জাতীয়তাবাদ হলো একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের লোকদের আনুগত্য, পরিচয় এবং স্বার্থের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক মতাদর্শ বা প্রবণতা যাদের মধ্যে একটি সাধারণ সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভাষা বা ধর্ম বিরাজমান। রাষ্ট্র, সমাজ এবং সংস্কৃতির গঠন, বিলুপ্তি এবং রূপান্তরের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্ব গঠনে জাতীয়তাবাদ একটি শক্তিশালী শক্তি হয়ে উঠেছে। এই নিবন্ধে আমরা জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা, বিভিন্ন অঞ্চল এবং সময়কালে জাতীয়তাবাদের উৎস, বিকাশ, এবং সমসাময়িক বিশ্বে জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন ধরণ আলোচনা করব।

জাতীয়তাবাদ কি?

জাতীয়তাবাদ একটি জটিল এবং বিতর্কিত ধারণা এবং অনেক পণ্ডিত এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে অনেকে সফল হয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়ে বিস্তর বিতর্কও হয়েছে। জাতীয়তাবাদের আলোচনায় আমরা যদি ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি দিয়েই শুরু করি তবে এর শিকড় রয়েছে ল্যাটিন শব্দ ‘ন্যাটিও’তে (Natio), যার অর্থ “জন্ম, সম্প্রদায় বা জাতি”। এই ‘ন্যাটিও’ শব্দটি রোমানরা বিদেশি কোন জনগোষ্ঠীকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করত।

সাধারণভাবে, যারা নিজেদের একটি জাতি হিসাবে বিবেচনা করে এমন একদল লোকের মধ্যে প্রচলিত অভিন্ন পরিচয়, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং আঞ্চলিকতার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা  রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসাবে জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। তাছাড়া, একটি জাতির প্রতি সাধারণ মানুষদের আনুগত্য এবং আন্তরিক অনুভূতিকেও জাতীয়তাবাদ বলা যেতে পারে। জাতীয়তাবাদ হলো একটি জাতি ও তার মাতৃভূমির আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্জন এবং রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট জাতির নিঃস্বার্থ আদর্শ ও আন্দোলন।

জাতীয়তাবাদ,মেরুনপেপার
কপিরাইটঃ মেরুনপেপার

হান্স কোনের মতে, “জাতীয়তাবাদ একটি ধারণা এবং ধারণা-শক্তি যা মানুষের মস্তিষ্ক এবং হৃদয়কে নতুন চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিতে পরিপূর্ণ করে এবং তার চেতনাকে সংগঠিত কাজে পরিচালিত করে। ড. গার্নারের মতে, “আধুনিক জাতীয়তাবাদের এটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে বেশিরভাগ মানুষ যারা একটি জাতীয়তা গঠন করে তারা হয় স্বাধীনতা চায় এবং তাদের নিজের সৃষ্ট এবং পছন্দসই রাষ্ট্রীয় সংগঠনের অধীনে অধীনে থাকতে চায় অথবা কমপক্ষে একটি বৃহৎ স্বায়ত্তশাসন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব চায় যেখানে তারা একই রাষ্ট্রে অন্য জাতীয়তার সাথে সহাবস্থান চায়”।

জাতীয়তাবাদীদের প্রেক্ষাপট এবং লক্ষ্যের উপর নির্ভর করে জাতীয়তাবাদের ভিন্ন ভিন্ন রূপ এবং প্রকাশভঙ্গি থাকতে পারে। কিছু জাতীয়তাবাদী একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা রক্ষা করতে চায়, অন্যরা তাদের জাতিকে অন্তর্ভুক্ত করে আরেকটি বৃহত্তর রাষ্ট্রের সাথে যোগ দিতে বা থাকতে চায়। কিছু জাতীয়তাবাদী তাদের জাতির সাংস্কৃতিক বা জাতিগত দিকগুলিতে গুরুত্বারোপ করে, আবার অন্যরা নাগরিক বা রাজনৈতিক দিকগুলির উপর জোর দেয়। কিছু জাতীয়তাবাদী অন্য জাতির প্রতি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সহনশীল হয়, আবার অন্যরা একচেটিয়া এবং অসহনশীল হয়।

ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ইমাম খোমেনীর ভূমিকা

পরিস্থিতি এবং জাতীয়তাবাদীদের কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন প্রভাব এবং পরিণতিও থাকতে পারে। জাতীয়তাবাদ যেমন একটি জাতির মধ্যে গর্ব এবং সংহতির উৎস হতে পারে, একইসাথে সামাজিক পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য একটি চালিকা শক্তিও হতে পারে। জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে সংঘাত এবং সহিংসতার কারণ হতে পারে, পাশাপাশি মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকিও হতে পারে। জাতীয়তাবাদ ইতিহাস, ভৌগলিকতা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং মিডিয়ার মতো বিভিন্ন কারণ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।

জাতীয়তাবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন সামন্ততান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে , শিল্পায়ন, পুঁজিবাদ এবং গণতন্ত্রের উত্থান ঘটছিল তখনই জাতীয়তাবাদের উৎপত্তির খোঁজ পাওয়া যায়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম উদাহরণগুলির মধ্যে ছিল ফরাসি বিপ্লব এবং আমেরিকান বিপ্লব। এসব বিপ্লব পুরানো শাসনকে উৎখাত করে স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের নীতির ভিত্তিতে নতুন ব্যবস্থার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সংঘটিত হয়েছিল। নেপোলিয়নের যুদ্ধগুলিও সংঘটিত হয়েছিল ইউরোপ এবং এর বাইরে জাতীয়তাবাদের ধারণা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে।

বিংশ শতাব্দীতে, জাতীয়তাবাদ বিশ্ব ইতিহাস গঠনে একটি প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মূলত পরাশক্তিগুলির মধ্যে জাতীয়তাবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধের পরে আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার প্রাক্তন উপনিবেশ এবং সাম্রাজ্য, যারা বিদেশী আধিপত্য এবং শোষণের শিকার হয়েছি্ল, তাদের স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করার জন্য তাদের থেকে নতুন জাতির উত্থান দেখা যায় এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান ঘটে। জাতীয়তাবাদের এই ধারণা জার্মানি এবং ইতালির জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিল। একসময় যারা অনেক ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল, উনিশ শতকে এসে তারা একক জাতীয় পরিচয়ের অধীনে একত্রিত হতে শুরু করে। স্নায়ুযুদ্ধও গোটা বিশ্বকে প্রভাবশালী এবং আধিপত্যবাদী দুটি আদর্শিক ভাগে বিভক্ত করেছিল।

মরক্কোর জাতীয়তাবাদি আন্দোলন ও সুলতান মুহাম্মাদ

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও জাতীয়তাবাদ বিশ্ব রাজনীতিতে একটি প্রাসঙ্গিক এবং বিতর্কিত ইস্যু হিসাবে চলমান রয়েছে। জাতীয় পরিচয় এবং সার্বভৌমত্বের ঐতিহ্যবাহী ধারণাগুলিকে বিশ্বায়ন, অভিবাসন এবং বহুসংস্কৃতিবাদের ব্যবস্থাগুলি চ্যালেঞ্জ করছে। বিভিন্ন দেশে পপুলিস্ট এবং জাতীয়তাবাদী দলগুলোর উত্থান বৈশ্বিক স্থিতাবস্থায় অসন্তুষ্টির সাথে আরও বেশি মাত্রায় কতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। ব্রেক্সিট, কাতালান স্বাধীনতার গণভোট এবং উইঘুর সংকটের মতো সাম্প্রতিক ঘটনাগুলিও দেখিয়েছে যে জাতীয়তাবাদ কীভাবে বিশ্বের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে।

জাতীয়তাবাদের কারণ

জাতীয়তাবাদ হলো একটি গোষ্ঠীর মধ্যে অভিন্ন পরিচয়, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ। জাতীয়তাবাদকে একটি জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা, ভাষা, ধর্ম বা জাতিয়তার ভিত্তিতে স্বকীয়তা এবং আনুগত্যমূলক চেতনা তৈরির উপায় হিসাবে দেখা যেতে পারে। এছাড়া বিদেশী আধিপত্য বা নিপীড়নের বিরুদ্ধে গর্ব, সংহতি এবং প্রতিরোধের উৎস হিসেবেও জাতীয়তাবাদকে দেখা যেতে পারে। তবে, জাতীয়তাবাদের পরিণতি নেতিবাচকও হতে পারে, যেমন অসহিষ্ণুতা, বৈষম্য এবং যাদেরকে ভিন্ন বা নিচুস্তরের হিসাবে দেখা হয় তাদের প্রতি সহিংসতা। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধের পাশাপাশি একটি জাতির মধ্যে সংখ্যালঘু অধিকার এবং স্বার্থকে দমন করতেও জাতীয়তাবাদকে অপব্যবহার করা হয় অনেক সময়ই। কর্তৃত্ববাদী নেতারা তাদের ক্ষমতা এবং নীতিগুলিকে অন্যায়ভাবে ন্যায্য প্রমাণ করার জন্য জাতীয়তাবাদকে অপব্যবহার করে। যাইহোক, পরিবেশ পরিস্থিতি এবং অন্যান্য প্রভাবকের উপর নির্ভর করে জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন কারণ হতে পারে।  জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য দায়ী এবং প্রভাবক এমন কয়েকটি কারণ হলোঃ

রাজনৈতিক কারণ

বিদেশী শক্তি বা অভ্যন্তরীণ অভিজাত শ্রেণীর নিপীড়ন, আধিপত্য, উপনিবেশ বা শোষণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের  উত্থান হতে পারে। আরও শক্তিশালী কর্তৃত্ব থেকে তারা তাদের স্বায়ত্তশাসন, সার্বভৌমত্ব, আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা দাবি করতে পারে। একটি জাতির বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে একটি জাতীয় পরিচয়, ঐক্য বা সংহতি তৈরি বা সংরক্ষণের লক্ষ্যেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হতে পারে।

সাম্রাজ্যবাদ কি? মধ্যপ্রাচ্যে জার্মান সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃতি ও ইউরোপের অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিক্রিয়া

অর্থনৈতিক কারণ

দারিদ্র্য, অসমতা, বেকারত্ব, অনুন্নয়ন বা সুযোগের অভাবের মতো দগদগে অর্থনৈতিক ঘা থেকেও জন্মাতে পারে। শিল্পায়ন, আধুনিকীকরণ, উন্নয়ন অথবা আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক বাজারের সাথে একীকরণের মতো অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশ্যেও জাতীয়তাবাদি আন্দোলন সংঘটিত হতে পারে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বৈদেশিক প্রতিযোগিতা বা শোষণ থেকে জাতীয় স্বার্থ, সম্পদ বা শিল্পকে রক্ষা বা উন্নয়ন সাধন করার চেষ্টা করতে পারে।

সামাজিক কারণ

নগরায়ন, অভিবাসন, বিশ্বায়ন বা গণতন্ত্রীকরণের মতো সামাজিক পরিবর্তন দ্বারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রভাবিত হতে পারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কল্যাণ বা মানবাধিকারের মতো সামাজিক আকাঙ্ক্ষাগুলিও প্রতিফলিত হতে পারে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গর্ব, সম্মান, মর্যাদা বা অসন্তোষের মতো সামাজিক অনুভূতিকেও টানতে পারে।

সাংস্কৃতিক কারণ

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, বিশ্বাস বা প্রতীক দ্বারাও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন অনুপ্রাণিত হতে পারে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বৈচিত্র্য বা পরিচয় সংরক্ষণ বা পুনরুজ্জীবিত করার তাগিদেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ঘটতে পারে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সাংস্কৃতিক আগ্রসন, সংমিশ্রণ, বা একীভূতকরণকে প্রতিরোধ করতে পারে।

জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন ধরণ

বিভিন্ন মানদণ্ড এবং বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন রূপ হতে পারে। জাতীয়তাবাদের সাধারণ কয়েকটি ধরণ হলোঃ

নাগরিক জাতীয়তাবাদ (Civic nationalism)

নাগরিকত্ব, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের নীতির উপর ভিত্তি করে এই ধরনের জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। এখানে জাতিগত, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় পার্থক্য নির্বিশেষে একটি গোষ্ঠী বা অঞ্চলকে একত্রিত করতে রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং প্রতিষ্ঠানগুলির উপর জোর দেয়া হয়। নাগরিক জাতীয়তাবাদ সাধারণত অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহনশীল এবং বহুত্ববাদী। নাগরিক জাতীয়তাবাদের একটি উদাহরণ হলো আমেরিকান জাতীয়তাবাদ, যা স্বাধীনতা, সাম্য এবং গণতন্ত্রের আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং সংবিধান এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

জাতিগত জাতীয়তাবাদ (Ethnic nationalism)

এই ধরণের জাতীয়তাবাদ বংশ, সম্প্রদায় এবং রক্তের ধারার মত মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। জৈবিক বন্ধন এবং জিনগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে জাতিগত জাতীয়তাবাদ একটি গোষ্ঠী বা অঞ্চলকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। জাতিগত জাতীয়তাবাদ সাধারণত একচেটিয়া, অসহিষ্ণু এবং সমজাতীক। জাতিগত জাতীয়তাবাদের একটি উদাহরণ নাৎসি জার্মানির জাতীয়তাবাদ। জার্মানির জাতীয়তাবাদ জাতিগত বিশুদ্ধতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। এই ধারণার ভিত্তিতেই নাৎসিবাদ ইহুদি এবং অন্যান্য অ-আর্য গোষ্ঠীর নিপীড়ন এবং নির্মূলকে ন্যায্যতা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। জাতিগত জাতীয়তাবাদের আরেকটি উদাহরণ হতে পারে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। যখন দেশের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ হিসেবে ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’কেই স্বীকৃতি দেয়া হয় তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে অন্যান্য জাতিগত পরিচয়গুলোকে অস্বীকার করা হয় যা একই সংবিধানপরিপন্থী। এই ধরণের ভিন্ন সংস্কৃতিকে বাতিল করার চর্চা এক ধরণের উগ্রতা, এবং বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রীতি বিরোধী।  

সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ (Cultural nationalism)

এই ধরনের জাতীয়তাবাদ সংস্কৃতি, ভাষা এবং অন্যান্য উপাদানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ঐতিহ্যবাহী প্রথা এবং সাংস্কৃতিক চর্চার ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ একটি গোষ্ঠী বা অঞ্চলের পরিচয় এবং জীবনযাত্রাকে সংজ্ঞায়িত করে। অন্যান্য সংস্কৃতিকে সম্মান করে নাকি প্রত্যাখ্যান করে তার উপর নির্ভর করে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তিমূলক বা একচেটিয়ামূলক হতে পারে। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের একটি উদাহরণ হলো- গেলিক সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্মের পুনরুজ্জীবন এবং প্রচারের উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ এবং ইংরেজিকরণের বিরোধিতাকারী আইরিশ জাতীয়তাবাদ।

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ (Religious nationalism)

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ এমন একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ যা একটি গোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয়কে তার জাতীয় পরিচয়ের সাথে একত্রিত করে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হলো তাদের জাতির ধর্ম, এবং বিশ্বে তাদের জাতির একটি বিশেষ মিশন বা দায়িত্ব রয়েছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কয়েকটি উদাহরণ হলো ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ, দখলকৃত ফিলিস্তিনে ইহুদি জাতীয়তাবাদ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদ। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যেমন সামাজিক সংহতি, সাংস্কৃতিক গর্ব এবং নৈতিক মূল্যবোধের উৎস, একই সাথে এটি ভিন্নধর্মীদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা এবং চরমপন্থারও উৎস।

Secular India and the Nature of its so-called Secularism

ইরিডেন্টিস্ট জাতীয়তাবাদ (Irredentist nationalism)

ইরিডেন্টিস্ট জাতীয়তাবাদ হলো এমন একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ যা একটি জাতির হারিয়ে যাওয়া অঞ্চল পুনরুদ্ধার বা পার্শ্ববর্তী যেসব অঞ্চলে একটি সাধারণ জাতিগত, সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক পরিচয় বিদ্যমান সেসব অঞ্চলকে একীভূতকরণের কথা বলে। ইরিডেন্টিস্ট জাতীয়তাবাদীরা প্রায়শই দাবি করে যে, অন্যায়ভাবে বিদেশী শক্তি দ্বারা তাদের সীমানা হ্রাস বা লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং পৈতৃক জমি পুনরুদ্ধার করার নৈতিক অধিকার বা কর্তব্য তাদের রয়েছে। ইরেডেন্টিস্ট জাতীয়তাবাদ সংঘাত এবং সহিংসতার উৎস হতে পারে, কারণ এই জাতীয়তাবাদ অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকিস্বরূপ, বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এবং বহুজাতিক রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উস্কে দিতে পারে। ইরিডেন্টিস্ট জাতীয়তাবাদকে সংশোধনবাদের একটি রূপ হিসাবেও দেখা যেতে পারে, কারণ এটি ইতিহাস পুনরায় লিখতে বা বিদ্যমান সীমানা অস্বীকার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তাইওয়ানের উপর চীন, কাশ্মীর নিয়ে ভারত এবং কসোভোর উপর সার্বিয়ার দাবির পিছনে ইরেডেন্টিস্ট জাতীয়তাবাদ কাজ করছে।

জাতীয়তাবাদের প্রভাব

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রকৃতি এবং ফলাফলের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের প্রভাব ইতিবাচক বা নেতিবাচক হতে পারে। কিছু সম্ভাব্য প্রভাব হলোঃ

ইতিবাচক প্রভাব

জাতীয়তাবাদ একটি জাতির মধ্যে জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা, ভাষা, ধর্ম বা জাতীয়তার ভিত্তিতে স্বকীয়তা, আনুগত্য এবং দেশপ্রেমের চেতনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সম্মিলিত পদক্ষেপ, সংহতি এবং অংশগ্রহণকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। জাতি গঠন, রাষ্ট্র গঠন এবং গণতান্ত্রিক অবকাঠামো সুদৃঢ়করণেও জাতীয়তাবাদ অবদান রাখতে পারে। জাতীয়তাবাদ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনকেও উৎসাহিত করতে পারে। এছাড়া বিদেশী আধিপত্য বা নিপীড়নের বিরুদ্ধে গর্ব, সংহতি এবং প্রতিরোধের উৎস হিসেবেও জাতীয়তাবাদকে দেখা যেতে পারে।

নেতিবাচক প্রভাব

জাতীয়তাবাদ অন্যান্য গোষ্ঠী বা জাতি যাদেরকে ভিন্ন বা নিচুস্তরের হিসাবে দেখা হয় তাদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা, বৈষম্য এবং সহিংসতা উস্কে দিতে পারে। সংঘাত, যুদ্ধ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকেও উস্কে দিতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধের পাশাপাশি একটি জাতির মধ্যে সংখ্যালঘু অধিকার এবং স্বার্থকে দমন করতেও জাতীয়তাবাদকে অপব্যবহার করা হয় অনেক সময়ই। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সংহতিকেও জাতীয়তাবাদ দুর্বল করতে পারে।  জাতীয়তাবাদ সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা, স্থবিরতা এবং অবক্ষয়ের কারণও হতে পারে। যেমন অসহিষ্ণুতা, বৈষম্য এবং তাদের প্রতি সহিংসতা। কর্তৃত্ববাদী নেতারা তাদের অন্যায্য ক্ষমতা এবং নীতিগুলিকে ন্যায্য প্রমাণ করার জন্য জাতীয়তাবাদকে অপব্যবহার করে।

Communal Violence in Haryana of India: What Happening in India?

আলোচনা শেষে আমরা বলতেই পারি, জাতীয়তাবাদ একটি জটিল বিষয়। বিভিন্ন উপায়ে জাতীয়তাবাদ আধুনিক বিশ্বকে নানান রূপ দিয়েছে। অনুপ্রেরণা, মুক্তি, সহযোগিতা, বৈচিত্র্যের পাশাপাশি নিপীড়ন, সংঘাত, বিচ্ছিন্নতা এবং সহিংসতারও উৎস এই জাতীয়তাবাদ। এটি কোন স্থিতিশীল বা একচেটিয়া ধারণা নয়, এটি একটি প্রগতিশীল এবং বৈচিত্র্যময় ধারণা। প্রেক্ষাপট এবং পরিস্থিতি অনুসারে জাতীয়তাবাদ নতুন নতুন রূপে পরিবর্তিত হয়।  

আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক রাজনীতি রাকিবুল ইসলামের বিশেষ আগ্রহের বিষয়। তাঁর লেখালেখির মূল বিষয়বস্তু হলো রাজনীতি, সরকার, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।

Leave A Comment

সম্পর্কিত আর্টিকেল

কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন

লেখক হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দিন

সাম্প্রতিক আর্টিকেল

  • শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?

পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

  • আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?

আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

  • ইক্যুইটির ম্যাক্সিম

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?

ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা

  • আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা

আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।

  • পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয়

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!

পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।