন গৌড়ে সুলতানী আমলের স্থাপত্যকর্ম

অলঙ্করণ

ইমারতের বহির্গাত্র আনুভূমিক ও উলম্ব প্যানেলে সজ্জিত। ইমারতের গম্বুজ, অর্ধ গম্বুজ ও অষ্টভূজাকার কক্ষগুলোর ছাদতল স্ট্যাকো দ্বারা জলাকার নকশায় অলঙ্কৃত। ক্ষুদ্র মসজিদ অর্ধ গম্বুজাকার মিহরাব কুলঙ্গি ও অষ্টভূজাকৃতির কক্ষগুলোর দেওয়াল গাত্রে নির্মিত কুলঙ্গি মুকার্নাস নকশায় অতি হৃদয়গ্রাহীভাবে অলঙ্কৃত।

শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর মসজিদ

১৬৩৯-৬০ খ্রিস্টাব্দ সময়ের মধ্যে নির্মিত এই মসজিদটি তাহখানা ইমারতের উত্তর-পশ্চিম দিকে সামান্য দূরে অবস্থিত।

শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর মসজিদ, প্রাচীন গৌড়ে মুঘল আমলের স্থাপত্যকর্ম,
শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর মসজিদ

ভূমি নকশা ও গঠনশৈলী

মুঘল আমলে নির্মিত এই মসজদটি আয়তাকৃতির এবং তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। নামাজঘরটি দুটি প্রশস্ত আড়খিলানের দ্বারা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে তিনটি ‘বে’- বর্গের রুপ ধারণ করেছে। একটি করে গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত ‘বে’ বর্গের মধ্যবর্তীটি পার্শ্বদুটির চেয়ে সামান্য বড়। বাংলা পান্দানতিফ্ পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে এর গম্বুজ আর বৃত্তাকার একটি ড্রাম এই গম্বুজ ছাদের ভার বহন করতো। গম্বুজের চূড়া প্রস্ফুটিত পদ্মফুল ও তদুপরি কলসাকৃতির শিরোচূড়া দ্বারা শোভিত।

মধ্যবর্তী ফাসাদে তিনটি প্রবেশপথ চতুর্কেন্দ্রিক খিলান দ্বারা সাহনের দিকে উন্মুক্ত। ফাসাদের মধ্যবর্তী স্থান অভিক্ষিপ্ত অবস্থায় নির্মিত এবং এ উদগত অংশের উভয় কোণায় রয়েছে দুটি খাঁজকাটা ট্যারেট। মসজিদের কিবলা প্রাচীরে রয়েছে তিনটি মিহরাব যার মধ্যে কেন্দ্রীয় মিহরাবটি ষড়ভুজাকার এবং অপর দুটি আয়তাকার।

মসজিদের চারকোণায় চারটি অষ্টভূজাকার বুরুজ বপ্র অতিক্রম করে উপরের দিকে উত্থিত যা নিরেট গম্বুজে আবৃত এবং কলসাকৃতির ফিনিয়ালে (শীর্ষদন্ড) শোভিত। মসজিদের ছাদ স্বল্পোচ্চ বপ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং বপ্রের বহির্গাত্র বদ্ধ মার্লন নকশায় অলঙ্কৃত। নামাজ ঘরের সম্মুখে যে সাহন রয়েছে তা একটি অনুচ্চ প্রাকার দ্বারা পরিবেষ্টিত।  

অলঙ্করণ

মসজিদ প্রাকার ও ফাসাদের অভ্যন্তরীণ ও বহির্গাত্রে কুলঙ্গি নির্মাণ, আনুভূমিক ও উলম্ব প্যানেল নকশায় বিভক্তকরণ, মিহরাব ও কুলঙ্গিতে মুকার্নাস ডিজাইন, বপ্রে বদ্ধ মার্লন পান্দানতিফ্ এবং ঘালিবকারি ডিজাইন প্রধান অলঙ্করণ মোতিফ্ হিসেবে চিহ্নিত।

শাহ নিয়ামত উল্লাহ্ ওয়ালীর সমাধি

 এ সমাধিসৌধটি তাহখানা কমপ্লেক্স হতে ৩০/৩৫ মিটার উত্তরে অবস্থিত। প্রায় বর্গাকৃতির (২৪.৪০ মি. ×৩৩.৮০ মি.) একটি স্বল্পোচ্চ মঞ্চের মধ্যবর্তি স্থানে এটি নির্মিত। এর নির্মাণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ইট ও পাথর উভয়ই।

ভূমি নকশা ও গঠনশৈলী

বর্গাকার নকশা পরিকল্পনায় এটি নির্মিত এবং অভ্যন্তরীণ সমাধি কক্ষের চতুর্দিক প্রশস্ত বারান্দায় পরিবেষ্টিত। পান্দানতিফ্ ও স্কুইঞ্জ পদ্ধতির গম্বুজ দ্বারা এর মূল কক্ষটি পরিবেষ্টিত।

মূল সমাধি কক্ষের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ পরিবেষ্টন প্রাকারের মধ্যবর্তী স্থানে একটি করে মোট তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। ব্যাসল্ট প্রস্তরের দ্বারা দরজার ফ্রেম বা ঠৌকাঠ তৈরী। উত্তর প্রাকারের মধ্যবর্তী স্থানে একটি পঞ্চভুজাকার বৃহদাকৃতির মিহরাব বা কুলঙ্গি রয়েছে। এটি অর্ধ-গম্বুজ দ্বারা পরিবৃত। গম্বুজের অবতলভাগ মুকার্নাস অলঙ্করণে শোভিত। এ কক্ষেই চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন শাহ নিয়ামত উল্লাহ্ ওয়ালী।

সমাধি কক্ষের বারান্দায় প্রতি বাহুতে তিনটি করে মোট ১২ টি খিলানপথ আছে একারণেই হয়তো মি. কানিংহাম এ সমাধিকে ‘বার দুয়ারী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বারান্দার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিমের কক্ষগুলোর ছাদতল সমতল কিন্তু পার্শ্বগুলো নলাকৃতির দেখতে অনেকটা চৌচালা ভল্টের মতো কিন্তু চারটি কোনাকক্ষ গম্বুজাকৃতির অবতল ছাদে আবৃত। ইমারতের চারকোণায় চারটি অষ্টভুজাকার বুরুজ রয়েছে। বুরুজগুলো ছাদ পাঁচিল অতিক্রম করে উপরে উঠেছে এবং শিরাল গম্বুজাকতির ছত্রী দ্বারা এগুলো শোভিত।

অলঙ্করণ পদ্ধতি

ইরানই মুকার্ণাস অলঙ্করণ পদ্ধতির উপ্ত স্থান। এখানেই এ অলঙ্করণ পদ্ধতির উৎপত্তি হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা বিকশিত হয়। মোগল আমলের অন্যতম স্থাপত্য নিয়ামত উল্লাহ্ ওয়ালীর মসজিদ ও সমাধিসৌধে এই অলঙ্করণ পদ্ধতি পরিদৃষ্ট হয়।

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Shanjida Shima is a graduate student at the University of Rajshahi's Department of Islamic History and Culture. She writes from her college days, with a focus on history and literature. She contributes to MaroonPaper on a regular basis. Her articles can be found on MaroonPaper.

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

  • আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

  • ইক্যুইটির ম্যাক্সিম

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা

  • আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা

আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

  • পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয়

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।