মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝোতার পর ১৪ বছর পর মুক্তি পেয়েছেন উইকিলিকস-এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। ১৪ বছর আগে মার্কিন সরকারের গোপন সামরিক তথ্য ও নথিপত্র প্রকাশ করে আলোচনায় আসেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। এই তথ্য ফাঁসের ফলে মার্কিন গোয়েন্দা কর্মী, কূটনীতিবিদ এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে ১৮টি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এরপর থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ান্টেড তালিকায় ছিলেন। এই নিবন্ধে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকসের বিতর্ক, গোপন তথ্য ফাঁস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লড়াই নিয়ে আলোচনা করব। চলুন শুরু করা যাক।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ কে?
ইন্টারনেট জগতের এক বিস্ফোরক নাম জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। তিনি এক সাথে সাংবাদিক, কম্পিউটার প্রোগ্রামার এবং বহুল আলোচিত ওয়েবসাইট উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা। গোপন তথ্য ফাঁস করে বিশ্বের চোখ খুলে দেওয়া এবং স্বচ্ছতা আনার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করলেও, তার কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের ঝড় উঠেছে।
জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ ১৯৭১ সালের ৩ জুলাই অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কাটে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে। কম্পিউটার প্রতি তার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই ছিল। তিনি হ্যাকিং কমিউনিটির সাথে জড়িয়ে পড়েন। এ সময়ে তিনি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের কৌশল আয়ত্ত করেন। পরবর্তীতে তিনি মেলবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত পড়াশুনা শুরু করেন, কিন্তু পরবর্তীতে তা অসমাপ্ত রেখে স্বাধীনভাবে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ও ক্রিপ্টোগ্রাফি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন।
পরবর্তীতে তিনি Underground Press নামের একটি অনলাইন প্রকাশনার সাথে যুক্ত হন। এখানে তিনি চীনা সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সাইবার অ্যাক্টিভিস্টদের কাহিনী প্রকাশ করেন। পরবর্তিতে অ্যাসাঞ্জ নিজেই সহযোগীদের সাহায্যে সরকারি ও কর্পোরেট গোপনীয় তথ্য ফাঁস করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠা করতে।
উইকিলিকস কি?
উইকিলিকস একটি আন্তর্জাতিক, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৫ সালে হ্যাকিংয়ের অপরাধে অস্ট্রেলিয়ায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া অ্যাসাঞ্জ ২০০৬ সালে উইকিলিকস ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করেন। এটি মূলত গোপনীয় সরকারি ও কর্পোরেট দলিল, গোয়েন্দা তথ্য, এবং বিভিন্ন বিষয়ের উপর ফাঁস হওয়া তথ্য প্রকাশ করে। এই তথ্যগুলো সাধারণত বার্তাধারকদের (whistle-blowers) কাছ থেকে বা ফাঁস (leak) এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। উইকিলিকস এই তথ্যগুলো তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে, যাতে সাধারণ মানুষ সরকার ও প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
উইকিলিকসের কাজ কি?
উইকিলিকসের মূল লক্ষ্য হলো ক্ষমতাসীনদের অস্বচ্ছ কর্মকাণ্ড প্রকাশ করা এবং সৎ ও নৈতিক শাসন ব্যবস্থার প্রচার করা। অ্যাসাঞ্জের মতে, তথ্য গোপন রাখার মাধ্যমে রাজনৈতিক এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। উইকিলিকস বিশ্বাস করে যে, গোপনিয়তা কখনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করার অজুহাত হতে পারে না। তাই, এই গোপনীয়তাকে ভাঙার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে উইকিলিকস। উইকিলিকসের কাজের মধ্যে রয়েছেঃ
গোপন তথ্য প্রকাশ করা– সরকারি গোয়েন্দা তথ্য, যুদ্ধের কৌশল, কূটনৈতিক চুক্তি ইত্যাদি গোপনীয় তথ্য উইকিলিকস প্রকাশ করে।
সাংবাদিকতার সহায়ক– মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরীক্ষা করতে এবং তদন্তমূলক প্রতিবেদন তৈরি করতে সহায়তা করে উইকিলিকস।
সরকারি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা– উইকিলিকসের তথ্য প্রকাশের ফলে সরকারগুলোকে তাদের কার্যকলাপের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহী করতে হয়।
উইকিলিকসের তথ্য ফাঁস
২০০৬ সালে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠার পর থেকে, অ্যাসাঞ্জ বিভিন্ন দেশের গোপন নথি ফাঁস করেছেন যা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সরকারের অপকর্ম ও অসদাচরণ উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০০৮ সালে কেনিয়া নির্বাচনে কারচুপির প্রমাণ, ২০১০ সালে আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের গোপন তথ্য এবং মার্কিন কূটনৈতিক চিঠিপত্র ফাঁস করে উইকিলিকস আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করে। উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলোঃ
রাশিয়া কেন ইউক্রেন আক্রমন করল?
ইরাক যুদ্ধের যুদ্ধের নথি (Iraq War Diary)
২০১০ সালে, উইকিলিকস ইরাক যুদ্ধের প্রায় ৪ লক্ষ গোপন সামরিক নথি প্রকাশ করে। এই নথিগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন কার্যকলাপের বিবরণ ছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলঃ
– অসংখ্য বেসামরিক মানুষের মৃত্যু।
– সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন।
– সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিবাদ এবং সমস্যাসমূহ।
উইকিলিকসের ফাঁস করা একটি ভিডিওতে মার্কিন সেনাদের কর্তৃক ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ১৮ জন বেসামরিক লোককে হত্যা করার দৃশ্য দেখা যায়। ভিডিওতে একটি কণ্ঠকে বলতে শোনা গেছে, ‘সবাইকে জালিয়ে দাও।’ সেই হামলায় রয়টার্সের একজন আলোকচিত্রী ও তার সহকারী মারা গিয়েছিলো।
ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কিত তথ্য ফাঁস করার পর তাতে দেখা গেছে ৬৬ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক হত্যা করা হয়েছে। ইরাকি সেনাদের দ্বারা বন্দিদের নির্যাতনের তথ্য এবং মার্কিন কূটনীতিকদের আদান প্রদান করা আড়াই লাখ বার্তা ফাঁস করা হয়েছিলো।
আফগানিস্তান যুদ্ধের নথি (Afghan War Diary)
২০১০ সালের জুলাই মাসে, উইকিলিকস প্রায় ৯২ হাজার আফগান যুদ্ধের নথি প্রকাশ করে। এই নথিগুলোতে ছিলঃ
– যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বিভিন্ন ঘটনা এবং বিবরণ।
– তালেবান ও অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর কার্যকলাপ এবং তাদের সাথে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ।
এসব নথিতে বলা হয়েছে যে আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনী কয়েকশ’ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে যা রিপোর্ট করা হয়নি।
ইউক্রেন রাশিয়া সংকটের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
মার্কিন কূটনৈতিক বার্তা ফাঁস (Cablegate)
২০১০ সালের নভেম্বরে, উইকিলিকস প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার মার্কিন কূটনৈতিক বার্তা প্রকাশ করে। এতে বিভিন্ন দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক, যুদ্ধ, গুপ্তচরবৃত্তি, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা ফাঁস হয়। এই ফাঁসের ফলেঃ
– বিভিন্ন দেশের রাজনীতির গোপন তথ্য প্রকাশিত হয়।
– কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
– মার্কিন সরকারের গোপন নীতিমালা উন্মোচিত হয়।
সিরিয়া ফাইলস (Syria Files)
২০১২-২০১৩ সালের মধ্যে, উইকিলিকস সিরিয়ার সরকার এবং বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২.৫ মিলিয়ন ইমেইল ফাঁস করে। এই ইমেইলগুলোতে ছিলঃ
– সিরিয়ার সরকারের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ।
– সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য।
– সিরিয়ার বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং তাদের গোপন কার্যকলাপ।
গুয়ান্তানামো বে কারাগারের নথি ফাঁস (Guantanamo Bay prison documents)
২০১১ সালে, উইকিলিকস গুয়ান্তানামো বে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটককৃত বন্দিদের বিচারবিহীন আটক সংক্রান্ত নথি প্রকাশ করে। এই নথিগুলোতে বিভিন্ন নির্যাতন, আটক প্রক্রিয়া এবং বিচারবহির্ভূত বন্দি রাখার প্রমাণ ছিল। এই নথিগুলোতে ছিলঃ
– বন্দিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং বিচার প্রক্রিয়া।
– বিভিন্ন বন্দির নির্যাতনের বিবরণ।
– বিচারবিহীন আটক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ।
CIA-এর গোপন হ্যাকিং প্রোগ্রামের ফাঁস (CIA’s Secret Hacking Program)
২০১৭ সালে, উইকিলিকস ভল্ট ৭ নামে পরিচিত সিআইএর গোপন হ্যাকিং টুলস ও কৌশলের নথি ফাঁস করে। এই নথিগুলোতে ছিলঃ
– সিআইএর বিভিন্ন হ্যাকিং টুলস এবং ম্যালওয়ারের বিবরণ।
– বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস হ্যাক করার পদ্ধতি।
– সাইবার যুদ্ধের কৌশল এবং পরিকল্পনা।
প্যানামা পেপারস (Panama Papers)
এই ফাঁসে ১১.৫ মিলিয়নেরও বেশি দলিল প্রকাশ করা হয় যাতে ধনী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর এড়ানোর জন্য কিভাবে অফশোর ট্যাক্স হ্যাভেন ব্যবহার করে তা উন্মোচিত হয়।
ডিএনসি ফাইল ফাঁস (DNC file)
২০১৬ সালে এই ফাঁসে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির (ডিএনসি) ইমেল প্রকাশ করা হয়েছিল যা মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের প্রমাণ দিয়েছিল।এই ইমেইলগুলোতে ছিলঃ
– হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনের গোপন তথ্য।
– বার্নি স্যান্ডার্সের বিপক্ষে প্রচারণার বিভিন্ন কৌশল।
– ডেমোক্রেটিক পার্টির অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এবং পরিকল্পনা।
মুসকান খানের হিজাব ও ভারতের অসাম্প্রদায়িকতা
এসব নথি থেকে জানা যায় ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে মনোনয়নের আগে দলের মধ্যে হিলারি ক্লিনটনের প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডার্স সম্পর্কে কটূক্তি করা হয়েছিলো। এমনকি নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের মধ্যে যে বিতর্ক টেলিভিশনে প্রচার করা হয় তাতে সিএনএনের সাংবাদিক হিলারি ক্লিনটনকে একটি প্রশ্ন সম্পর্কে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন।
স্ট্র্যাটফোর ইমেইল ফাঁস (Stratfor Email)
২০১২ সালে, উইকিলিকস স্ট্র্যাটফোর (Stratfor) নামে একটি প্রাইভেট ইন্টেলিজেন্স ফার্মের ইমেইল ফাঁস করে। এই ইমেইলগুলোতে ছিলঃ
– বিভিন্ন গোপন তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি এবং কৌশল।
– বিভিন্ন কর্পোরেট ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে গোপন তথ্য।
– বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ের উপর গোপন প্রতিবেদন।
ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ নথি ফাঁস (Trans Pacific Partnership)
২০১৩ এবং ২০১৫ সালে, উইকিলিকস ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (TPP) চুক্তির গোপন নথি প্রকাশ করে। এই নথিগুলোতে ছিলঃ
– আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাবিত বিভিন্ন ধারা।
– কর্পোরেট সংস্থাগুলোর জন্য প্রস্তাবিত বিশেষ সুবিধা।
– সাধারণ মানুষের অধিকার এবং স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার প্রমাণ।
এছাড়াও ২০১৫ সালে মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সনি পিকচারস-এর প্রায় দুই লাখ ইমেইল ও কুড়ি হাজার নথি ফাঁস করা হয়েছিলো। এসব ইমেইলে জানা যায় এনজেলিনা জোলি সহ বিখ্যাত তারকাদের সম্পর্কে কোম্পানিটির প্রোডিউসার নানা রকম কটূক্তিমূলক কথাবার্তা বলেছিলেন। একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে রাজি না হওয়ায় হলিউড তারকা লিওনার্ডো ডি ক্যাপ্রিওকে গালি দেয়া এবং আমেরিকান হাসল চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য অভিনেত্রী জেনিফার লরেন্স ও এমি অ্যাডামসকে পুরুষ অভিনেতাদের তুলনায় কত কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়েছে সেসব উঠে আসে এসব ফাঁস হওয়া মেইলে।
মার্কিন সরকারের প্রতিক্রিয়া
মার্কিন বিচার বিভাগ উইকিলিকসের নথি ফাঁসকে “তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আপসগুলির মধ্যে একটি” হিসেবে বর্ণনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবীরা বলেন, এসব তথ্য প্রকাশের ফলে আফগানিস্তান ও ইরাকের অনেক নামী ব্যক্তির মারাত্মক ক্ষতি, নির্যাতন বা মৃত্যুর ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। উইকিলিকসের কার্যকলাপ জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এছাড়া এসব গোপন তথ্য ফাঁস করে উইকিলিকস মার্কিন সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে। উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসের ঘটনাগুলো মার্কিন সরকারের কাছে ব্যাপক বিব্রতকর এবং ক্ষতিকর ছিল। ফলে মার্কিন সরকার উইকিলিকসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
উইকিলিকসের ওয়েবসাইট বন্ধ করার চেষ্টা– মার্কিন সরকার উইকিলিকসের ওয়েবসাইট বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে চাপ প্রয়োগ করেছে।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা– উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে মামলা করে। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য আন্তর্জাতিক ওয়ারেন্টও জারি করা হয়।
চেলসি ম্যানিং-এর বিরুদ্ধে শাস্তি– মার্কিন সেনাবাহিনীর সৈনিক চেলসি ম্যানিং, যিনি উইকিলিকসের কাছে গোপন নথি ফাঁস করেছিলেন, তাকে দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
গোপনীয়তা নীতি কড়াকড়ি– উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসের ঘটনাগুলো মার্কিন সরকারকে তাদের গোপনীয়তা নীতি আরও কড়াকড়ি করতে বাধ্য করেছে।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা
২০১০ সালে অ্যাসাঞ্জকে ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির অভিযোগে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত করে এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তিনি অবশ্য বলেন, এসব অভিযোগ “ভিত্তিহীন”। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত তাকে সুইডেনের কাছে হস্তান্তর করার পক্ষে রায় দেয়। তবে, অ্যাসাঞ্জ একুয়েডর দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় চান এবং ইকুয়েডোর দূতাবাসে সাত বছর থাকার পর, ২০১৯ সালে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
মার্কিন বিচার বিভাগ ২০১৯ সালে অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকসের নথি ফাঁসের ঘটনাকে তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আপসগুলির মধ্যে একটি হিসেবে অভিহিত করে। মার্কিন কর্তৃপক্ষের আইনজীবীরা এসব তথ্য প্রকাশের ফলে আফগানিস্তান ও ইরাকের অনেক নামী ব্যক্তিকে “মারাত্মক ক্ষতি, নির্যাতন বা এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিতে” ফেলার দাবি করলেও অ্যাসাঞ্জ বলেছিলেন এসব নথি মার্কিন সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক গুরুতর অন্যায়ের তথ্য প্রকাশ করেছে এবং তার বিরুদ্ধে করা মামলা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর ডেটাবেজে প্রবেশ করার ষড়যন্ত্র করাসহ ১৮টি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া শুরু করলে তার আইনজীবীরা দাবি করেন দোষী সাব্যস্ত হলে ১৭৫ বছর পর্যন্ত অ্যাসাঞ্জের কারাদণ্ড হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেটা নাকচ করে দিয়ে বলেছে ৪-৬ বছরের সাজা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বহু আদালতের শুনানির পর ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যর্পণের অনুরোধটি মঞ্জুর করলে অ্যাসাঞ্জ সেই সিদ্ধান্ত উল্টে দেওয়ার জন্য কয়েক বছর ধরে লড়াই করেছেন। তারপর তাকে সুইডেনে প্রত্যর্পণের উদ্দেশ্যে আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং তাকে ৫০ সপ্তাহের কারাদণ্ড দিয়ে ২০১৯ সালে লন্ডনের উচ্চ নিরাপত্তা সম্পন্ন বেলমার্শ কারাগারে পাঠানো হয়। মানসিক স্বাস্হ্যের অবনতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন, এমন দাবি খারিজ করে দিয়ে ২০২১ সালে ব্রিটেনের হাইকোর্ট রায় দেয় যে তাকে প্রত্যর্পণ করা উচিত।
সমঝোতার মাধ্যমে মুক্তি
২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট সেই সিদ্ধান্ত বহাল রাখে এবং ব্রিটেনের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল প্রত্যর্পণের আদেশটি নিশ্চিত করেন। অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা প্রত্যর্পণটি আটকে দেয়া উচিত বলে রায় দেয়ার জন্য ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস বা মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় আদালতে আবেদন করেন।
কিন্তু ব্রিটেনের মধ্যস্থতায় এমন একটি সমঝোতা হয় যে, অ্যাসাঞ্জকে আর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কারাভোগ করতে হবে না। বরং তিনি মার্কিন একটি আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে নেবেন এবং বিনিময়ে এতেদিন ধরে কারাগারে থাকার বিষয়টি তার শাস্তি হিসাবে গণ্য হবে এবং তিনি মুক্ত ব্যক্তি হিসাবে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যেতে পারবেন।
শেষ পর্যন্ত কূটনীতি, রাজনীতি ও আইনের যৌথ প্রচেষ্টায় ইকুয়েডর দূতাবাসে সাত বছরের স্বেচ্ছা বন্দী এবং পাঁচ বছর আটক থাকতে বাধ্য থাকার পর অ্যাসাঞ্জ প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে নর্দান মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের একটি আদালতে হাজির হয়ে দোষ স্বীকার করার পর তাকে মুক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর অ্যাসাঞ্জ অস্ট্রেলিয়া যেতে গত সোমবার যুক্তরাজ্যে লন্ডনের একটি বিমানবন্দরে গিয়ে প্রাইভেট বিমানে ওঠেন।
উইকিলিকসের ভবিষ্যৎ
উইকিলিকস এবং জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ফাঁস করা এই নথিগুলো বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সরকারের গোপন কার্যকলাপ উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উইকিলিকস এবং অ্যাসাঞ্জের কর্মকাণ্ড তথ্যের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকতার নতুন যুগের সূচনা করেছে। তবে, অ্যাসাঞ্জের আইনি সমস্যা এবং উইকিলিকসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের আইনগত পদক্ষেপের ফলে এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তা সত্ত্বেও, তথ্যের স্বাধীনতা এবং ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতার লড়াইয়ে উইকিলিকস একটি একটি উল্লেখযোগ্য নাম।
Pingback: এইপ্যাক (AIPAC) কি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইসরায়েলের প্রভাব | MaroonPaper