আমরা কথা বলি, প্রতিদিন বলি। যখন তখন, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা বলি। পক্ষে কথা বলি বা বিপক্ষে কথা বলি। ভেবে কথা বলি আবার কখনো না ভেবেই কথা বলি। গায়ে পড়ে কথা বলি কিংবা গা বাঁচানোর জন্য কথা বলি। কোন কথা আমাদের রাজনৈতিক আবার কোন কথা রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আবার কোনটা একেবারেই অরাজনৈতিক। নির্দিষ্ট সীমারেখার ভেতরে থেকেই কথা বলি আবার সীমারেখা অতিক্রম করেও কথা বলি। কিন্তু কেন আমরা কথা বলি? এই “কথা বলা আমাদের অধিকার” জন্যেই কি শুধু কথা বলি নাকি কথা বলাটা একটা কর্তব্যও বটে? যখন তখন, যা খুশি ,যাচ্ছেতাই কথা বলব নাকি, পরিশীলিত ও যথোপযুক্ত মাত্রই কথা বলব? শুধুমাত্র কথা বলাই কি মত প্রকাশের স্বাধীনতার অংশ নাকি সংবাদ পত্র, ব্যঙ্গচিত্র, ধর্ম পালন ইত্যাদি এসবও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত? এইসব প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা একটা বিষয়ের দিকে আমাদেরকে নির্দেশ করছে, সেটা হলো, কথা বলার অধিকার, মতামত প্রকাশের অধিকার। সেটা কথা বলেই হোক আর ব্যঙ্গচিত্র কিংবা সংবাদ প্রকাশ অথবা ধর্মীয় আচার পালনের মাধ্যমেই হোক না কেন। আমাদের এই অধিকার কতটুকু বা কতখানি যেখান থেকে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় কথা বলব কিংবা কিভাবে বুঝবো যে, কোনটা কথা প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর না উপকারি, অনুমোদিত না অননুমোদিত বা কোনটা অধিকারবর্জিত সেটা ঠিক করার মাপকাঠি কোনটা হতে পারে সেদিকটাই মুলত আমাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত।
মত প্রকাশের বা বাক স্বাধীনতা কাকে বলে?
মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা বাক স্বাধীনতা কাকে বলে এটা বোঝার আগে এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে যে, আপনার যাচ্ছেতাই বলার অধিকারই বাক-স্বাধীনতা নয়। বরং, ‘যেকোনো উপায়ে সব ধরনের তথ্য ও চিন্তা খোঁজার, গ্রহণ ও প্রদান করার অধিকারই হল বাকস্বাধীনতা’। বাক স্বাধীনতা কাকে বলে এর সংজ্ঞা খুঁজতে আমরা কিছু নির্ভরযোগ্য উৎস যাচাই করব।
Universal Declaration of Human Rights বা মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষনাপত্রের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “প্রত্যেকেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে; এই অধিকারের মধ্যে রয়েছে হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত রাখার স্বাধীনতা এবং দেশের সীমানা পেরিয়ে যেকোন মিডিয়ার মাধ্যমে তথ্য ও বিশ্বাস খোঁজা, গ্রহণ ও প্রদান করা। “অর্থাৎ, নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে সবারই মত প্রকাশের বা কথা বলার স্বাধীনতা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় বা তদরূপ গোষ্ঠীর কোন ধরণের হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত প্রকাশ ও গ্রহণ করার অধিকার রয়েছে।

International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) বা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রত্যেকের মতামত রাখার অধিকার থাকবে। প্রত্যেকের ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার থাকবে; দেশের সীমানা নির্বিশেষে এই অধিকারের মধ্যে সব ধরণের তথ্য এবং বিশ্বাস খোঁজা, গ্রহণ ও প্রদান করার স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত থাকবে, সেটা মৌখিকভাবে বা লেখা অথবা ছাপা, শিল্প আকারে বা তার পছন্দের অন্য যেকোনো মাধ্যমে থাকুক না কেন। “
European Convention for the Protection of Human Rights and Fundamental Freedoms বা মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার সুরক্ষা সংক্রান্ত ইউরোপীয় কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৯ অনুযায়ী প্রত্যেকের চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতা রয়েছে। এবং অনুচ্ছেদ ১০ অনুযায়ী, “প্রত্যেকেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। দেশের সীমানা নির্বিশেষে ও সরকারী কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই এই অধিকারের মধ্যে মতামত রাখার এবং তথ্য ও বিশ্বাস গ্রহণ এবং প্রদান করার স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রগুলিকে সম্প্রচার, টেলিভিশন বা সিনেমাকে লাইসেন্সের বা অনুমোদনের শর্তারোপ থেকে বিরত রাখবে না।“
How Sikkim became a part of India?
American Convention on Human Rights বা মানবাধিকার সংক্রান্ত আমেরিকান কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১৩ অনুযায়ী, “প্রত্যেকেরই চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। দেশের সীমানা নির্বিশেষে এই অধিকারের মধ্যে রয়েছে তথ্য এবং বিশ্বাস খোঁজার, গ্রহন ও প্রদান করার স্বাধীনতা, সেটা মৌখিকভাবে, লিখিতভাবে, মুদ্রণে, শিল্পের আকারে বা ব্যক্তির নিজের পছন্দের অন্য যেকোনো মাধ্যমেই হোক না কেন।“ মানবাধিকার সংক্রান্ত্র আসিয়ান আন্তঃসরকার কমিশনও বাক স্বাধীনতার প্রায় একই সংজ্ঞা গ্রহন করেছে।
The Constitution of the People’s Republic of Bangladesh বা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বাক ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে “চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা“ হিসেবে স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, “প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।”
বাক স্বাধীনতার এসব স্বীকৃত ও প্রসিদ্ধ সংজ্ঞা থেকে আমরা মোটামুটি এই সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি যে, মৌখিক, লিখিত, মুদ্রণে, শিল্পের আকারে বা ব্যক্তির নিজের পছন্দের অন্য যেকোনো মাধ্যমে দেশ ও সীমানা নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই স্বাধীনভাবে চিন্তা ও মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। এই অধিকারকেই বাক স্বাধীনতা বলা হয়। এই বিভিন্ন মাধ্যমে বা উপায়ে আমাদের এই ‘কথা বলার অধিকার’ই হচ্ছে ‘বাকস্বধীনতা’ বা ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ ।
যেকোন ব্যক্তি যেকোনভাবেই তার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতার চর্চা করতে পারেন কোন ধরণের হস্তক্ষেপ ছাড়াই। তবে তার মানে কি এই যে, তিনি অন্যের অধিকারের ওপর অনধিকার চর্চা করে কিংবা রাষ্ট্রীয় বা জন নিরাপত্তার বিঘ্নতা ঘটিয়ে অথবা বিশৃঙ্খলা বা অপরাধ ঘটানোর মাধ্যমে তার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতার চর্চা করতে পারেন? অথবা অন্যভাবে প্রশ্নটা এমন হতে পারে যে, ঠিক কতদুর পর্যন্ত ব্যক্তির চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতার চর্চা করার অধিকার বিস্তৃত?
Is the USA a Leading Terrorist State?
মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত?
আমরা যদি আবার সেসব স্বীকৃত ও প্রসিদ্ধ দলিলে ফিরে যাই তাহলে দেখব যে, বাকস্বাধীনতার সংজ্ঞার সাথে সাথে সেই বাক স্বাধীনতার পরিধি বা গন্ডি কতখানি হতে পারে সেটাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) বা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৯ অনুচ্ছেদের দফা ৩ অনুযায়ী প্রদত্ত অধিকার চর্চার সাথে সাথে বিশেষ কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্নিহিত। কেবল আইন কর্তৃক প্রদত্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিধিনিষেধ সাপেক্ষে এসব অধিকার চর্চা হতে পারে । যেমন- অন্যের অধিকার বা সুনামের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য; জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা, অথবা জনস্বাস্থ্য বা নৈতিকতা রক্ষার জন্য।
European Convention for the Protection of Human Rights and Fundamental Freedoms বা মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার সুরক্ষা সংক্রান্ত ইউরোপীয় কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১০ এর দফা ২ অনুযায়ী, এসব স্বাধীনতা চর্চার মধ্যে আইন দ্বারা নির্ধারিত এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু আনুষ্ঠানিকতা, শর্ত, বিধিনিষেধ বা জরিমানা অন্তর্নিহিত রয়েছে যেগুলো একটি গণতান্ত্রিক সমাজে, জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা বা জননিরাপত্তার স্বার্থে, বিশৃঙ্খলা বা অপরাধ প্রতিরোধের জন্য, স্বাস্থ্য বা নৈতিকতার সুরক্ষার জন্য, অন্যের খ্যাতি বা অধিকার, প্রাপ্ত গোপন তথ্য প্রকাশ প্রতিরোধের জন্য, অথবা বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্য স্বরূপ।
American Convention on Human Rights বা মানবাধিকার সংক্রান্ত আমেরিকান কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১৩ এর দফা ২, ৩, ৪ ও ৫ অনুযায়ী,
- এসব অধিকার চর্চা পূর্বতন কাটছাট বা সেন্সরশীপের আওতাধীন না হলেও পরবর্তিতে যথোপযুক্ত আইন দ্বারা সুস্পষ্টভাবে উত্তরকালীন আরোপযোগ্য দায়বদ্ধতার আওতাধীন হবে। যেমন- অন্যের অধিকার বা সুনামের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য; জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য বা নৈতিকতা রক্ষার জন্য।
- সরকারি বা বেসরকারি কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার অপব্যবহারের মত পরোক্ষ উপায়ে এসব অধিকার চর্চা ব্যাহত বা সংকীর্ণ হবে না।
- তবে শৈশব এবং কৈশোরের নৈতিক সুরক্ষার জন্য জনসাধারণের বিনোদনের বিষয় হতে পারে এমন বিষয় নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উদ্দেশ্যে পূর্বতন সেন্সরশিপ আইনের আওতাধীন হতে পারে।
- যুদ্ধের জন্য উস্কানি এবং জাতীয়, জাতিগত বা ধর্মীয় ঘৃণার যে কোনো সমর্থন, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, বা জাতীয় উৎস সহ যে কোনও ভিত্তিতে সহিংসতা বা অন্য কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনুরূপ পদক্ষেপের প্ররোচনা আইন দ্বারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২ দফায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ-সাপেক্ষে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
Let’s call Israel’s violence what it is: terrorism, not clashes
সব স্বাধীনতার উর্ধ্বে আমাকে জানবার স্বাধীনতা দাও, বলার স্বাধীনতা দাও এবং বিচক্ষণতার সাথে তর্ক করার স্বাধীনতা দাও।
জন মিল্টন
মত প্রকাশের সংজ্ঞার সাথে অধিকার চর্চার যেসব শর্ত বা নিয়ম নীতি প্রদান করা হয়েছে সেসব পর্যালোচনা করলে কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে আসে, যেমন-
মত প্রকাশের স্বাধীনতা সার্বজনীন
কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠির জন্য এই অধিকার বরাদ্দ নয়। বরং একটি দেশের সব নাগরিক সমান ভাবে এই অধিকার ভোগ করবেন। এই অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আলাদা করে বিশেষায়িত নয় কিংবা বাংলাদেশের জন্য ন্যূনতম নয়। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ সমানভাবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে সমান ও ন্যায্যভাবে এই অধিকারের চর্চা করবে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত
মত প্রকাশের এই স্বাধীনতা একজন ব্যক্তি চর্চা করবেন স্বাধীনভাবে। কোন সরকারি বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ ছাড়াই এই অধিকার চর্চা হবে। কোন ব্যক্তি নারী বলে তার অধিকার কম বা তার অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা যাবে তা নয়। বরং রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সম্পূর্ণ অবাধভাবে এই অধিকার চর্চার পরিবেশ তৈরী করা। একজন ব্যক্তি তার সরকারের বা সরকারি কর্মকর্তার সমালোচনা করতেই পারেন, অবশ্যই পারেন। তার এই সমালোচনা করার জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করা ওই রাষ্ট্র পরিচালনাকারি সরকারের দায়িত্ব। যদি কোনভাবে ব্যক্তির অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ হয় সমালোচনার জন্য তাহলে বুঝতে হবে সেই রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই, ওই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নয়। তবে ব্যক্তি অবশ্যই গঠনমূলক সমালোচনাই করবেন। যদিও আমেরিকান কনভেনশনে যে স্বাধীনতা দেয়া আছে সেখানে একজন ব্যক্তি সে দেশের জাতীয় পতাকা বা প্রতীক পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলতে পারেন এই অধিকারের আওতায়। ১৯৮৯ সালের টেক্সাস বনাম জনসন (Texas v. Johnson) মামলায় বাকস্বাধীনতার একটি রূপ হিসেবে কেউ আমেরিকার জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে ফেলতে পারেন কি না এই প্রশ্নে টেক্সাস আপিল আদালত মনে করেন জনসনের পতাকা পুড়িয়ে ফেলা ছিল একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ। তার এই কাজে ক্ষুণ্ন হবার কিছু নেই। বরং টেক্সাস রাজ্য কোন কাজের একটি নির্দিষ্ট অর্থ দাড় করিয়ে দিতে পারেনা। শুধুমাত্র সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু, সম্মানহানিকর বা অগ্রহণযোগ্য বলে সরকার স্বাধীন মত প্রকাশে হস্তক্ষেপ করতে পারেনা। সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের মত পরোক্ষ উপায়ে এসব অধিকার চর্চা ব্যাহত বা সংকীর্ণ হবে না।
কথা বলার স্বাধীনতা অবশ্যই আছে, কিন্তু ওই কথা বলার পরে তার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারব না।
ইদি আমিন, উগান্ডার রাষ্ট্রপ্রধান
পূর্বতন সেন্সরশীপ অনুমোদিত নয়
যেকোন দেশের নাগরিকের বাকস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকারকে যদি আমরা সংকীর্ণ অর্থে দেখি অর্থাৎ, শুধুমাত্র চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা হিসেবে দেখি তাহলে প্রত্যেকেই সেই অধিকার স্বাধীনভাবে চর্চা করতে পারেন। আর যদি এর সাথে সাথে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেও অন্তর্ভুক্ত করি তাহলে নাগরিকরা আদৌ সেই অধিকার স্বাধীনভাবে চর্চা করতে পারেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়। কিন্তু কোনভাবে কি মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা থেকে আলাদা করা যায়? কোনভাবেই সম্ভব না। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো, মত প্রকাশের স্বাধীনতার যে চরিত্র নির্ধারন করা হয়েছে বিভিন্ন দলিলপত্রে তা এভাবেই চিন্তা বিবেকের স্বাধীনতা থেকে আলাদা করা হয়েছে। সংজ্ঞাগুলোতে বলা হয়েছে মতামত প্রকাশের এই স্বাধীনতা পূর্বতন সেন্সরশীপের আওতায় না পরলেও পরবর্তী সেন্সরশীপের আওতায় পড়তে পারে। অর্থাৎ, আপনি যতক্ষণ চিন্তা করবেন, ভাববেন ততক্ষণ আপনার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা অবারিত। কিন্তু যখনই আপনি আপনার সেই বিবেক প্রসুত চিন্তাকে প্রকাশ করবেন বিভিন্ন মাধ্যমে সেটা লিখে হোক, মূদ্রণে হোক, ব্যাঙ্গাত্মক চিত্রেই হোক আর গান বা সিনেমার মাধ্যমেই হোক না কেন, আপনার সেই অধিকার চর্চার স্বাধীনতা আর অবারিত থাকছে না। সরকার বা কর্তৃপক্ষ চাইলে আপনার অধিকার সাথে সাথেই পরপারে চলে যেতে বাধ্য হবে।
What is cultural aggression? How does it threaten world cultural diversity?
সংবাদ মাধ্যমগুলো যেকোন কিছু প্রকাশ করতে পারেন তবে তা আইনের মধ্যে থেকেই প্রকাশ করতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অনধিকার চর্চা বা আইন বহির্ভূত চর্চা হলেই ওই অধিকার ক্ষুন্ন করা আইনত বৈধ হবে।
জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য বা নৈতিকতা রক্ষার প্রশ্নে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বারিত হতে পারে
রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের মত জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য বা নৈতিকতা রক্ষার প্রশ্নে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বারিত হতে পারে। যুদ্ধের জন্য উস্কানি, জাতিগত বা ধর্মীয় ঘৃণার যে কোনো সমর্থন, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, বা জাতীয় উৎস সহ যে কোনও ভিত্তিতে সহিংসতা বা অন্য কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনুরূপ পদক্ষেপের প্ররোচনা আইন দ্বারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে কেউ যদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ফেলেন, কিংবা বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ককে বিনষ্ট করার চেষ্টা করেন তাহলে সেখানে আপনার অধিকারের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ করাটা অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রীও বিধিনিষেধের আওতাধীন, যাচ্ছেতাই বলতে পারবেন না, তারও জবাবদিহীতা আছে।
Freedom of expression comes with responsibilities, especially when it comes with serious implications for peace.
Mohammed Morsi
যদি কোন ব্যক্তি স্বাধীন মত প্রকাশের অদিকারের আওতায় থেকে কোন নির্দিষ্ট আদর্শ বা ধর্মের নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত উদ্দেশ্যমূলক সমালোচনা করেন, বা দাঙ্গা বা বিশৃঙ্গখলা তৈরী করার চেষ্টা করেন তাহলে সেই ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনত কেড়ে নেয়া রাষ্ট্রর দায়িত্ব।
প্রসিদ্ধ এসব দলিল পর্যবেক্ষনে আমরা দেখতে পাই যে, আমরা আমাদের বাক স্বাধীনতার অধিকার একটি পরিশীলিত, পরিমার্জিত, রুচিশীল ও অনুমোদিত পরিধির ভেতর থেকেই চর্চা করতে পারব। আমাদের বাক স্বাধীনতার অধিকারের একটা পরিধি আছে যেটা সার্বজনীন, প্রসিদ্ধ ও সুস্পষ্ট আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। এই পরিধিটা অন্যের মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জন নিরাপত্তা সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক মূল্যবোধের মত অপরিহার্য্য, গুরুত্বপূর্ণ ও আইন দ্বারা বাধ্যতামূলক বিষয় দ্বারা পরিবেষ্টিত। আপনি ততক্ষণ পর্যন্তই আপনার অধিকার চর্চা করতে পারবেন যতক্ষণ না কোন ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য আপনার অধিকার চর্চা অনধিকার চর্চা হয়ে দাঁড়ায়।
তবে এই পরিধীর ভিত্তি বা এসব বিধিনিষেধ কি সেচ্ছাচারিতামূলকভাবে আরোপিত হতে পারে নাকি শুধুমাত্র অন্যের অধিকার বা সুনামের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য বা জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা, অথবা জনস্বাস্থ্য বা নৈতিকতা রক্ষার মত বিষয়গুলোর ভিত্তিতেই হতে পারে? এই পরিধি নির্ধারণে কি কোন মাপকাঠি আছে?
What does the Rule of Law mean, and what are its fundamental principles?
মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমারেখার মাপকাঠি
অবশ্যই মাপকাঠি আছে। আমরা যেসব প্রসিদ্ধ দলিল নিয়ে আলোচনা করলাম সেগুলোই এই অধিকারের সীমারেখা নির্ধারণের মাপকাঠি। পরিধি নির্ধারণে এসব দলিল অনুযায়ী কিছু নিয়ম নীতি অনুসরণ করা হয় যেমন-
- যতদুর সম্ভব নিষেধাজ্ঞাসমূহকে সঠিকভাবে সুস্পষ্ট হতে হবে।
- জাতীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে সেচ্ছাচারীভাবে যাচ্ছেতাই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবেনা।
- নির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠীর মূল্যবোধকে খাটো করে, বৈষম্যের শিকার করে এমন শর্তারোপ করা যাবেনা;
- অন্যের অধিকার ও সম্মানের বেলায় সরকারি কর্মকর্তাদেরকে সমালোচনা সহনশীল হতে হবে বেরসকারি ব্যক্তিদের তুলনায়। সেই হিসেবে সরকারের সমালোচনাকে মানহানি সংক্রান্ত আইনের আনার ঘৃণিত চর্চা রোধ করতে হবে।
- বিমূর্ত ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস বা অন্যান্য বিশ্বাস বা লোকেদের সংবেদনশীলতাকে রক্ষা করতে হবে।
- সাংবাদিক এবং ব্লগাররাদের বাকস্বাধীনতার অধিকার রক্ষার দায়িত্ব তাদের দেশগুলোর । সংবাদপত্র, টিভি স্টেশন ইত্যাদির উপর বিধিনিষেধ মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে এমন নিয়ম নীতি প্রণয়ন করা যাবেনা।
- রাজনৈতিক প্রতিবাদ, ভাষা ও সংস্কৃতিকে সীমিত করা বা নির্দিষ্ট করা সংকীর্ণ করা যাবেনা।
বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যক্তির বিরদ্ধে কোন অধিকার নয়, এটি সরকারবিরোধী অধিকার। একজন ব্যক্তির নিজেকে প্রকাশ করার অধিকার সরকার সীমাবদ্ধ করতে পারে না, তা জাতীয়ই হোক বা পৌরসভা হোক না কেন। অর্থাৎ, জনগণের রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে সবারই সমান ভাবে আইন ও নীতিকে উপভোগ করার অধিকার আছে। সরকারের কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার থেকে শুরু করে প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই তা করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য সরকারকে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হতে পারে যা মানুষকে স্বাধীনভাবে কথা বলতে দেয়, বা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি দমন করা না হয় তা নিশ্চিত করতে।
তবে কিছু কথা বা মতামত বা প্রকাশনা বাক স্বাধীনতার আওতাভুক্ত হতে পারে কি পারেনা তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। এসব ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অরক্ষিত, সুনিশ্চিত নয়। কিছু ক্ষেত্র আছে গুলোর ভিত্তিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করা যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রগুলোকে দুই প্রেক্ষিতে আলোচনা করা যেতে পারে, শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশে ও দুর্বল গণতন্ত্রের দেশে। শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশে যেসব ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা আইনসম্মত যেগুলো হলো-
মানহানিকর
কোন ব্যক্তির খ্যাতিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আক্রমন করে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো কোনভাবেই বাকস্বাধীনতার আওতাধীন হবেনা। সামনাসামনি কথা বলা ব্যক্তিগত অপমান যা তাত্ক্ষণিক লড়াইয়ের পরিণতি হতে পারে তা শাস্তিযোগ্য। এই ধরণের কাজ দেওয়ানি অপরাধ সৃষ্টি করে; তবে, রাজনৈতিক বিবৃতি যা অন্যদের ক্ষুব্ধ করে এবং তাদের সহিংসতায় উস্কে দেয় তা অন্তর্ভুক্ত নয়। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটার ক্রিস কেয়ার্ন্স ভারতের তৎকালীন আইপিএল চেয়ারম্যান লোলিত মোদির বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে মানহানির মামলা করেন। মামলায় ক্রিস দাবি করেন যে, ২০১০ সালে মোদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে আইপিএল নিলামে কেয়ার্নসকে নিষিদ্ধ করার কারণ হিসাবে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে কথিত জড়িত থাকার “কলঙ্কজনক এবং সম্পূর্ণ অসত্য” কথা উল্লেখ করেছিলেন। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের একটি আদালত ৯০,০০০ পাউন্ড এবং১.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। আমেরিকার দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশি সংবাদপত্র ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৭৯ টি মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয় যেখানে ৬২ টিই মানহানির জন্য দায়ের করা হয়। বাংলাদেশের ৫৩ টি জেলার আদালতে করা এসব মামলায় প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে। আদালত যদি এসব মামলা আমলে নিয়ে তাকে শাস্তি দেন তাহলে তার ১৭৫ বছরের কারাদন্ড হতে পারে।
If we don’t believe in freedom of expression for people we despise, we don’t believe in it at all.
Noam Chomsky
জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা
রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের মত জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার প্রশ্নে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বারিত হতে পারে। যুদ্ধের জন্য উস্কানি, জাতিগত বা ধর্মীয় ঘৃণার যে কোনো সমর্থন, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, বা জাতীয় উৎস সহ যে কোনও ভিত্তিতে সহিংসতা বা অন্য কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনুরূপ পদক্ষেপের প্ররোচনা আইন দ্বারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে।
কোন নির্দিষ্ট আদর্শ বা ধর্মের নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত উদ্দেশ্যমূলক সমালোচনা, বা দাঙ্গা বা বিশৃঙ্গখলা তৈরী করার চেষ্টা মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে না। এমন ক্ষেত্রে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারে সরকার হস্তক্ষেপ করবে।
ভীতিপ্রদর্শন বা হুমকি
কোন অপরাধ ঘটানোর উদ্দেশ্যে ভীতি প্রদর্শনের জন্য হুমকি বাক স্বাধীনতার আওতাবহির্ভুত চর্চা। কট্টরপন্থি বিজেপি শাসিত ভারতে বিজেপি শাসন ভার গহণের পর সরকারের সমালোচনাকারিদের ভীতিপ্রদর্শন বা হুমকি যেন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গেছে। ২০১৭ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে, দ্য কুইন্টের সাংবাদিক দীক্ষা শর্মাকে ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি দেয়া হয় নরেন্দ্র মোদির সমালোচনার কারণে। ঠিক একই কারণে দীক্ষা শর্মার আরো দুই সহকর্মীকে একই হুমকি দেয়া হয়। এশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল নিউজের অভয় কুমার, দ্য হিন্দুর মোহাম্মাদ আলি, ফার্স্টপোস্টের দেবব্রত ঘোষ, এনডিটিভির সোনাল মহাপাত্র কাপুর ভারতের কট্টরপন্থি হিন্দু সংগঠন আরএসএসের সমর্থক ও কর্মীদের থেকে হত্যার হুমকি পান শুধুমাত্র বিজেপি সরকারের সমালোচনার জন্য। রমন কাশ্যপ যিনি ভারতের সাধনা প্রাইম নিউজ টিভি্র জন্য গত ৩ অক্টোবর ভারতের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। ঐ দিন লক্ষিপুরের ক্ষেরি জেলার কৃষক বিক্ষোভের ওপর স্থানীয় মন্ত্রী অজয় কুমার মিশরা তার গাড়ি বহর উঠিয়ে দেন এবং কমপক্ষে ৯ জন বিক্ষোভকারি সেখানে নিহত হন। ওইদিন থেকে রমন কাশ্যপ নিখোঁজ হন এবং তার লাশ একটি মর্গে পরের দিন পাওয়া যায়। সরকার ওই ঘটনার পর লক্ষিপুর জেলায় ৩ দিন ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ রেখেছিল।
Dictatorship and Human Rights: The Ongoing Struggle for Freedom
আদালত অবমাননা
আদালত অবমাননা একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ যেখানে ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা হস্তক্ষেপযোগ্য। পৃথিবীর প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই তার বিচার বিভাগকে সমালোচনার উর্ধ্বে রাখেন এবং কোন ব্যক্তিই অযৌক্তিক, অগ্রহণযোগ্য ও মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে লিখিত বা মৌখিক ভাবে আদালত অবমাননা করতে পারবেন না। এটা তার মত প্রকাশের স্বাধীনতার উর্ধ্বে। আদালতে বিচারধীন কোন বিষয়ে মামলার গুণাগুণ সম্পর্কিত, মামলার পক্ষকে অবজ্ঞাস্বরূপ, মামলার সিদ্ধান্ত না মানা, আদালতে অশ্রদ্ধা বা অন্য যেকোনভাবে আদালতের সম্মানহানি করার চেষ্টাকে আদালত অবমাননা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আদালত অবমাননা বাক স্বাধীনতার আওতাবহির্ভুত।
তবে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ কুমার সিনহার নৈতিক স্খলন ও বিদেশে পলায়ন পূর্ব পরিচালিত মামলা গুলো নিয়ে সমালোচনা কি আদালত অবমাননা হবে তা বিতর্কের বিষয়। আদৌ তার নৈতিক স্খলন হয়েছে কিনা বা তিনি পলায়ন করেছেন কিনা সেগুলো যেমন প্রশ্নবিদ্ধ তেমনি তিনি সরকারের চাপে পড়েই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন কিনা সেটা খুঁজে দেখবার বিষয়। তবে চিন্তার ভাঁজ কপালে পড়ার আগেই একটা সাধারণ বিবেচনা মাথায় রাখলে সুবিধা হবে যে, এমন ঘটনা দুর্বল দেশগুলোতে অহরহই ঘটছে।
অশ্লীলতা এবং শিশু পর্নোগ্রাফি
প্রকৃত অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন কার্যকলাপে জড়িত প্রকৃত অপ্রাপ্তবয়স্কদের ফটোগ্রাফ বা রেকর্ডিংগুলি সুরক্ষিত নয়, কারণ এটি এই ধরনের অপরাধ সংঘটন করার জন্য শিশুদের যৌন নির্যাতনের জন্য একটি প্রণোদনা তৈরি করবে। ১৯৭৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেট ট্রায়াল কোর্টে একটি মামলায় প্রশ্ন ওঠে যে ডাকের মাধ্যমে অশ্লীল সামগ্রীর বিক্রয় এবং বিতরণ কি বাক স্বাধীনতার গ্যারান্টির অধীনে সুরক্ষিত? মামলার এই প্রশ্নে আদালত রায় দেন যে, অশ্লীল সামগ্রী বাক স্বাধীনতার অধীনে সুরক্ষিত নয়।
বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন
একটি পণ্য বা পরিষেবার প্রচারের অধিকার সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত, তবে অন্যান্য বাক স্বাধীনতার মতো নয়। উদাহরণস্বরূপ, সরকার প্রতারণামূলক বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করতে পারে কিন্তু প্রতারণামূলক রাজনৈতিক বক্তৃতা নয়। মিথ্যা তথ্যা সম্বলিত বিজ্ঞাপন যেগুলোতে সাধারণ মানুষের প্রতারিত হওয়ার সুযোগ আছে সেসব যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে প্রচার করা হয় তাহলে সেখানে ওই অধিকার চর্চায় হতক্ষেপ হতে পারে আইনসম্মত ভাবেই।
শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশে যেসব ক্ষেত্রে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার হস্তক্ষেপ করা যায় দুর্বল গণতন্ত্রের দেশে সেসব ক্ষেত্রের পাশাপাশি আরো কিছু ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয় এবং এমন দেশে এই হস্তক্ষেপ্ত আইন করেই বৈধ করা হয়েছে। সেগুলো হলো-
রাষ্ট্রের সমালোচনা
রাষ্টের সমালোচনা যা বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে সেসব অবশ্যই হস্তক্ষেপের আওতাধীন। সেসব ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না বা অনিশ্চত। কিন্তু সমস্যা হলো দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোতে সরকারের সমালোচনাকেই রাষ্ট্রের সমালোচনা বলে মনে করা হয়। বিপত্তিটা বাধে এখানেই। সরকার তার বিরোধী মতকে বা বিরোধী দলগুলোকে দমন করে ‘রাষ্ট্রের সমালোচনা’র অধীনে সংজ্ঞায়িত করে। মাঝে মাঝে এই রাষ্ট্রের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয় সমালোচনার ভুল ব্যখ্যা করে।
How the US and UK tried to justify the invasion of Iraq
If the freedom of speech is taken away then dumb and silent we may be led, like sheep to the slaughter.
George Washington
সরকার কারো রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে তার প্রতি বৈষম্য করতে পারেনা। সরকার দেশকে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল রাখার জন্য আইন প্রণয়ন করে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দিতে বা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি দমিয়ে রাখতে তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক আদর্শ স্বাধীনভাবে প্রচার করতে সক্ষম হওয়া উচিত। কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার এবং আলোচনা অপরিহার্য্য।
বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক
প্রত্যেকটি রাষ্ট্রেরই তার প্রতিবেশি বা বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ভীষণ গুরুত্বপুর্ণ। এই সম্পর্ক রক্ষায় রাষ্ট্র গুলো সর্বদা সচেতন। কোনভাবে বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কহানীকর কোন মতামত রাষ্ট্রগুলো বরদাশত করে না। মত প্রকাশের মাধ্যমে সম্পর্ক বিনষ্ট হয় এমন অধিকারে হস্তক্ষেপ করা আইনের মাধ্যমেই বৈধ করা হয়েছে। তবে তার মানে এই না যে যে কেউ যেয়ে যে কারো কথা বলা বন্ধ করতে তাকে মেরে ফেলতে পারবে বা শাস্তি দিতে পারবে। মত প্রকাশের অধিকারে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা শুধুমাত্র রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের এক ছাত্র আবরার নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমালোচনা করার জন্য। ওই হত্যাকান্ডের পর বিষয়টি এখনো বাংলাদেশের আদালতে বিচারাধীন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃত যেসব মৌলিক অধিকার সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাদের মধ্যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অন্যতম। কোন রাষ্ট্র কতখানি গণতান্ত্রিক বা কল্যাণমুখী বা জনবান্ধব তা বোঝা যায় সে রাষ্ট্রের নাগরিকদের অবস্থা দেখে। নাগরিকরা যদি স্বাধীনভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে পারে তাহলে সে রাষ্ট্র কল্যানমূখীতার শীর্ষে অবস্থান করতে পারে আর যদি স্বাধীনভাবে এই অধিকার চর্চা করতে না পারে তাহলে সে রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়া, রাশীয়া বা চীনের কাতারে চলে আসতে পারে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকতা মাপার অন্যতম একটি ‘আতশ কাঁচ’ হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। তবে এই অধিকারটির স্বরূপ দেশ ভেদে ভিন্ন হতে পারে। কোন দেশে একজন নাগরিক খুব স্পষ্ট করেই তার সরকার বা রাষ্ট্রের অবকাঠামোর বা সরকারি কর্মকর্তাদের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারেন। আবার কোন দেশে সমালোচনা তো দুরের কথা এসব নিয়ে প্রশ্নই করা বিপদজনক। উইকিলিকসের জুলিয়ান এসাঞ্জ বা সৌদি আরবের জামাল খাশোগি কিংবা বাংলাদেশের সাগর-রুনি হত্যা মামলা এর অন্যতম উদাহরণ হয়ে আছে। আবার কিছুদিন আগে মুসলমানদের সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (স) কে ব্যঙ্গ করে ফ্রান্সে ভিন্ন ধর্মী ব্যক্তি মত প্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করতে পারলেও সেই একই দেশের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা ব্যক্তি আটক হয়েছেন ‘রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিকে অসম্মান’ করার কারণে!
বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকারগুলোর একটি এবং সবচেয়ে বেশি ভুল বোঝাবুঝির একটি জায়গা। যারা বঞ্চিত তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য আপনার বাক স্বাধীনতা ব্যবহার করুন। তবে এটি দায়িত্বের সাথে ব্যবহার করুন। তবে দায়িত্বটা কখন ঠিক হবে আর কখন বেঠিক হবে বা কোন দায়িত্বটা পালনীয় আর কোনটা এড়িয়ে যেতে হবে সেটা মূলত একটি রাষ্ট্রের সরকারের নীতির ওপর নির্ভর করে। আর তাই, সতর্কতার সাথে আপনার অধিকারের চর্চা করুন।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।