কুব্বাত আস-সাখরাই মূলত দ্য ডোম অফ দ্য রক (Dome of the Rock) নামে পরিচিত। সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে নির্মিত চমৎকার ইসলামী সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্য শিল্প ঐতিহ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইমারত এই কুব্বাত আস-সাখরা। এর ঝলমলে সোনার প্লেটেড গম্বুজ থেকে শুরু করে এর জটিল টাইলসের কাজ পর্যন্ত, কুব্বাত আস-সাখরা ইসলামী শিল্প ও নকশার একটি সত্যিকারের মাস্টারপিস। একদিকে যেমন মুসলিম স্থাপত্যকলার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে স্থাপত্য শিল্প গুণ আছে অন্যদিকে এর তাৎপর্য তার শিল্প সৌন্দর্যের বাইরেও আছে; এটি মুসলমানদের কাছে মহান ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্বের একটি স্থান। ইসলামি বিশ্বাস মতে এখান থেকেই থেকে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) মিরাজে গমন করেছিলেন।

শত শত বছর ধরে গম্বুজ অফ দ্য রক ইসলামী সংস্কৃতির স্থায়ী শক্তি এবং স্থিতিস্থাপকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং বিশ্বজুড়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে বিস্ময় এবং বিস্ময়কে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। স্থাপত্য শিল্পের গুরুত্বে কুব্বাত আস-সাখরা একদিকে যেমন অনবদ্য মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাস গড়ে ওঠার কাহিনীকে আমাদের চোখের সামনে উন্মোচন করে অন্যদিকে তেমনি এটির সুসামঞ্জস্য ও ঐশ্বর্য মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের দিগন্তকে প্রসারিত করার ইঙ্গিত দেয়। খোলাফায়ে রাশেদিনের পরবর্তী উমাইয়া শাসনামলের একটি অসামান্য অবদান হলো এই কুব্বাত আস-সাখরা।

কুব্বাত আস-সাখরার অবস্থান

ডোম অব দ্য রক বা আরবি ভাষায় কুব্বাত আস-সাখরা ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের পুরাতন শহরে অবস্থিত। উমাইয়া খলিফা আবদ আল-মালিক ৬৮৪ সনে সিরিয়া ও মিশরের খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। কাবা গৃহের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তিনি সিরিয়ায় একটি ইমারত নির্মাণের মনস্থ করেন। হাদীস অনুসারে, হারাম শরীফস্থিত মোড়িয়া পাহাড়ের শীর্ষ হতে মহানবী (সাঃ) মিরাজে গমন করেছিলেন বলে এই স্থানকেই উপযুক্ত স্থান বিবেচনা করে কুব্বাত আস-সাখরা নির্মাণের আদেশ দেন।

বিশেষত, এটি আরবি ভাষায় টেম্পল মাউন্ট বা হারাম আল-শরিফ নামে পরিচিত 35 একর কম্পাউন্ডের একটি কাঠামোর ওপর অবস্থিত। এখানে আল-আকসা মসজিদ এবং আরো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ভবনগুলি অন্তর্ভুক্ত। পুরানো শহরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত টেম্পল মাউন্ট বা আল-হারাম আল-কুদসি আশ-শরিফ বলে পরিচিত স্থানের উপরে কুব্বাত আস-সাখরার অবস্থান। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত হওয়ার সুবাদে গোটা শহরের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই থাকে এবং পায়ে হেঁটে বা গাড়িতে সহজেই এখানে যাওয়া যায়।

নির্মাতা ও নির্মাণকাল

গম্বুজ অব দ্য রক বা আরবি ভাষায় কুব্বাত আস-সাখরা নির্মাণের কাজ উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান কর্তৃক শুরু হয়। এর নির্মাণকাল নিয়ে মতের ভিন্নতা দেখা যায়। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম এর মতে, ৬৮৮-৯১ সালের মধ্যে এটি নির্মিত হয়েছে। অন্যদিকে রিচমন্ডের (Richmond) মতানুসারে, এর নির্মাণকাজ ৬৮৭ সালে শুরু হয়ে ৬৯১ সালে শেষ হয়। আবার অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন,আবদ আল-মালিক সিংহাসনে বসেই কুব্বাত আস-সাখরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ৬৮৪ সনেই এর নির্মাণকার্য শুরু করেন।

কুব্বাত আস-সাখরার সংস্কার

কুব্বাত আস-সাখরার নির্মান, পরিবর্ধন, উন্নয়ন সাধন হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে সময়ে সময়ে। নিচে কুব্বাত আস-সাখরার একটি কালানুক্রমিক বিবরণ আলোচনা করা হলোঃ

  • ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দঃ সিরিয়ার স্থপতি রাজা ইবনে হায়াওয়ার তত্ত্বাবধানে কুব্বাত আস-সাখরার বা ডোম অব দ্য রকের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কাঠামোর জন্য টেম্পল মাউন্টের সর্বোচ্চ বিন্দু নির্বাচন করা হয়।এই স্থানটি মুসলমান এবং ইহুদি উভয়ের জন্য একটি পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচিত হত।
  • ৬৯১ খ্রিস্টাব্দঃ নির্মাণ শুরু হওয়ার এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে কুব্বাত আস-সাখরার বা ডোম অফ দ্য রক সম্পন্ন হয়। কাঠামোটিতে স্থানীয় চুনাপাথর ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছিল এবং জটিল মোজাইক এবং কুরআনের শিলালিপি দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছিল। গম্বুজটি সোনার পাতায় আচ্ছাদিত ছিল এবং একটি আলংকারিক ফিনিয়াল দিয়ে শীর্ষে ছিল।
  • ৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দঃ একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প কুব্বাত আস-সাখরার বা ডোম অব দ্য রকের ক্ষতি করে, যার ফলে গম্বুজটি ধসে পড়ে। আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের নির্দেশে কাঠামোটি দ্রুত মেরামত করা হয়।
  • ১০১৬ খ্রিস্টাব্দঃ আরেকটি ভূমিকম্প শিলা গম্বুজের ক্ষতি করে, যার ফলে উল্লেখযোগ্য কাঠামোগত ক্ষতি হয়। ফাতিমীয় খলিফা আল-হাকিম বি-আমরের নির্দেশে কাঠামোটি মেরামত করা হয়।
  • ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দঃ ১০৯৯ সালে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে নেয়।তারা কুব্বাত আস সাখরা অগাস্টিনিয়ানদের দিয়ে দেয়া হয়। তারা এটিকে গির্জায় রূপান্তর করে এবং আল-আকসা মসজিদকে রাজকীয় প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। নাইটস টেম্পলাররা কুব্বাত আস সাখরার স্থানটিকে সুলায়মান (আঃ) কর্তৃক নির্মিত উপাসনালয়ের স্থান বলে বিশ্বাস করত। পরবর্তীতে তারা পার্শ্ববর্তী আল আকসা মসজিদে সদরদপ্তর স্থাপন করে। এরপরে ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর মুসলিম সেনাপতি সালাউদ্দিন কুব্বাত আস-সাখরার বা ডোম অব দ্য রককে ক্রুসেডারদের হাত  থেকে দখলমুক্ত করেন। এসময় সালাউদ্দিনের ভাতিজা আল মালিক আল মুয়াজ্জাম ঈসা ভবনের পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তার সময়ে কুব্বাত আস-সাখরার চূড়ায় স্থাপিত ক্রুশকে সরিয়ে সেখানে ইসলামী চাঁদ স্থাপন করা হয় এবং নিচে পাথরের চারপাশে কাঠের আবরণ দেয়া হয়। 
  • ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দঃ উসমানীয় সুলতান সুলেইমান কুব্বাত আস-সাখরার বা ডোম অব দ্য রকের একটি বড় সংস্কারের আদেশ দেন। এই সংস্কারে অধীনে নতুন টাইলস, শিলালিপি এবং আলংকারিক উপাদান সংযোজন করা হয়। এ কাজের জন্য সাত বছর সময় লাগে।
  • ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দঃ মুহাম্মদ আমিন আল হুসাইনি ১৯১৭ সালে ফিলিস্তিন মেন্ডেটের গ্র্যান্ড মুফতি নিযুক্ত হয়ে কুব্বাত আস সাখরা ও আল আকসা মসজিদের সংস্কার করেন।
  • ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দঃ ১৯২৭ সালের ১১ জুলাই ফিলিস্তিনে সংঘটিত ভূমিকম্পে কুব্বাত আস সাখরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিপূর্বে সম্পাদিত সংস্কারগুলো এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দঃ ১৯৫৫ সালে জর্ডান সরকার সম্প্রসারণমূলক পুনর্গঠন কাজ শুরু করে। প্রতিবেশি দেশগুলি এতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। সুলতান সুলাইমানের সময় স্থাপিত বেশ কিছু টাইলস অতিবৃষ্টির ফলে এগুলো স্থানচ্যুত হওায় এসময় নতুন করে প্রতিস্থাপন করা হয়। ১৯৬৫ সালে এই সংস্কারের অংশ হিসেবে গম্বুজটি এলুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ মিশ্রণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ১৯৬৪ সালের আগস্টে সংস্কারকার্য সমাপ্ত হয়।
  • ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দঃ ১৯৯৩ সালে গম্বুজের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য জর্ডানের রাজা হুসাইন ৮.২ মিলিয়ন ডলার দান করেন। ১৯৯৪ সালে কুব্বাত আস-সাখরার বা ডোম অব দ্য রকে নতুন আরেকটি বড় সংস্কার ও পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়। এরমধ্যে মোজাইক এবং টাইলের পরিষ্কার এবং মেরামতের কাজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফিলিস্তিনি এবং জর্ডানের কারিগরদের একটি দল পুনরুদ্ধারের কাজটি করেন।

আজ, গম্বুজ অফ দ্য রক প্রাথমিক ইসলামী স্থাপত্যের সবচেয়ে আইকনিক এবং সুসংরক্ষিত উদাহরণগুলির মধ্যে একটি হিসাবে রয়ে গেছে এবং এটি বিশ্বজুড়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে বিস্ময় এবং বিস্ময়কে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

আরো পড়ুনঃ গৌড়ের সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্য নির্মান কৌশল

কুব্বাত আস-সাখরার নির্মাণশৈলী

কুব্বাত আস-সাখরা আরব তথা মুসলিম বিদ্যমান ইমারতসমূহের মধ্যে প্রাচীনতম। তাই এটির মূল বিবরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিগত তেরশত বৎসরে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যকৃত ধ্বংস সাধনের ফলে এর এত সংস্কার সাধন হয়েছে যে, এর মূল রূপের বিবরণ সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠন করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তবে এর নির্মাণশৈলী সারা বিশ্বের বহু নির্মাণকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইতালির সেন্ট গিয়াকোমোর অষ্টভুজাকার চার্চ, ইস্তাম্বুলের সুলতান সুলেমানের সমাধি, বুদাপেস্টের অষ্টভুজাকার মুরিশ রিভাইভাল স্টাইলের রুম্বাচ স্ট্রিট সিনাগগ এবং জার্মানির বার্লিনের নিউ সিনাগগ ইত্যাদি।

কুব্বাত আস-সাখরার নির্মাণশৈলীকে আমরা দুই ধাপে আলোচনা করব; প্রথমত এর মৌলিক কাঠামো নিয়ে এবং দ্বিতীয়ত এই সাজসজ্জা ও অলংকরণ নিয়ে। নিচে কুব্বাত আস-সাখরার নির্মাণশৈলী বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলোঃ

কুব্বাত আস-সাখরা মূলত দ্য ডোম অফ দ্য রক (Dome of the Rock) নামে পরিচিত। সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে নির্মিত, এই চমৎকার ইসলামী সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্য শিল্প ঐতিহ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইমারত। maroonpaper.com

মৌলিক কাঠামো

কুব্বাত আস-সাখরা বা ডোম দ্য রক প্রাথমিক ইসলামী স্থাপত্যের সবচেয়ে মৌলিক এবং সুসংরক্ষিত উদাহরণগুলির মধ্যে একটি এবং এটি বিশ্বজুড়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে বিস্ময় এবং বিস্ময়কে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। এর বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপঃ

ভূমি নকশা ও পরিকল্পনা

কুব্বাত আস-সাখরার ভূমি নকশাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে তুলে ধরা হলঃ

বৃত্তাকার বেষ্টনী; কুব্বাত আস-সাখরার সর্বাপেক্ষা পবিত্রতম এবং মূল অংশই হচ্ছে বৃত্তাকার বেষ্টনী যা পবিত্র পাথরটিকে ঘিরে আছে। কেন্দ্রস্থিত এই পাথর খন্ডটি আকৃতিতে অসমান। এর উচ্চতা ইমারতের মেঝের চেয়ে সামান্য অধিক এবং দৈর্ঘ ও প্রস্থ যথাক্রমে ৬০ ফুট ও ৪৪ ফুট। বলা হয়ে থাকে, এই পাথরের উপর থেকেই নবীজী (সাঃ) মিরাজে গমন করেছিলেন।

প্রথম অষ্টাভূজ; বৃত্তাকার বেষ্ঠনীর পর আমরা একটি অষ্টভূজাকৃতি পরিকল্পনা দেখতে পাই। এর মাঝেই রয়েছে প্রথম প্রদিক্ষণ পথ।

বহিঃপ্রাচীর; অভ্যন্তরে বৃত্তাকারে স্থাপিত স্তম্ভের সারি হতে বাইরের অষ্টভূজাকৃতির দেওয়াল পর্যন্ত অধিক দূরত্বের কারণে এর মধ্যবর্তী স্থানে আরো এক স্তম্ভ অষ্টভূজাকারে স্থাপন করা হয়েছে। বহিঃদেওয়াল ও এই অষ্টভূজাকৃতির মাঝেই অপর একটি প্রদক্ষিণ পথের সৃষ্টি হয়েছে। বাইরের দেওয়ালটির দৈর্ঘ্য ৬৭.৫ ফুট, প্রস্থ ২৯.৫ ফুট।

প্রবেশ পথ

কুব্বাত আস-সাখরার ভূমি নকশা লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই, এর বহিঃপ্রাচীরের চারদিকে চারটি প্রবেশ পথ রয়েছেঃ

  • উত্তর দিকের প্রবেশ পথ- বাব আল জান্নাহ;
  • দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথ- বাব আল-কিবলাহ;
  • পূর্ব দিকের প্রবেশ পথ- বাব আল-গারীবাহ এবং
  • পশ্চিম দিকের প্রবেশ পথ- বাব আল-সিলসিলা।

আরো পড়ুনঃ প্রাচীন গৌড়ে সুলতানী আমলের স্থাপত্যকর্ম

জানালা

বাহিরের অষ্টভূজের প্রতি দেওয়ালের অর্ধাংশের উপরিভাগে আপাতঃদৃষ্টিতে সাতটি করে জানালা আছে বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে পাঁচটিই জানালা আর বাকি দুটি বন্ধ প্যানেল।

খিলান ও স্তম্ভ

মুসলিম স্থাপত্য খিলান ভিত্তিক, এ কথাটির শুভ সূচনা আমরা কুব্বাত আস-সাখরায় দেখতে পাই। প্রথম বৃত্তাকার পরিকল্পনাতে ১৬টি স্তম্ভের উপর ১৬ টি খিলান অপরদিকে দ্বিতীয় অষ্টভূজাকৃতির পরিকল্পনাতে ২৪ টি স্তম্ভের উপর ২৪ টি খিলান দেখতে পাই। এ সমস্ত খিলানই অর্ধবৃত্তাকৃতির।

ড্রাম বা পিপা

খিলানের শীর্ষদেশের উপর একটি ড্রাম বা পিপা নির্মিত হয়। এর ব্যাস ৬৮ ফুট। এ পিপার উপর নির্ভর করে ইমারতের বিখ্যাত গম্বুজটি নির্মিত হয়। এ পিপার চতুর্দিকে ১৬ টি জানালা আছে।

ছাদ

কুব্বাত আস-সাখরার ছাদকে দুটি অংশে ভাগ করা যায়ঃ

প্রথমাংশ; কেন্দ্র গম্বুজাবৃত।

দ্বিতীয়াংশ; ঢালু ছাদ দ্বারা আবৃত, কাঠ ও সীসা দ্বারা এটি প্রথম ও দ্বিতীয় অষ্টাভূজের উপর নির্মিত।

গম্বুজ

সীসা দিয়ে আবৃত কাঠের গম্বুজের প্রাচীনতম উদাহরণগুলির মধ্যে একটি হল কুব্বাত আস সাখরা  বা ডোম দ্য রকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হ’ল এর গম্বুজ। কুব্বাত আস-সাখরার অভ্যন্তরে গোলাকার বৃত্তাকৃতির করে সাজানো স্তম্ভসমূহের অর্ধ-বৃত্তাকৃতিখিলানের উপরই কাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত বিখ্যাত “কুব্বাত” বা গম্বুজটি নির্মাণ করা হয়। স্তম্ভসমূহকে পিপার মধ্যে গলিত সীসার উপর স্থাপন করে সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত করা হয়। ১৯৯৪ সালের সংস্কারে এই গম্বুজে স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া হয়।

গম্বুজটি পাজরাকৃতি কাষ্ঠের দুইটি খোলশে তৈরী ছিল এবং এর ব্যাস ৬৭ ফুটের মত ছিল। মেঝে থেকে এটি প্রায় ১১৬ ফুট উঁচুতে অবস্থিত।

সোপান শ্রেণী ও মিহরাব

কুব্বাত আস-সাখরার বৃত্তাকার এলাকার মাঝে যে প্রস্তরখন্ডটি রয়েছে তার নিম্ন গহ্বরে প্রবেশ করার জন্য একটি সোপান শ্রেণৈ আছে। এই সোপান শ্রেণী দ্বারা প্রবেশ করার সময় আবছা অন্ধকারে ডান দিকে একটি মিহরাব দেখতে পাওয়া যায়

অলংকরণ

ডোম অব দ্য রক বা আরবি ভাষায় কুব্বাত আস-সাখরা এর সজ্জা এর অন্যতম চিত্তাকর্ষক বৈশিষ্ট্য। এখানে সাজসজ্জার কিছু বিবরণ দেওয়া হলঃ

মোজাইক

কুব্বাত আস-সাখরার অভ্যন্তরীণ দেয়াল এবং বাইরের সম্মুখভাগের নীচের অংশগুলি রঙিন মোজাইকে আচ্ছাদিত। মোজাইকগুলি কাচ, পাথর এবং সিরামিকের ছোট, রঙিন টুকরা দিয়ে গঠিত। কুরআন এবং অন্যান্য ইসলামী গ্রন্থ থেকে শিলালিপি তৈরি করার জন্য ক্যালিগ্রাফিক, জটিল জ্যামিতিক নিদর্শন, এবং স্টাইলাইজড ফুলের মোটিফ যত্নসহকারে সাজানো হয়েছে।

টাইলওয়ার্ক

কুব্বাত আস-সাখরার বাইরের সম্মুখভাগের উপরের অংশগুলি প্রাণবন্ত টাইলওয়ার্কে আচ্ছাদিত। টাইলসগুলি প্রধানত নীল, সবুজ এবং সোনালী রঙের এবং জ্যামিতিক নিদর্শন, ক্যালিগ্রাফিক শিলালিপি এবং স্টাইলাইজড ফুলের মোটিফের নকশায় সাজানো হয়েছে। টাইলসগুলি প্লাস্টারে সেট করা হয় এবং সম্মুখভাগের বাঁকা পৃষ্ঠগুলিতে ফিট করার জন্য কাটা হয়।

ক্যালিগ্রাফি

কুব্বাত আস-সাখরা বা ডোম অব দ্য রকের অলংকরণের অন্যতম একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল ক্যালিগ্রাফিক শিলালিপিগুলি। শিলালিপিগুলি আরবি লিপিতে লেখা হয়েছে এবং এতে কুরআনের আয়াত রয়েছে, পাশাপাশি মুহাম্মদ (সাঃ)এবং উমাইয়া খলিফাদের প্রশংসা রয়েছে। শিলালিপিগুলি সাধারণত বোল্ড, স্টাইলাইজড অক্ষরে লেখা হয়েছে।

খোদাই করা পাথর

 কুব্বাত আস-সাখরা বা ডোম অব দ্য রককে ঘিরে থাকা তোরণের স্তম্ভ, খিলানগুলো খোদাই করা পাথর দিয়ে তৈরি। কুব্বাত আস-সাখরার পাথরটি প্রধানত মার্বেল এবং গ্রানাইট, এবং জটিল জ্যামিতিক নিদর্শন, স্টাইলাইজড ফুলের মোটিফ এবং ক্যালিগ্রাফিক শিলালিপি দিয়ে খোদাই করা হয়েছে। খোদাইগুলি সূক্ষ্মভাবে বিশদভাবে বিশদ এবং পাথর খোদাই কৌশলগুলির দক্ষতা প্রদর্শন করে।

স্বর্ণখচিত পাতার নকশা

কুব্বাত আস-সাখরা বা ডোম দ্য রকের গম্বুজটি স্বর্ণখচিত পাতায় আচ্ছাদিত। গিল্ডিং নামে পরিচিত একটি কৌশলে স্বর্ণখচিত পাতার নকশা গম্বুজে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে গম্বুজের পৃষ্ঠতলে স্বর্ণের পাতলা চাদর জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যারফলে গম্বুজটি অনেক দূর থেকেই দৃশ্যমান হয়।

সামগ্রিকভাবে, গম্বুজ অফ দ্য রকের সাজসজ্জা মোজাইক, টাইলওয়ার্ক, ক্যালিগ্রাফি, খোদাই করা পাথর এবং সোনার পাতার একটি দুর্দান্ত সংমিশ্রণ। সাজসজ্জা জটিল, রঙিন এবং অর্থবহ, এবং ইসলামী বিশ্বের সমৃদ্ধ শৈল্পিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে।

আরো পড়ুনঃ প্রাচীন গৌড়ে মুঘল আমলের স্থাপত্যকর্ম

কুব্বাত আস-সাখরার ধর্মীয় তাৎপর্য

ডোম অব দ্য রক, বা আরবি ভাষায় কুব্বাত আস-সাখরা, মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের জন্য বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান। এর ধর্মীয় তাৎপর্য কিছু ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছেঃ

ইসলামি তাৎপর্য

মুসলমানদের জন্য কুব্বাত আস-সাখরা বা ডোম দ্য রক বিশ্বের অন্যতম পবিত্র স্থান, মক্কার মসজিদুল হারাম এবং মদিনার নবীর মসজিদের পরে দ্বিতীয়। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী এখান থেকেই মুহাম্মদ (সাঃ) মিরাজ গমন করেছিলেন। গম্বুজের ভিতরের পাথর, ফাউন্ডেশন স্টোন নামে পরিচিত জায়গায় দাঁড়িয়ে নবী ইব্রাহিম (বাইবেলে আব্রাহাম) ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবা নির্মাণ করেছিলেন।

ইহুদি তাৎপর্য

ইহুদিদের জন্য, সাইটটি টেম্পল মাউন্ট নামে পরিচিত এবং এটি জেরুজালেমের প্রথম এবং দ্বিতীয় মন্দিরের স্থান বলে বিশ্বাস করা হয়। এটি যথাক্রমে ব্যাবিলনীয় এবং রোমানদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল। দ্বিতীয় মন্দিরের অবশিষ্ট অংশ পশ্চিম প্রাচীর, বা ওয়াইলিং প্রাচীরটেম্পল মাউন্ট সংলগ্ন অবস্থিত এবং এটি ইহুদিদের তীর্থযাত্রা এবং প্রার্থনার স্থান।

খ্রিস্টান তাৎপর্য

খ্রিস্টানদের জন্য, এই স্থানটি যিশুর জীবনের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্থান বলে বিশ্বাস করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে জেরুজালেমে তাঁর বিজয়ের প্রবেশ, মন্দিরের শুদ্ধিকরণ এবং মন্দিরে তাঁর শিক্ষা। এখানেই রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পিলাতের সামনে যীশুর বিচারের স্থান এবং যেখানে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, কবর দেওয়া হয়েছিল এবং পুনরুত্থিত করা হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।

শেষকথা

ইসলামের ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদীনের পর উমাইয়াদের আগমন এবং তাদের অবদান অপরিসীম। উমাইয়া খলিফাগণ শুধু রাজ্য জয়ের নেশায় বিভোর ছিলেন না বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও স্থাপত্যেও অশেষ কৃতিত্ব রেখে গেছেন। উমাইয়া খলিফা আবদ আল-মালিক নির্মিত কুব্বাত আস-সাখরা আব্রাহামিক বিশ্বাসের বিশেষ করে মুসলিম স্থাপত্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত।

কুব্বাতুস সাখরা সম্পর্কে সর্বাধিক প্রচলিত প্রশ্নাবলি

জেরুসালেমের হারাম আল-শরিফে অবস্থিত কুব্বাতুস সাখরা (কুব্বাত আস-সাখরা) সম্পর্কে মানুষের মনে নানান প্রশ্ন জাগে। নিচে এরকম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের তথ্যসমৃদ্ধ ও বিশ্বস্ত উত্তর দেওয়া হলোঃ

১. কুব্বাত আস-সাখরা কী এবং কোথায় অবস্থিত?

কুব্বাতাস-সাখরা হলো জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাসে (পুরাতন শহর) অবস্থিত আল-আকসা কমপ্লেক্সের কেন্দ্রে একটি ইসলামি স্মৃতিস্তম্ভ​। ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক হলো ৩১°৪৬′৪১″ উত্তর ৩৫°১৪′০৭″ পূর্ব। এই সোনালি গম্বুজধারী অষ্টভুজাকৃতির নির্মাণটি মুসলিম নকশাশৈলীর অন্যতম পুরাতন নিদর্শন এবং বিশ্বে সংরক্ষিত সর্বপ্রাচীন ইসলামি স্থাপত্যগুলির অন্যতম​। ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে, এবং জেরুজালেমের পরিচিত স্মারকগুলির অন্যতম বলে বিবেচিত​।

২. “কুব্বাত আস-সাখরা” নামের বাংলা ও আরবি অর্থ কী?

কুব্বাতাস-সাখরা (আরবি: কুব্বাত আস-সাখরা, قبة الصخرة) নামের অর্থ “শিলার গম্বুজ”​। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে এটিকে সাধারণত “শিলার গম্বুজ” নামেও ডাকা হয়। ইংরেজিতে এর সমার্থক নাম “Dome of the Rock”। এছাড়া এর আরেক রূপ “ কুব্বাতাস-সাখরা” বা “কুব্বাতুস-সাখরা” হিসেবেও প্রচলিত।

৩. কুব্বাতুস সাখরা কে নির্মাণ করেন?

এই মহান স্থাপত্যকীর্তিটি নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান। ৬৯১ খ্রিস্টাব্দে (৬৮৫-৬৯২ সালের মধ্যে) এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। এটি ইসলামী স্থাপত্যের প্রাচীনতম উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত এবং বাইজেন্টাইন ও রোমান স্থাপত্য শৈলীর মিশ্রণে তৈরি। খলিফা আব্দুল মালিকের নির্দেশে জেরুসালেমের দক্ষিণাংশে টেম্পল মাউন্টের ওপর এই গম্বুজটি স্থাপন করা হয়, যা বর্তমানে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

৪. কুব্বাতাস-সাখরা ও আল-আকসা মসজিদের সম্পর্ক কী?

কুব্বাত আস-সাখরা আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সের অন্তর্গত হলেও এটি নিজস্ব গম্বুজবিশিষ্ট একটি স্মৃতিস্তম্ভ​। আল-আকসা মূলত উক্ত কমপ্লেক্সের পাশে অবস্থিত প্রধান প্রার্থনালয়কে বোঝায়। সাধারণভাবে বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকাটির পুরো অংশকেই ‘আল-আকসা’ নামে ডাকা হয়, তাই অনেক সময় ভুলক্রমে কুব্বাতাস-সাখরাকেও আল-আকসা মসজিদের অংশ ধরে নেওয়া হয়। সত্যিকার অর্থে আল-আকসা মসজিদের প্রধান হলটি থেকে কিছুটা পশ্চিমে এবং কুব্বাতাস-সাখরা থেকে দক্ষিণে অবস্থিত।

৫. কুব্বাত আস-সাখরার ভৌগোলিক গুরুত্ব কী?

এই স্থানটি ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম-তিন ধর্মের জন্যই পবিত্র। ইসলামে একে মসজিদ আল-আকসা কম্প্লেক্সের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা মুসলমানদের প্রথম কিবলা ছিল। ইহুদি বিশ্বাস অনুযায়ী, এখানে সলোমনের মন্দির (হাইকাল সুলাইমানি) অবস্থিত ছিল এবং এই পাথরটিই বিশ্ব সৃষ্টির সূচনাবিন্দু।

৬. মুসলমানদের কাছে কুব্বাত আস-সাখরার ধর্মীয় তাৎপর্য কী?

এই স্থানটি ইসরা ও মিরাজের ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত। হাদিস ও কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, নবী মুহাম্মদ (সা.) বুরাকে চড়ে মক্কা থেকে জেরুসালেমের আল-আকসা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করেন এবং সেখান থেকে সপ্তম আসমান পর্যন্ত ঊর্ধ্বারোহণ করেন। পবিত্র কুরআনের সুরা আল-ইসরাতে এ ঘটনার উল্লেখ আছে:

“পবিত্র মহান সেই সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত…” (১৭:১)।

তবে কিছু ইসলামিক পণ্ডিতের মতে, গম্বুজটি নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টানদের গির্জার মোকাবিলায় ইসলামের স্থাপত্য শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

৫. ইহুদি ও খ্রিস্টানদের নিকট এর গুরুত্ব কী?

ইহুদিদের জন্য এটি ফাউন্ডেশন স্টোন নামে পরিচিত, যা সৃষ্টির সূচনা ও আব্রাহামের কুরবানির স্থান বলে বিবেচিত। তারা বিশ্বাস করে, এই পাথরেই আদম (আ.) সৃষ্টি হয়েছিলেন এবং ইব্রাহিম (আ.) ইসমাঈল (আ.)-কে কুরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। অন্যদিকে, খ্রিস্টানদের কাছে এটি যিশুর ধর্মপ্রচার ও মন্দির পরিষ্কারকরণের স্মৃতিবাহী স্থান। বাইজেন্টাইন আমলে এখানে গির্জা নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও উমাইয়ারা তা প্রতিহত করে।

. কুব্বাত আস-সাখরার স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য কী?

কুব্বাত আস-সাখরার মূল নকশা একটি অষ্টভুজ আকৃতির ভবন, যার কেন্দ্রে প্রায় ২০ মিটার ব্যাসের বিশাল সোনালী গম্বুজ আছে​। অষ্টভুজাকার নকশার এই স্থাপনায় বাইজেন্টাইন মোজাইক, রোমান স্তম্ভ ও ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির সমন্বয় দেখা যায়। অষ্টভুজের প্রাচীরের উপর নান্দনিক উসমানীয় নীল-সাদা ইজনিক টাইলসের কারুকাজ দেখা যায়​। ভেতরের দেয়ালে কুরআনের আয়াত খচিত আছে, যা ইসলামের প্রাথমিক যুগের লিপিশৈলীর নিদর্শন। গম্বুজের নিচে অবস্থিত সাখরা পাথর প্রায় ১৮ মিটার × ১৩ মিটার আয়তনের এবং এর নিচে একটি গুহা আছে। ভেতরে দেয়াল ও গম্বুজাবৃত্তিতে বিখ্যাত মোজাইক ও মার্বেল পট্টিকা দ্বারা মনোরম সজ্জা করা আছে, যা বাইজানটাইন শিল্পের প্রভাববাহী নকশা বহন করে। অনেকে মনে করেন এর নকশা প্রাচীন বাইজানটাইন গির্জা ও প্রাসাদের অনুকরণে নির্মিত​।

৭. বর্তমানে কুব্বাতুস সাখরার রাজনৈতিক প্রভাব কী?

এটি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের প্রতীক। কিছু ইহুদি গোষ্ঠী (যেমন: টেম্পল ইনস্টিটিউট) গম্বুজটি সরিয়ে তৃতীয় মন্দির নির্মাণের দাবি জানায়, যা মুসলিম বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, খ্রিস্টান মিল্লেরিয়ামবাদীরা একে যিশুর দ্বিতীয় আগমনের পূর্বশর্ত মনে করে। জর্ডানের ওয়াকফ মন্ত্রণালয় এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকলেও ইসরায়েলি সেনারা স্থানটি নিয়ন্ত্রণ করে।

৮. সাখরা পাথর সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি কী?

ইসলামে এই পাথরটি সরাসরি কোনো ইবাদতের অংশ নয়, বরং এটি আল-আকসা মসজিদের একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। খলিফা উমর (রা.) এখানে মসজিদ নির্মাণকালে ইহুদি প্রভাব এড়াতে পাথরটিকে কিবলার পেছনে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেছিলেন, “আমাদেরকে পাথর পূজার নির্দেশ দেওয়া হয়নি, বরং কাবাকে সম্মান করতে বলা হয়েছে”। তবে সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে এ পাথরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কিসসা প্রচলিত আছে, যা অধিকাংশই দুর্বল সনদভিত্তিক।

৯. এই স্থাপনা সংরক্ষণে বর্তমান চ্যালেঞ্জ কী?

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জর্ডানের ওয়াকফ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ চলমান। এছাড়া, পর্যটকদের ভিড়, প্রাকৃতিক ক্ষয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সংরক্ষণ কাজে বাধা সৃষ্টি করে। ১৯৯০-এর দশকে এক ইহুদি গ্রুপ গম্বুজের নিচে সুরঙ্গ খনন শুরু করলে মুসলিমরা বিক্ষোভ করলে বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়।

১০. ইতিহাসে কুব্বাতাস-সাখরার উল্লেখযোগ্য ঘটনা কী কী?

কুব্বাতাস-সাখরা শতবর্ষের ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে একটি ভূমিকম্পে মূল গম্বুজটি ধ্বসে পড়ে এবং ১০২২–২৩ খ্রিস্টাব্দে পুনর্নির্মাণ করা হয়​। ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করলে এটিকে খ্রিস্টান গীর্জায় পরিণত করে ‘টেম্পল অফ গড’ নামে ডাকে​। নাইটস টেম্পলাররা এটিকে সোলোমনের মন্দির হিসেবে মনে করত​। পরবর্তী সময়ে সালাহউদ্দিন জেরুজালেম মুক্ত করার পর পুনরায় এটি মুসলমানদের হাতে ফেরে।

১১. কুব্বাতাস-সাখরার পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের ইতিহাস কী?

এই স্থাপনাটি বহুবার সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ হয়েছে। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতি হলেও, ১০১৫ সালে একটি ভূমিকম্পে গম্বুজটি ধসে যায়​। পরে আব্বাসি খলিফা আল-মানসুরের শাসনামলে ১০২২–২৩ সালে এটি পুনঃনির্মাণ করা হয়​। উসমানীয় যুগে বাহিরের দেওয়ালে প্রাচীন ইজনিক মোজাইক টাইলস লাগানো হয়​। আধুনিক যুগে ১৯৫৯–৬১ এবং ১৯৯৩ সালে বহির্গাম্ভুজটি সোনায় আবৃত করা হয়, ফলে এটি চিত্তাকর্ষক সোনালি গম্বুজে রূপ নেয়​। এসব সংস্কারের ফলে কুব্বাতাস-সাখরা আজ এতদূর উজ্জ্বল ও মুগ্ধকর রূপ ধারণ করেছে।

১২. সাধারণ দর্শনার্থীরা কি কুব্বাতুস সাখরা পরিদর্শন করতে পারবে?

হ্যাঁ, তবে ইসরায়েলি ভিসা প্রয়োজন এবং নিরাপত্তা জটিলতা রয়েছে। মুসলিমদের জন্য সকালের নির্দিষ্ট সময়ে প্রবেশের অনুমতি মেলে, অমুসলিমদের জন্য সীমিত সময়ে পরিদর্শনের সুযোগ থাকে। ভেতরে প্রবেশকালে পোশাক-পরিচ্ছদের ইসলামিক রীতিমেনে শালীন হতে হয়। ফটোগ্রাফি নিষেধ নয়, তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এমন আচরণ এড়ানো বাধ্যতামূলক।

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Shanjida Shima is a graduate student at the University of Rajshahi's Department of Islamic History and Culture. She writes from her college days, with a focus on history and literature. She contributes to MaroonPaper on a regular basis. Her articles can be found on MaroonPaper.

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

  • আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

  • ইক্যুইটির ম্যাক্সিম

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা

  • আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা

আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

  • পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয়

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।