মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী বিদেশি শক্তিগুলোর মধ্যে এইপ্যাক (AIPAC বা আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি) অন্যতম শক্তিশালী। ইসরায়েলের স্বার্থে কাজ করা এই লবিং গ্রুপটি মার্কিন কংগ্রেস থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই প্রভাব রেখে আসছে। এইপ্যাকের কার্যকলাপ এবং মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কীভাবে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে।
এইপ্যাক কি?
আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি, বা সংক্ষেপে এইপ্যাক (AIPAC), যুক্তরাষ্ট্রের একটি অন্যতম প্রভাবশালী লবিং সংগঠন, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে শক্তিশালী এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এইপ্যাক একটি ‘অলাভজনক’ এবং ‘অ-পার্টিজান’ প্রতিষ্ঠান, তবে এটি কার্যত ইসরায়েলি স্বার্থকে রক্ষা ও সমর্থন দেওয়ার জন্য মার্কিন রাজনৈতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে আসছে। এইপ্যাকের প্রভাবের প্রসার এতটাই সুদূরপ্রসারী যে এর কার্যক্রম কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতিতেও এর প্রভাব রয়েছে।
এইপ্যাকের প্রধান লক্ষ্য ও কৌশল
এইপ্যাকের মূল উদ্দেশ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালায় ইসরায়েলের স্বার্থকে সমর্থন ও অগ্রাধিকার দেওয়া। এই সংগঠনটি কংগ্রেস এবং হোয়াইট হাউসের নীতিনির্ধারকদের কাছে ইসরায়েলের পক্ষের তথ্য ও মতামত উপস্থাপন করে এবং বিভিন্ন প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে ইসরায়েলকে সমর্থন জানাতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে।
এইপ্যাক (AIPAC) প্রতিনিয়ত কংগ্রেসের সদস্যদের কাছে ইসরায়েল-পক্ষীয় তথ্য সরবরাহ করে, সেই সাথে তাদের নীতি ও কর্মসূচিতে এমন প্রভাব ফেলতে চেষ্টা করে যা ইসরায়েলি স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে এইপ্যাক মার্কিন রাজনীতিতে ইসরায়েলের পক্ষে জনমত তৈরিতে ভূমিকা পালন করে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কৌশল হলো:
- লবিং ও আর্থিক সহায়তা: প্রতি বছর এইপ্যাক কংগ্রেস সদস্যদের সমর্থন লাভের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এবং তাদের নির্বাচন প্রচারণায় আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এই সহায়তার মাধ্যমে তারা কংগ্রেস সদস্যদের ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে।
- ইভেন্ট ও সেমিনারের আয়োজন: কংগ্রেসের সদস্য ও তাদের সহকারীদের জন্য নানা ধরণের ইভেন্ট, কনফারেন্স এবং সেমিনার আয়োজন করে এইপ্যাক। এ সকল ইভেন্টে মার্কিন রাজনীতিবিদরা ইসরায়েল সম্পর্কে এমন তথ্য ও ধারণা পান, যা তাদের ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিতে সহায়ক হয়।
- বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞদের সংযুক্ত করা: মার্কিন সংবাদমাধ্যম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এইপ্যাক ইসরায়েল-পক্ষীয় বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের যুক্ত করে। এদের মাধ্যমে মার্কিন সমাজে ইসরায়েল সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে এবং সমালোচনা মোকাবিলায় জনমত তৈরির কাজ করা হয়।
যদিও মার্কিন কংগ্রেসে অন্যান্য লবিং সংস্থাও সক্রিয় রয়েছে, তবে এইপ্যাকের শক্তি ও প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে এটি মার্কিন নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এইপ্যাক প্রতি বছর কংগ্রেস সদস্যদের সমর্থন লাভের জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে থাকে, যা ইসরায়েলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
এইপ্যাক কীভাবে কংগ্রেসে প্রভাব বিস্তার করে?
এইপ্যাক (AIPAC) মূলত কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন ও বজায় রাখার জন্য একাধিক কৌশল অবলম্বন করে। তারা কংগ্রেস সদস্যদের বিভিন্ন ইভেন্টে আমন্ত্রণ জানায়, তাদের জন্য ভ্রমণ সুবিধার ব্যবস্থা করে, এবং এমনকি নির্বাচনী প্রচারণায় আর্থিক সহায়তাও প্রদান করে থাকে। এই কৌশলগুলো কংগ্রেস সদস্যদের উপর একটি নির্দিষ্ট মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এবং ইসরায়েল বিরোধী মত প্রকাশে তারা প্রায়ই ভীত হন।
এইপ্যাক প্রায়ই “ফ্রেন্ডস অব ইসরায়েল” শীর্ষক প্রোগ্রাম আয়োজন করে থাকে যেখানে কংগ্রেস সদস্যরা ইসরায়েল পরিদর্শনের সুযোগ পান। এই ধরনের ইভেন্টে তারা ইসরায়েলের সামরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন, যা প্রায়শই কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে একটি সহানুভূতির জন্ম দেয়। এভাবে, এইপ্যাক একটি পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয় যেখানে ইসরায়েলকে সমর্থন করাকে এক ধরনের ‘নৈতিক’ ও ‘রাজনৈতিক’ দায়িত্ব হিসেবে দেখানো হয়।
এইপ্যাকের মাধ্যমে বিভিন্ন সুপার প্যাক (Super PAC) এবং রাজনৈতিক তহবিল তৈরি করা হয়, যা নির্বাচনী প্রচারণায় কংগ্রেস সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা সরবরাহ করে। রাজনীতিবিদরা অর্থ সহায়তার চেয়ে তাকিয়ে থাকে বিভিন্ন দাতাদের দিকে। তারা নির্দ্বিধায় এইপ্যাকের মত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থ সহায়তা নেয়। এতে তারা অর্থ ও সমর্থক দুটোই পায়। এইপ্যাক এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলের জন্য একটি প্রভাবশালী এবং সমর্থনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করে।
বলা হয়, কোনও নির্বাচিত কর্মকর্তা যদি এইপ্যাকের বিপরীতে অবস্থান নেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এমনকি বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে কংগ্রেস সদস্যরা এইপ্যাকের সমালোচনা করার পর তাদের পুনঃনির্বাচনের সময় আর্থিক সহায়তা হারিয়েছেন, যা তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে দেয়।
এইপ্যাকের রাজনৈতিক কৌশল, “এন্টি সেমিটিজম” লেবেল এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপর এইপ্যাকের প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল সম্পর্কিত যে কোনো সমালোচনাকে “ইহুদী বিরোধী” বা “এন্টি সেমিটিজম” হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা যায়। এসবের জন্য এইপ্যাকের মত প্রতিষ্ঠানগুলোই দায়ী। এইপ্যাকের (American Israel Public Affairs Committee) এই ধরণের কার্যকলাপ মার্কিন রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইপ্যাক এমন একটি শক্তিশালী লবিং গ্রুপ হিসেবে কাজ করে, যা শুধুমাত্র রাজনৈতিক সমর্থন অর্জন করতেই নয় বরং ইসরায়েল-বিরোধী যে কোনো বক্তব্যকে বিতর্কিত করে তুলতে বেশিরভাগ সময় ব্যবহার করে থাকে। এবং এমন একটি পরিসর তৈরি করে যেখানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে।
এই কৌশলটির মূল লক্ষ্য হল রাজনীতিবিদদের এবং জনসাধারণকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে আসা যেখানে ইসরায়েল-বিরোধী কোনো বক্তব্য প্রকাশ করাই রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে কংগ্রেসে এমন একটি পরিবেশ গড়ে ওঠে যেখানে রাজনৈতিক নেতারা ইসরায়েলের সমালোচনা করতে দ্বিধাগ্রস্ত হন, কারণ তারা জানেন যে এইপ্যাকের সমালোচনা করলে রাজনৈতিক ক্ষতির শিকার হতে পারেন। এইপ্যাকের এই প্রভাব মার্কিন রাজনীতিতে এমন একটি প্রবণতা সৃষ্টি করেছে যেখানে কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্যই ইসরায়েলের জন্য সমর্থন করে এবং সেই সমর্থন অব্যাহত রাখে।

ইহুদিদের নিয়ে ইলহান ওমরের সমস্যা স্রোর্সঃ আমেরিকান ইহুদি সমাজ
রাজনীতিবিদদের ক্যারিয়ার ও সামাজিক মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ করতে এই লেবেলিং ইসরায়েলের পক্ষে খুব কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে।। একবার কেউ এই ধরনের লেবেলে চিহ্নিত হলে তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য রাশিদা তালিব এবং ইলহান ওমর যখন ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার সমালোচনা করেন, তাদেরকে সঙ্গে সঙ্গেই “এন্টি সেমিটিজম”-এর লেবেল আরোপ করা হয়। এর ফলে তারা রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্তরে আক্রমণের শিকার হন এবং বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার সম্মুখীন হন।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকসঃ বিতর্ক, তথ্য ফাঁস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লড়াই
রাজনৈতিক মহলে এই লেবেলটি এমন একটি সংকট সৃষ্টি করেছে, যেখানে প্রায় প্রতিটি রাজনীতিবিদ জানেন যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছু বললে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত প্রভাবিত হতে পারে। এর ফলে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা হ্রাস পাচ্ছে এবং নেতৃবৃন্দকে এমন একটি অবস্থানে বাধ্য করা হচ্ছে, যেখানে তাদের মতামত প্রকাশে তারা সতর্ক থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এই কৌশলটি এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে যে রাজনীতিবিদদের ইসরায়েল সম্পর্কে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করার স্বাধীনতা থাকে না। “জায়োনিস্ট শুটিং গ্যালারি” কথাটি এই কারণেই ব্যবহৃত হয় যেখানে সমালোচকরা নীরব হওয়ার জন্য চাপের মুখে পড়েন। এর ফলে তারা রাজনীতি বা অন্যান্য সামাজিক ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়েন।
জনমত প্রভাবিত করার কৌশল
এইপ্যাক (AIPAC) কেবল রাজনীতিবিদদেরই নয়, জনসাধারণের মতামতও প্রভাবিত করার কৌশল হিসেবে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে। এইপ্যাকের এই প্রভাবের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। গণতান্ত্রিক নীতিতে মূলত জনগণের ইচ্ছা, মতামত ও চাহিদা গুরুত্ব পায়, কিন্তু এইপ্যাকের প্রভাবের কারণে রাজনৈতিক নেতারা তাদের প্রকৃত মত প্রকাশ করতে পারছেন না। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং টেলিভিশন চ্যানেল এইপ্যাকের প্রভাবে ইসরায়েলের পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করে থাকে। তারা এমন খবর এবং প্রতিবেদন প্রচার করে, যা ইসরায়েল-বিরোধী অবস্থানকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করে। সাধারণ জনগণের মধ্যে এই ধরনের প্রচারের কারণে একটি ধারণা গড়ে ওঠে যে, ইসরায়েলের সমালোচনা করা মানে ইহুদী বিরোধিতা করা। এর ফলে, সমাজে এমন একটি মনোভাব জন্মায় যে, ইসরায়েলের প্রতি যে কোনো সমালোচনা করা রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিতে অনুচিত এবং বিতর্কিত।
এইপ্যাকের এই প্রচেষ্টা কেবলমাত্র জনমতের উপর নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থার উপরেও প্রভাব বিস্তার করে। মার্কিন স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই ইসরায়েল সম্পর্কিত সমালোচনামূলক তথ্য উপস্থাপন করা হয় না, যা শিক্ষার্থীদের মাঝে নির্দিষ্ট ধরনের পূর্বাগ্রহ তৈরি করে। এর ফলে, একটি পক্ষপাতদুষ্ট সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে। এটি গণতন্ত্রের মূল ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং জনসাধারণের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক সিস্টেমকে একটি নির্দিষ্ট পক্ষের জন্য কার্যকরী করে তোলে।
জাতীয়তাবাদ: আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক চালিকা শক্তি
প্রেসিডেন্টদের প্রতি এইপ্যাকের প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্টরাও এইপ্যাকের (American Israel Public Affairs Committee) ব্যাপক প্রভাব থেকে মুক্ত নন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যেকোনো নেতাকে শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাই নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নানা সমীকরণে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। এইপ্যাকের প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে, ইসরায়েলের স্বার্থের বিপরীতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া প্রেসিডেন্টদের জন্য প্রায় “রাজনৈতিক আত্মহত্যা” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এইপ্যাকের প্রভাবের কারণে প্রেসিডেন্টরা অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থের চেয়েও ইসরায়েলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন, যা মার্কিন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
ইসরায়েল স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্টদের বাধ্যবাধকতা
১৯৯১ সালে, প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ.ডব্লিউ বুশের প্রশাসনে এমন একটি ঘটনা ঘটে যা এইপ্যাকের শক্তির স্পষ্ট উদাহরণ। প্রেসিডেন্ট বুশ তখন ইসরায়েলকে $১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা প্রস্তাব কংগ্রেসে আটকে দেন। প্রেসিডেন্ট বুশ মনে করেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি এবং অন্যান্য মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের স্বার্থে ইসরায়েলকে এই সহায়তা কিছুটা সীমিত রাখা উচিত। কিন্তু এইপ্যাক তখন কংগ্রেস সদস্যদের উপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করে এবং শেষমেশ এই সহায়তা আদায়ে সফল হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে কেবল প্রেসিডেন্ট নয়, বরং কংগ্রেসও এইপ্যাকের নিয়ন্ত্রণাধীন।
গাজায় গণহত্যায় ইসরায়েলকে অস্ত্র দিচ্ছে কারা?
যুক্তরাষ্ট্রে এমনকি পরবর্তী প্রেসিডেন্টদের ক্ষেত্রেও ইসরায়েল-সমর্থনমূলক নীতি গ্রহণের চর্চা দেখা গেছে। ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং তার প্রশাসন যখন ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তির আলোচনায় প্রবেশ করেছিল, তখন এইপ্যাক ইসরায়েল-বিরোধী হিসেবে চুক্তির সমালোচনা করে এবং প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। বিভিন্ন কৌশলগত কারণে ওবামার প্রশাসন চুক্তি করলেও এইপ্যাকের বিরোধিতার কারণে তিনি ব্যাপক রাজনৈতিক ও গণমাধ্যমের চাপের মুখে পড়েন। এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও, তার প্রচারণার সময় থেকে ইসরায়েলের পক্ষে একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছিলেন, যা এইপ্যাকের প্রভাবের প্রতিফলন বলে বিবেচিত হয়। যেমন, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, গোলান মালভূমির উপর ইসরায়েলি আধিপত্যকে স্বীকৃতি দেওয়া ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি এইপ্যাকের চাহিদা পূরণ করেন।
এইপ্যাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া প্রেসিডেন্টদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ এর মাধ্যমে তারা প্রচুর রাজনৈতিক চাপের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে মার্কিন গণমাধ্যমে এইপ্যাকের সমর্থনকারী ব্যক্তিরা বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যু তুলে ধরে এবং যেকোনো ইসরায়েল-বিরোধী বক্তব্যের বিরোধিতা করে। গণমাধ্যমে এর প্রভাব থাকার ফলে জনমতের উপরও একটি চাপ সৃষ্টি হয়, যেখানে সাধারণ জনগণ মনে করে যে ইসরায়েলের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দেওয়াই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে। ফলে প্রেসিডেন্টদের জন্য এটি এমন একটি রাজনৈতিক সমীকরণে পরিণত হয়, যেখানে তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে এইপ্যাকের প্রভাব
অন্যদিকে, এইপ্যাকের এই ধরনের লবিং কার্যক্রম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এইপ্যাকের প্রভাবের ফলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি প্রায়শই ইসরায়েলের পক্ষে বাঁক নিয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া সমর্থন মূলত এইপ্যাকের প্রভাবের কারণে সৃষ্ট, যা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পক্ষপাতমূলক ভূমিকা পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের সামরিক সম্পৃক্ততা এবং ইসরায়েলের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ককে অবনমিত করছে। এইপ্যাকের কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি এবং ইসরায়েলের প্রতি নির্দিষ্ট সহায়তা প্রদান থেকে প্রেসিডেন্টরা সরে আসতে পারেন না। ইসরায়েলকে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বিশাল ব্যয়বহুল সিদ্ধান্ত, কিন্তু কেবলমাত্র এইপ্যাকের প্রভাবের কারণে এই সহযোগিতা বন্ধ করা বা সীমিত করাও তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে অসম্ভব। এভাবে এইপ্যাক মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রেসিডেন্টদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে।
এইপ্যাকের (AIPAC) প্রভাবযুক্ত পরিবেশে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন ও তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে পদক্ষেপ নেওয়ার চাপে প্রেসিডেন্টদের নিজেদের দেশ ও জাতীয় স্বার্থকে অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করতে হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এইপ্যাকের এ ধরনের প্রভাব মার্কিন রাজনীতিকে একটি সংকটময় অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে এবং স্বাধীন নেতৃত্বের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এইপ্যাকের প্রভাবযুক্ত এই রাজনৈতিক পরিবেশ মার্কিন রাজনীতিতে একটি গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যে, আদৌ কি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে রক্ষা করতে, এইপ্যাকের প্রভাব থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।
One Comment
Leave A Comment
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রেরঃ নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা
গত ১৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পথ
গত ১২ই মে, ২০২৫ সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর এবার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল নির্বাচন কমিশন।
পিকেকে-র বিলুপ্তি: তুরস্কের জন্য সুযোগ নাকি কুর্দিদের জন্য নতুন সংকট?
পিকেকে-র বিলুপ্তির ঘোষণা: তুরস্কের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ, নাকি কুর্দিদের জন্য অধিকার হারানোর নতুন ঝুঁকি?
অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুসঃ ভারতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা
পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে "অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস" নামে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অভিযানের নামটির অর্থ "গলিত সীসায় নির্মিত অভেদ্য প্রাচীর"।
আদালতের এখতিয়ারঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও বাংলাদেশে প্রয়োগ
বিচারিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আদালতের এখতিয়ার। আদালতের এখতিয়ার তিন প্রকারঃ আদি এখতিয়ার, আপীল এখতিয়ার, এবং পরিদর্শন এখতিয়ার।
[…] […]