তেল সম্পদ আধুনিক বিশ্বের অন্যতম প্রয়োজনীয় সম্পদ। মানব সভ্যতাকে গতিশীল করে রাখার জন্য তেল সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আর মধ্যপ্রাচ্যের জন্য তেল প্রধান গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ যা মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির মেরুদন্ড হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে।

১৯০৮ সালে পারস্যের মসজিদ-ই-সুলাইমানিয়া নামক তেলক্ষেত্রের আবিষ্কারের দ্বারা মধ্যপ্রাচ্যে তেল উত্তোলন শুরু হয়। তেলক্ষেত্রের অবস্থানের ভিত্তিতে পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যকে বেশ কিছু অঞ্চলে বিভক্ত করে বিভিন্ন তেল ক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলন শুরু করা হয়। শুরুর দিকে অ্যাংলো ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানীর হাতে তেল উৎপাদনের সর্বময় ক্ষমতা থাকলেও পরবর্তিতে ডঃ মোসাদ্দেকের নেতৃত্বে ইরানের তেল শিল্প জাতীয়করণ করা হয়। ফলশ্রুতিতে ইরানের তেল শিল্পে পশ্চিমাদের একক আধিপত্যের অবসান ঘটে। ইরান তথা মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অনেক বড় পরিবর্তন আনে এই ঘটনা।

এই আলোচনায় মধ্যপ্রাচ্যের তেলক্ষেত্রসমূহ ও ইরানের তেল শিল্প জাতীয়করণে ডঃ মোসাদ্দেকের ভূমিকা পর্যালোচনা করব। তবে চলুন, শুরু করা যাক।

তেল উৎপাদনকারী অঞ্চলসমূহ

বিশ্বের বৃহত্তম তেল ক্ষেত্রগুলি মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, ইরান এবং ইরাকের মতো দেশে অবস্থিত। বিশ্বের মোট তেলের বৃহদাংশ এই মধ্যপ্রাচ্যই সরবরাহ করে। মধ্যপ্রাচ্যে তেলের মজুদ এই অঞ্চলটিকে বিশ্বের অনেক দেশের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে। এই অঞ্চলে তেল উত্পাদন বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মধ্যপ্রাচ্যকে ৯ টি অঞ্চলে বিভক্ত করে তেল উৎপাদন করা হয়ঃ

  • দক্ষিণ-পশ্চিম পারস্যের খুজিস্থান তেলক্ষেত্রসমূহ;
  • উত্তর ইরাক ও উত্তর-পশ্চিম পারস্যের তেলক্ষেত্রসমূহ;
  • দক্ষিণ ইরাকের তেলক্ষেত্রসমূহ;
  • কেন্দ্রীয় পারস্য অঞ্চলের তেলক্ষেত্রসমূহ;
  • সৌদি আরব ও উপসাগরীয় উপকূলের তেলক্ষেত্রসমূহ;
  • দক্ষিণ ইসরাইলের তেলক্ষেত্রসমূহ;
  • দক্ষিণ-পূর্ব তুরষ্কের তেলক্ষেত্রসমূহ;
  • উত্তর-পূর্ব মিশরের তেলক্ষেত্রসমূহ;
  • স্বাধীন লিবিয়ার তেলক্ষেত্রসমূহ।

পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যের এসব তেলক্ষেত্র বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত হলেও বর্তমানে সেসব বিভিন্ন রাষ্ট্রের অধীনে রয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ বেশ কয়েকটি দেশে এসব তেলক্ষেত্রের অবস্থান।

  • ইরানের তেলক্ষেত্রসমূহঃ ইরান বিশ্বের নবম বৃহত্তম তেল উত্পাদনকারী দেশ এবং  প্রতিদিন প্রায় ৩.২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উতপাদন করে। তবে ইরানের উপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে তেল উত্পাদনের দিক থেকে ইরান পিছিয়ে আছে। ইরানের তেলক্ষত্রগুলির মধ্যে আছে মসজিদ-ই-সুলাইমানিয়া, জি-স্যারোন, আগাথারি, লালি, এলবুর্জ, নবথ-ই-শাহ ইত্যাদি;
  • ইরাকের তেলক্ষেত্রসমূহঃ ইরাক বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম উত্পাদনকারী এবং প্রতিদিন প্রায় ৪.৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্পাদন করে। ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলি হলো কিরকুক, আইন-জালে, যুবাইর, বে-ই-হাসান, রোমালিয়া, জাম্বুর ইত্যাদি;
  • কুয়েতের তেলক্ষেত্রসমূহঃ কুয়েত প্রতিদিন প্রায় ৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্পাদন করে এবং বিশ্বের শীর্ষ ১০ তেল উত্পাদনকারীদের মধ্যে রয়েছে । এদেশের তেলক্ষেত্রগুলির মধ্যে স্যান্ডস্টোন, বুরগান, মাগা-আহমাদি প্রসিদ্ধ;
  • ইসরাইলের তেলক্ষেত্রঃ হেলেজ;
  • কাতারের তেলক্ষেত্রঃ দু’খান;
  • সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রসমূহঃ সৌদি আরব প্রতিদিন প্রায় ১২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্পাদন করে যা বিশ্বের মোট উত্পাদনের প্রায় ১২%। দাম্মাম, কাতিফ, ঘাওয়ার, সাফানিয়া তেলক্ষেত্রগুলোতে বর্তমানে তেল উত্তোলন হয়। এছাড়াও কুরাইশ, মানিফা প্রভৃতি তেলক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে;
  • মিশরের তেলক্ষেত্রসমূহঃ জিমসা, হুরগাদা,রাস গারিব, সদর, বেলাইস,রাসবকর;
  • তুরস্কের তেলক্ষেত্রসমূহঃ রামান্দাগ, গারজান, জারমিক;
  • লিবিয়ার তেলক্ষেত্রসমূহঃ বাহী, বেদা, দারা, মাবরুক, জাহালিন;
  • সিরিয়ার তেলক্ষেত্রঃ কেরাত চক ইত্যাদি।

এই তেল ক্ষেত্র অঞ্চলগুলি কেবল মাত্র সেই দেশগুলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং সমগ্র বিশ্বব্যাপী জ্বালানি শক্তি উত্পাদন এবং সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অঞ্চলে তেলের মজুদ ভূ-রাজনৈতিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যকে বিশ্বের অনেক দেশের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে।

আরো পড়ুন হরমুজ প্রণালী ও সমকালীন বিশ্ব অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব

ইরানের তেল জাতীয়করণে ড.মোসাদ্দেকের ভূমিকা

মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম ইরান। তেল সম্পদ আবিষ্কারের শুরু থেকেই পশ্চিমাজোট ইরানের উপর প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়। ইরানের শাসকগোষ্ঠী তেল সম্পদ নিয়ে বিদেশীদের সাথে স্বার্থবাদী আচরণে মেতে উঠলে বিদেশীরা তেল সম্পদের উপর হস্তক্ষেপ করে। এ অবস্থায় ইরানের জাতীয় নেতা  ড.মোসাদ্দেক দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তেল সম্পদ জাতীয়করণ করেন এবং বিদেশী প্রভাব থেকে মুক্ত করেন।

তিনি ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদেগ কর্তৃক ইরানের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণে ডঃ মোসাদ্দেকের অবদানকে নিচে পর্যালোচনা করা হলোঃ

অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি গঠন

ঊনবিংশ শতাব্দীতে কাজার রাজবংশের শাসনামলেই সর্বপ্রথম ইরানে তেল সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হয়। সে সময় ইরান পারস্য নামে পরিচিত ছিল। কাজার রাজবংশের অনুমোদনে ১৮৯২ সালে ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক দলের নেতা অধ্যাপক জ্যাকোস দ্য মরগান পশ্চিম ইরানের সুসা নামক স্থানে তেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করেন। অধ্যাপক জ্যাকোসের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ অর্থনীতিবীদ উইলিয়াম নক্স দ্য আরশি ১৯০১ সালে ইরান সরকারের সাথে তেলক্ষেত্র অনুসন্ধানের ব্যাপারে একটি সমঝোতায় আসেন। তখন থেকেই মূলত অ্যাংলো-পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি (এপিওসি) ইরানে কাজ শুরু করে। কোম্পানিটি ১৯০৮ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করেছিল।

১৯০৯ সাল থেকে পুরনো অ্যাংলো-পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি (এপিওসি)  নতুন নামে অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (এআইওসি) হিসেবে গঠিত হয়। সে সময় এটিই ইরানে পরিচালিত বৃহত্তম বিদেশী তেল সংস্থা ছিল। যাইহোক, কোম্পানী দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানে তেল উত্তোলন, শোধন ও বাজারজাতকরণের অধিকার লাভ করে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী এআইওসি উৎপাদিত তেলের লভ্যাংশের মাত্র ১৬% ইরান সরকারকে দিতে চুক্তিবদ্ধ হয়।

দ্বিতীয় রেজা শাহ্ কর্তৃক চুক্তি বাতিল ঘোষণা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তেলের ব্যাপক ব্যবহারের দরুণ ইরানে তেল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি তেলের হিসাব নিকাশের ক্ষেত্রে অসাধুতা অবলম্বন করে ইরান সরকারকে ন্যায্য রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত করে।  এর প্রতিবাদে  দ্বিতীয় রেজা শাহ্ ১৯৩২ সালে অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানির সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল ঘোষণা করলে দু পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে পড়ে। এর ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ সরকার পারস্য উপসাগরে যুদ্ধ জাহাজ পাঠায়। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি লীগ অব নেশনস এর অধিবেশনেও উত্থাপন করে।

পুনরায় নতুন চুক্তি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তিতে পশ্চিমাদের নানান ছলচাতুরি সামাল দিতে ১৯৩৩ সালে ইরান সরকারের সাথে অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানির নতুন চুক্তি হয়। চুক্তির শর্তগুলিঃ

  • কোম্পানী আগামী ৬০ বছরের জন্য ইরানের এক লক্ষ বর্গমাইল এলাকা থেকে তেল উত্তোলনের ক্ষমতা লাভ করবে।
  • ইরান সরকারের ল্যভাংশ ১৬% থেকে ৩০% করবে
  • নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেউ চুক্তি বাতিল করতে পারবে না।
  • দু’পক্ষের মধ্যে কোনো বিবাদ দেখা দিলে সালিশের মাধ্যমে মিমাংসা করা হবে।
  • তেল কোম্পানীতে চাকরীর ক্ষেত্রে ইরানীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

কিন্তু তেল কোম্পানীর সাথে দ্বিতীয় চুক্তির পরও ইরান লাভবান হতে পারেনি। কোম্পানী প্রথম দিকে চুক্তি অনুযায়ী রয়ালিটি প্রদান করলেও শেষের দিকে পূর্বের ন্যায় অসাধুতা অবলম্বন করে। এর প্রতিবাদে ইরান সরকার রয়্যালটি বৃদ্ধির দাবী জানায়।

ন্যাশনাল ফ্রন্ট গঠন ও তেল শিল্প জাতীয়করণ দাবী উত্থাপন

এ সময় ইরানে বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে। বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী দলগুলো পাশ্চাত্য বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে ড.  মোসাদ্দেকের নেতৃত্বে ন্যাশনাল ফ্রন্ট গঠন করে। ১৯৫০-৫১ সালে ন্যাশনাল ফ্রন্ট ড. মোসাদ্দেকের নেতৃত্বে তেল শিল্প জাতীয়করণের দাবী করে। প্রধানমন্ত্রী আযম আরা এ দাবী প্রত্যাখান করলে তাকে হত্যা করা হয়। ধর্মীয় উগ্রপন্থি দলের সদস্য খলিল তাহমাসাবী ১৯৫১ সালের ৭ ই মার্চ প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে। এর অব্যবহিত পরে ইরানী মজলিস  তেল জাতীয়করণ করে একটি আইন পাশ করে। এই আইন ইরানী সিনেটও অনুমোদন করে। তবে এ আইন তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

তেল জাতীয়করণ আইন পাশ

প্রধানমন্ত্রী আযম আরা নিহত হবার পর ওয়াশিংটনস্থ ইরানি রাষ্ট্রদূত হুসাইন আলাকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। তিনি ক্ষমতা লাভ করে তেল কোম্পানীর সাথে নমনীয় নীতি গ্রহণ করেন। তিনি তেলের উপর ইরান সরকারের কর্তৃত্ব রেখে তেল উত্তোলন, পরিশোধন ও বাজারজাতকরণ অর্থাৎ ব্যবহারিক দিকগুলো কোম্পানীর হাতে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করেন। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদীদের নিকট তা গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন এবং পরের দিন ইরানি মজলিস তেল জাতীয়করণ আন্দোলনের নেতা ড.  মোসাদ্দেককে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন। ঐ দিনই মজলিস তেল জাতীয়করণের পক্ষে মত প্রকাশ করে এবং দুই দিন পর সিনেটও একই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইরানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং জাতীয়তাবাদী দল সহ বিভিন্ন গোষ্ঠী তেল শিল্পের জাতীয়করণকে সমর্থণ করেছিল। ফলে ইরানের শাহ বাধ্য হয়ে তেল জাতীয়করণ আইনে স্বাক্ষর করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ইরানে অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সাথে সাথে ইরানি সরকার যে রয়্যালটি পেত তাও বন্ধ হয়ে যায়।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যস্থতায় দুইপক্ষের আলোচনা

তেল জাতীয়করণের পদক্ষেপ ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বীগ্ন করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে নিরপেক্ষতা ঘোষণা করলেও ব্রিটেনের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। ১৯৫১ সালের জুনে তেল কোম্পানী ইরানের সাথে আলোচনায় বসে কিন্তু ইরানের দাবীর মুখে আলোচনা ব্যর্থ হয়।

অতঃপর ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপন করলেও কোনো সুবিধা করতে পারেনি। ১৯৫১ সালের জুলাইতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুমান প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেকের নিকট লিখিত এক ব্যক্তিগত পত্রে ইরান ও ব্রিটেনের স্বার্থে আলোচনার মাধ্যমে তেল সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার তাগিদ দেন এবং তার ব্যক্তিগত দূত হ্যারিম্যানকে ইরানে পাঠান। হ্যারিম্যানের চেষ্টায় ইরান ও ব্রিটেনের মধ্যে আলোচনা হয়। ব্রিটেনের পক্ষে তেল শিল্প জাতীয়করণের প্রেক্ষিতে দুটি শর্তে আলোচনা হয়;

প্রথমত, ব্রিটিশ কোম্পানীকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দান ও

দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ কোম্পানীর হাতে তেল উত্তোলন, পরিশোধন, বাজারজাতকরণের দায়িত্ব অর্পন।

প্রথম শর্তে রাজি হলেও দ্বিতীয় শর্তে ইরান রাজী ছিলনা। ফলশ্রুতিতে আলোচনা ভেস্তে যায়।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতের পদক্ষেপ

১৯৫১ সালে ইরানি সেনাবাহিনীর একটি দল আবাদান তেল শোধনাগার থেকে ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদদেরকে বিতাড়িত করে দেয়। এ সময় তেল কোম্পানীর কর্মচারীদের ইরানে অবস্থান করার অনুমতি পত্র প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাধ্য হয়। এবং ইরানি জাতীয় তেল কোম্পানি তেল শোধনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর ব্রিটিশ সরকার এ সমস্যাটিকে জাতিসংঘে উপস্থাপন করে।

আরো পড়ুন সাইপ্রাস সমস্যার আদ্যোপান্ত

নিরাপত্তা পরিষদ যাতে ইরানের বিরুদ্ধে কোনো মতামত গ্রহণ করতে না পারে সেজন্য ড. মোসাদ্দেক নিউইয়র্কে উপস্থিত হয়ে তেল সমস্যাটি ইরানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে দাবী করেন। এ ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের মতামত দেওয়ার অধিকার নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। অধিকারের প্রশ্নে মতামত দেওয়ার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়টি বিশ্ব আদালতে প্রেরণ করে। ১৯৫৩ সালে বিশ্ব আদালত মতামত প্রকাশ করে যে, ইরানের তেল সমস্যার বিচার করার ক্ষমতা আন্তর্জাতিক আদালতের নেই। এ রায়ে ইরান সরকার ও জনসাধারণ খুশি হলেও দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট জটিল হয়ে ড. মোসাদ্দেকের ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তেল জাতীয়করণ নীতি তাৎক্ষণিকভাবে সফল হয়নি।

অর্থনৈতিক সংকট

অর্থনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ হলো তেল উত্তোলন, পরিশোধন, বাজারজাতকরণে ইরান সরকারের ব্যর্থতা। অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি বিভিন্ন ক্রেতা দেশকে জানিয়ে দেয় যে, ইরান থেকে উত্তোলিত তেল আইনত কোম্পানির সম্পত্তি। কোনো দেশ এই তেল ক্রয় করলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে  ফলে কোনো দেশ তা কিনতে সাহস দেখায়নি।  তাছাড়া তেল পরিবহনের জন্য ট্যাংকার সমিতির মালিকরা ইরান সরকারের সাথে অসহযোগিতা করে। ফলে তেল বাজারজাতকরণেও সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং জাতীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। অর্থনীতির মন্দাভাব দেখা দেয়, বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাহত হয়। এ অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য ড. মোসাদ্দেক মার্কিন সাহায্য কামনা করে কিন্তু মার্কিন সরকার ব্রিটেনের বিরুদ্ধে গিয়ে ইরান সরকারকে সাহায্য দেওয়া থেকে বিরত থাকে।

রাজনৈতিক সংকট

তেল জাতীয়করণের ফলে ইরানে রাজনৈতিক সংকটও তৈরী হয়। বামপন্থি রাজনৈতিক দল ‘তুদেহ পার্টি’ তেল সমস্যাকে কেন্দ্র করে চরম পাশ্চাত্য বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে। ড. মোসাদ্দেক তেলের ব্যাপারে কোম্পানির সাথে কোনো সমঝোতায় আসতে চেষ্টা করলে  তুদেহ পার্টি তাকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করে। ফলে তেল সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তার সচল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাছাড়া তেল জাতীয়করণকে কে কেন্দ্র করে উদ্ভুত রাজনৈতিক সমস্যার সুযোগ নিয়ে ড. মোসাদ্দেকের বিরোধী শক্তিগুলো তার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়। এমনকি তার ন্যাশনাল ফ্রন্টেও ভাঙন দেখা দেয়। ফলে দেশে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। এ অবস্থায় ড. মোসাদ্দেক অধিক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন এবং শাহ এর বিরাগভাজন হন। এর ধারাবাহিকতায় শাহ এক আদেশ বলে তাকে পদচ্যুত করে জেনারেল জাহেদীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন কিন্তু ড. মোসাদ্দেক শাহ এর আদেশ অমান্য করায় শাহ ভীত হয়ে দেশ ত্যাগ করে প্রথমে বাগদাদে এবং পরে রোমে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শাহ এর অনুপস্থিতির সুযোগে বামপন্থি তুদেহ পার্টি রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। এ অবস্থায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। জেনারেল জাহেদী ড. মোসাদ্দেককে গ্রেফতার করে ক্ষমতা দখল করেন। এ সময় শাহ পুনরায় দেশে ফিরে আসেন এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করেন।

ইরানের জাতীয় তেল কোম্পানি সংস্থা গঠন

শাহ পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণের পর জেনারেল জাহেদীকে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ও তেল সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব প্রদান করেন। জেনারেল জাহেদী ৮ টি বিদেশী তেল কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত একটি সংস্থাকে তেল উত্তোলন, পরিশোধন, বাজারজাতকরণের দায়িত্ব দেন। ইরানের জাতীয় তেল কোম্পানি নামে একটি সংস্থার সৃষ্টি হয় এবং এ সংস্থার পক্ষ থেকে উপরিউক্ত যুক্ত সংগঠনে কাজ করবে বলে স্থির হয়। আরো স্থির হয় যে,  ল্যভাংশের অর্ধেক পাবে ইরানের জাতীয় তেল কোম্পানি এবং বাকি অর্ধেক পাবে যক্ত সংগঠন। এভাবে ড. মোসাদ্দেকের তেল জাতীয়করণকে জেনারেল জাহেদী সফল করে তোলেন।

শেষকথা

পরিশেষে বলা যায়, তেল মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সিরিয়া, ইরাক, মিশর, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্রগুলো বিদ্যমান। ১৯৫১ সালে ইরানে ড. মোসাদ্দেক ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য শক্তিদের বিরোধিতা ও নিজ দেশের অর্থনীতির বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তেল জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করেন। তবে এ ব্যাপারে তিনি পূর্ণ সফলতা লাভ করতে না পারলেও ইরানের জাতীয় ইতিহাসে তিনি তেল জাতীয়করণের উদ্যোক্তা হিসেবে স্মরণীয়। তাঁর নীতি অনুসরন করে জেনারেল জাহেদী সফল হন। এ দিক থেকে ড. মোসাদ্দেককে একজন জাতীয়তাবাদী হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়।

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Shanjida Shima is a graduate student at the University of Rajshahi's Department of Islamic History and Culture. She writes from her college days, with a focus on history and literature. She contributes to MaroonPaper on a regular basis. Her articles can be found on MaroonPaper.

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

  • আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

  • ইক্যুইটির ম্যাক্সিম

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা

  • আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা

আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

  • পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয়

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।