দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণুশক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তান পুনরায় সংঘাতের গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে, যার প্রেক্ষিতে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে টানা গোলাগুলি, আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি দুদেশের মধ্যে সিমলা চুক্তি, সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতসহ একগুচ্ছ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় পর পরিস্থিতি এতটাই খারাপ, এখন প্রতিনিয়ত ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে গোলাগুলি চলছে। এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একেবারে তলানিতে যেয়ে ঠেকেছে। পাকিস্তান আশঙ্কা করছে আগামী ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে ভারত পাকিস্তানে হামলা করতে পারে। ভারত-পাকিস্তান দুই পরাশক্তির এই সংকটের পটভূমি, সম্ভাব্য প্রভাব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে এই আলোচনা।
পেহেলগাম হামলা: সংঘাতের সূচনাবিন্দু
২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল কাশ্মীরের পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে সশস্ত্র হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর থেকেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, সীমান্তের ওপার থেকে পরিচালিত গোষ্ঠীর সঙ্গে এই হামলার যোগসূত্র রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স” নীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠকে একতরফাভাবে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, আটারী সীমান্ত বন্ধ, পাসপোর্ট বিলোপ এবং নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের গতি-প্রকৃতি সীমিত করার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। এসব প্রতিশোধমূলক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কোনো স্বাধীন তদন্ত ছাড়াই, এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো প্রমাণ ছাড়া। বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৬০ সালের এই সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতকরণ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সর্বোচ্চ শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হামলায় জড়িত সন্ত্রাসী ও তাদের “পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত” খোঁজা হবে। মোদির এই শাস্তি ঘোষণা সম্পর্কে ভারতীয় মিডিয়ায় জল্পনা ছড়িয়েছে, যা ২০১৯ সালের বালাকোট–সংকটের স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছে। বালাকোটের ওই ঘটনায় ভারতীয় বিমান সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে ঢুকে হামলা চালায়, যার উত্তরে পাকিস্তান যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে পাল্টা আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই সংকটকে কূটনৈতিক মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে, পাক-ভারত সীমান্তে কয়েকদিন ধরে গোলাগুলি বিনিময় চলছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে, পাকিস্তানের সেনারা প্রথমে গুলি চালিয়েছে এবং ভারি অস্ত্র মজুত করছে। যদিও পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো বক্তব্য রাখেনি, দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা জুড়ে চাপ তৈরি হয়েছে। একদিকে শক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ভারত ঘোষণা দিয়েছে যে তার জোরালো কূটনৈতিক চাপের নীতি কার্যকর হয়েছে এবং এটিকে আরও জোরদার করতে চায়। একই সঙ্গে সীমান্তে ভারি অস্ত্র মোতায়েন এবং যুদ্ধবিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে বিপদের সঙ্কেত বহন করে।
সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিল ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা
উত্তেজনার চোটে ভারত যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো একতরফা সিন্ধু পানি চুক্তি ‘স্থগিত’ ঘোষণা। ১৯৬০ সালের এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতের পশ্চিম ঢল নদী (ইরাবতী, বিপাশা, শতদ্রু) এবং পাকিস্তানের সিন্ধু, ঝিলম, চেনাব নদীর পানি বণ্টন নির্ধারিত হয়েছে। ভারতের ঘোষণা অনুযায়ী, এই চুক্তি “অবিলম্বে স্থগিত থাকবে”, যতক্ষণ না পাকিস্তান সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কোনো পক্ষ একতরফাভাবে চুক্তি স্থগিত বা বাতিল করতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে, উভয় পক্ষের সম্মতি ছাড়া এই পদক্ষেপের বৈধতা নেই। ভারতের সিন্ধু চুক্তি স্থগিতকরণের ফলেঃ
- পাকিস্তানের কৃষি ও শিল্পখাতে পানি সরবরাহ হ্রাস পেতে পারে;
- সিন্ধু ও চেনাব নদীর পানিবণ্টন নিয়ে নতুন বিরোধের সৃষ্টি হতে পারে;
- আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে আইনি লড়াই তীব্র হবে।
পাকিস্তান এগুলোকে একতরফা, অন্যায় ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে আখ্যায়িত করেছে। ইসলামাবাদ জানিয়েছে, চুক্তির পানি প্রবাহে কোনো হস্তক্ষেপ হলে তাকে যুদ্ধের সমতূল্য বিবেচনা করা হবে এবং ভারতের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ শক্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া। পাশাপাশি পাকিস্তান সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি (উদাহরণস্বরূপ শিমলা চুক্তি) সাময়িক স্থগিত রাখার কথা জানিয়েছে, যদিও সরাসরি বাতিল করেনি। অন্যদিকে, ভারতীয় বিশ্লেষকরা দাবি করছেন, পাকিস্তানকে চাপে রাখতে এই কৌশলগত পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল।
এছাড়াও ভারত আটারী-বদরগড় সীমান্ত প্রবেশপথ বন্ধ এবং পাকিস্তানের উড়োজাহাজের জন্য আকাশসীমা বন্ধসহ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। ভারতীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তানের ভিসা বাতিল এবং নয়াদিল্লিতে তার কূটনীতিকদের সংখ্যা অর্ধেক কমানো হয়েছে। জবাবে পাকিস্তানও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে শিমলা চুক্তি স্থগিতসহ সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি পুনর্বিবেচনার হুমকি দিয়েছে, ভারতীয় বিমান চলাচলের জন্য আকাশপথ বন্ধ করেছে এবং সীমান্তে সেনা সমাবেশ বৃদ্ধি করেছে। এ সবই মূলত অতীতের সাধারণ যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে নেয়া পদক্ষেপ।
আমাদের কাছে আফগানিস্তানের কী পাওনা?
সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ও বাস্তবতা
২০১৯ সালের বালাকোট বিমান হামলার পর এবারই প্রথম ভারত-পাকিস্তান সরাসরি সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারী অস্ত্র মোতায়েন করেছে বলে স্যাটেলাইট চিত্রে প্রমাণ মিলেছে। পাকিস্তানও কাশ্মীর সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। বর্তমানে বড় আতঙ্ক হলো, কোনও পক্ষ যদি অনিচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এত উত্তেজনার পরিবেশে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ব্যাপক উদ্বেগের বিষয়। সীমিত বা আংশিক যুদ্ধের ধারণাই বিপজ্জনক। যদিও পাকিস্তান বলছে আগে পাকিস্তান হামলা করবেনা তবে যদি ভারত হামলা করে, তাহলে পাকিস্তান শক্ত প্রতিরোধ দেখাবে; যা “নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া” পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ভারতের প্রেসিডেন্ট মোদির দেয়া বার্তা (পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত পর্যন্ত তাড়া করার হুঁশিয়ারি) এ ধরনের সম্ভাব্য হামলার ইঙ্গিত বহন করে। এই পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষের সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি। বিক্ষিপ্ত সংঘাত আর বর্ধিত উত্তেজনা পারমাণবিক টানাপড়েনকে তীব্র করবে।
ভারত পাকিস্তানের এই বিরোধ নিরসনে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ২০১৯ সালের মতো এবারও তৎপরতা প্রয়োজন, নয়ত পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে তৎকালীন পরিস্থিতি অতীতের চেয়ে ভয়াবহ করে তুলতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যস্থতার প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু চূড়ান্ত সমাধানে এগুলি কতটা কার্যকর হবে তা অনিশ্চিত। তবে, বিরোধ নিরসনে সমস্যার মূলে যাওয়া জরুরী। যে কাশ্মীরকে নিয়ে এত বিবাদ সেই কাশ্মীর কি চায় সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করছে, এই সংকট সমাধানে স্থানীয় কাশ্মীরি নেতাদের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ফারুক আবদুল্লাহ বলেছেন, “কাশ্মীরের মানুষের কণ্ঠস্বরই এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধানের চাবিকাঠি”।
মুসকান খানের হিজাব ও ভারতের অসাম্প্রদায়িকতা
এছাড়া, দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি; এ ছাড়া ভুল বোঝাবুঝি এড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। সীমান্তে শান্তি আনতে এবং গুরুতর সংকট এড়াতে নিরন্তর যোগাযোগের চ্যানেল চালু রাখতে হবে, অন্যথায় সম্ভাব্য বিপর্যয় কল্পনাতীত মাত্রায় পৌঁছে যেতে পারে।
কাশ্মীর সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত এবং সীমান্ত ঘেঁষা গোলাগুলি—সবমিলিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এক রণক্ষেত্রের দিকেই এগোচ্ছে। যুগপৎ কূটনৈতিক চাপ এবং প্রতিক্রিয়া উত্তেজনাকে বেড়েছে। পরিণামে পারমাণবিক যুদ্ধ এড়াতে সমঝোতা ও বৈশ্বিক সহায়তার বিকল্প নেই। আমাদের দৃষ্টিতে এখনই উভয় দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় পরামর্শ ও মধ্যস্থতাকারী আলোচনা ফের শুরু করতে হবে, নয়ত ধ্বংসাত্মক সংঘাত যেকোনো সময় শুরু হতে পারে।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।