পৃথিবীর ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কখনই আধিপত্যবাদীদের সাথে, সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে স্বাধীনতাকামী জনগণের আপোষ হয়নি। যুগে যুগে কোনো না কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠী অন্যায়-অবিচার ও উপনিবেশবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী এবং আধিপত্যকামী শক্তিগুলো ও তাদের স্থানীয় অনুচর কিংবা তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। তেমনি এক ঐতিহাসিক বিপ্লব হলো ইরানের ইসলামী বিপ্লব। বিংশ শতাব্দীর ইরানের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯৭৯ সালের প্রথম দিকে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানের ইসলামী বিপ্লব, যার মাধ্যমে আমেরিকা-ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের অনুচর পাহলভী রাজবংশের পতন ঘটিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সূচনা করা হয়।
ইরানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। শুধু ইরানের বললে ভুল হবে বরং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে। এই নিবন্ধে ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ইমাম খোমেনীর প্রভাব আলোচনা করা হয়েছে। চলুন, আলোচনা শুরু করা যাক।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব কি?
ইরানের ইসলামী বিপ্লব দু এক দিনের কোন ঘটনা নয়। বহু বছরব্যাপী পাহলভী রাজবংশের অপশাসন, পচিমাদের প্রতি আনুগত্য, ইরানের ঐতিহাসিক সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করে পশ্চিমা সংস্কৃতি চালু করা, ইরানের জাতীয় সম্পদের ওপর আমেরিকা-ব্রিটেনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রনের বিরুদ্ধে ইরানিদের গণঅভ্যুত্থানই হলো ইরানের এই বিপ্লব। আর এর সাথে ধর্মীয় অনুভূতি, আবেগ, ও সচেনতার সম্মিলনে এই গণঅভ্যুত্থান ইসলামি বিপ্লবে রূপ নেয়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন ইমাম খোমেনী। পতন ঘটে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ঐতিহ্যবাহী রাজবংশের সর্বশেষ সম্রাট মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর। ফলে প্রায় আড়াই হাজার বছরের এই রাজবংশের বিলুপ্তি ঘটে ১৯৭৯ সালে।
মরক্কোর জাতীয়তাবাদি আন্দোলন ও সুলতান মুহাম্মাদ
ইরানের ইসলামী বিপ্লব বুঝতে হলে আমাদের কিছু বিষয় জানতে হবে। প্রথমত বিপ্লবের পটভূমি ও সম-গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে বিপ্লবের পক্ষসমূহ। বিপ্লবের পটভূমিতে আসবে বিপ্লবের আগ পর্যন্ত নানা ঘটনাসমূহ, কারণসমূহ, পাহলভি রাজবংশের শাসন, আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীদের আচরণ, প্রভাব প্রভৃতি বিষয়। আর এসব বিষয়ের সাথে জড়িত পক্ষগুলোর সাথে পরিচিত হতে হবে।
শুরুতে পক্ষগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। ইরানের ইসলামী বিপ্লবে প্রধানত দুটি পক্ষ, প্রথমত, আমেরিকা-ব্রিটেনের পুতুল রেজা শাহের পাহলভী রাজবংশ এবং দ্বিতীয়ত, ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানের আপামর জনসাধারণ।
রেজা শাহ ও পাহলভী রাজবংশ
হাজার বছর ধরে চলা রাজবংশের শেষ ইরানি রাজবংশ ছিল পাহলভী রাজবংশ ছিল। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র হিসেবে দীর্ঘ আটাশ বছর এই রাজবংশ শাসন পরিচালনা করে। আর ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব পর্যন্ত স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র হিসেবে ইরান শাসন করে। পারস্য নামেই মধ্যপ্রাচ্যের এই ভূখন্ডটি পরিচিত হলেও পরবর্তীতে রেজা শাহ এই ভূখন্ডটির নামকরণ করেন ‘ইরান’।
১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সহায়তায় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কাজার রাজবংশের শেষ শাহ আহমদ শাহ কাজারকে ক্ষমতাচ্যূত করে রেজা শাহ পাহলভী রাজবংশের সূচনা করেন। রেজা শাহ ১৯২৫ থেকে ১৯৪১ মেয়াদে ইরানে শাসন পরিচালনা করেন তিনি। তিনি তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মপ্রাণ ইরানী ও ব্রিটিশ অসন্তুষ্টিতে সে নীতি থেকে সরে আসেন।
তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কিন্তু তার উদ্ধত আচরণ আর স্বৈরাচারী শাসনের জন্য তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে এবং জনগণ তার বিপক্ষে চলে যায়। তার পদত্যাগের জন্য আন্দোলন শুরু করে দেয়। জনবিক্ষুব্ধ এমন পরিস্থিতিতে ১৯৪১ সালের আগস্টে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র বাহিনী ইরান আক্রমণ করে। ব্রিটিশ ও সোভিয়েত শক্তির প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ইরানের সশস্ত্রবাহিনী পরাজিত হয়। ১৯৪১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মিত্রশক্তি রেজা শাহকে তার পুত্র মুহাম্মদ রেজা পাহলভীর কাছে জোরপূর্বক ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করে এবং রেজা শাহকে চুড়ান্তভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় নির্বাসনে পাঠায়।
মুহম্মদ রেজা শাহ পাহলভী
রেজা শাহ পাহলভীর পর শাসন ক্ষমতায় আসেন তার পুত্র মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী। দুনিয়ার সবচেয়ে পুরোনো, ঐতিহ্যবাহী আর প্রভাবশালী শাহী রক্তের ধারক ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় ১৯৪১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ব্রিটিশরা তাকে ক্ষমতায় বসায়। ক্ষমতায় আসীন হয়ে তিনি ‘শাহানশাহ’ পদবী ধারণ করেন। তার আমলে অল্প সময়ের জন্য ইরানের তৈলশিল্প জাতীয়করণ করা হয়। অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক পুণর্গঠনকে ঘিরে শ্বেত অভ্যুত্থানের প্রবর্তন করেন। এর পাশাপাশি ইরানকে বৈশ্বিক শক্তিতে রূপান্তর করার চেষ্টা ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্প-কারখানার আধুনিকীকরণ এবং মহিলাদের ভোটাধিকার চালু করেন।
ন্যাটো কি? এর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও কার্যাবলি আলোচনা কর। বর্তমানে ন্যাটোর প্রয়োজন আছে কি?
তবে, তিনি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা তার পতনকে তরান্বিত করে। ধর্ম নিরপেক্ষবাদী মুসলিম হিসেবে তিনি শিয়াদের সমর্থন হারানোসহ শ্রমিক শ্রেণী, বাজারী নামে পরিচিত ব্যবসায়ীদের সাথে সংঘর্ষ, ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক বজায়, দূর্নীতিতে শাসকগোষ্ঠীর জড়ানোয় তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। এছাড়াও, বিভিন্ন বিতর্কিত নীতি গ্রহণ, সমাজতান্ত্রিক দল তুদেহ পার্টি নিষিদ্ধকরণ ও গোয়েন্দা সংস্থা সাভাককে রাজনীতিতে জড়ান। শিয়া ইসলামপন্থীদের সাথে তার মতভেদ ঘটতে থাকে ও কম্যুনিস্টদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭৯ তারিখে ইরানের ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয় ও তাকে ইরান ছেড়ে পালিয়ে যান।
ইমাম খোমেনী
সৈয়দ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেইনী গোটা বিশ্বে আয়াতুল্লাহ খোমেনী হিসেবে পরিচিত। তিনি একজন ইরানি রাজনীতিবিদ, বিপ্লবী ও শিয়া ধর্মগুরু। তিনি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়ে ইরানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
আয়াতুল্লাহ খোমেনী ১৯০২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইরানের খোমেন শহরের একটি সম্ভ্রান্ত ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইরান, মুসলিম উম্মাহ ও গোটা বিশ্বে বড় পরিবর্তন এনেছিলেন প্রয়াত এই ধর্মীয় নেতা। ধর্মীয় ব্যাপারে যেমন প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি, তেমনি জ্ঞান, আইন, দর্শনেও বেশ পারদর্শী ছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৬১ সালে। ১৯৬৩ সালে তিনি তত্কালীন শাহ সরকারের অত্যাচার, নিপীড়ন ও আমেরিকার পদলেহী নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সে সময় মোহাম্মাদ-রেজা শাহ ইরানে কথিত শ্বেতবিপ্লব শুরু করেছিলেন।
ইরানের রাজনীতিতে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর অবদান অসামান্য। প্রথমত, তার নেতৃত্বেই ইরান রাজতন্ত্র থেকে মুক্তি পায়। দ্বিতীয়ত,তিনি মুসলিম বিশ্বে ইসলামী জাগরণ আন্দোলনকে প্রজ্বলিত করেন এবং ফিলিস্তিনিকে সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীকারকে প্রধান ইস্যুতে পরিণত করেন।এবং তৃতীয়ত, অমুসলিম দেশগুলোতেও বস্তুবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে আধ্যাত্মিকতাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন।
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পটভূমি
আপাতদৃষ্টিতে প্রবল শক্তিমান এবং ব্রিটিশশক্তির সমর্থনপুষ্ট মুহম্মদ রেজা শাহের উৎখাত হঠাৎ করে একদিনে বা শুধুমাত্র একটি কারণে হয়নি। রাতারাতিও ইসলামী বিপ্লব সফলতার মুখ দেখেনি। এর জন্য সুদীর্ঘ, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। নানা কারণ, ঘটনা, প্রভাবের ফসল মুহাম্মদ রেজা শাহের উৎখাত ও ইসলামী বিপ্লবের সফলতা। নিবন্ধের এ পর্যায়ে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পটভূমি নিয়ে আলোচনা করব।
১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরানি বিপ্লব ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমাজের বিদ্রোহ। ইরানের সামরিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন, ইরানের জনসাধারণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আমেরিকা-ব্রিটেনের প্রভাব বন্ধ করা ও তাদের দেশীয় দোষরদের প্রতিহত করা, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে প্রতিহত করে ইসলামী সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত করা, ছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লবের লক্ষ্য। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের শুরু যেদিন থেকে আমেরিকা-ব্রিটেন ইরানে পুতুল সরকার বসিয়ে ইরানের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা শুরু করেছে সেদিন থেকেই। যাইহোক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে থেকেই আমরা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পটভূমি পর্যালোচনা করব।
১৯৫৮ সালে ইরাকের সামরিক বিপ্লবের পটভূমি
১৯১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণগুলি ছিল পৃথিবীর বড় ক্ষমতাশীল দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা, সাম্রাজ্যবাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান। যুদ্ধের ফলে বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ইরানের ইতিহাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর তৎকালীন পারস্য যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। ১৯১৭ সালে ব্রিটেন রাশিয়ায় আক্রমণ পরিচালনার্থে ইরানকে ব্যবহার করে। কিন্তু ব্রিটেনের ব্যর্থতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারস্যের উত্তরাংশ দখল করাসহ পারস্য সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠন করে। একমাস পর ব্রিটিশ মদদে রেজা শাহ তিন-চার হাজার সৈনিক নিয়ে রাজধানী তেহরান দখল করেন এবং সরকার গঠন করে। রেজা শাহকে ক্ষমতায় বসিয়ে মূলত ইরানের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয় ব্রিটেন।
রেজা শাহের রাজতন্ত্র ইরানের আধুনিকীকরণে মনোনিবেশ করে, কিন্তু এটি জনগণের রাজনৈতিক অধিকারকে দমন করা শুরু করে। তার আমলে ট্রান্স-ইরানিয়ান রেলপথ নির্মিত হয় ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ও তার আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।অনেক ইরানি ছাত্রকে ইউরোপীয় শিক্ষায় সম্পৃক্ত করতে তার সরকার সহায়তা করে।এছাড়াও, জনস্বাস্থ্যের আধুনিকায়নেও তার সরকার ভূমিকা রাখে। কিন্তু ইরানের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, সভ্যতাকে সরিয়ে ব্রিটেনের হাতের পুতুল হয়ে রেজা শাহ পশ্চিমা সভ্যতা আমদানি শুরু করে করেন। তিনি ইরানের দাপ্তরিক নাম পারস্য থেকে ‘ইরান’ করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তেলের ব্যাপক চাহিদা বাড়লে ইরানে তেল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সেসময় ইরানের তেলক্ষেত্রগুলোতে মূলত ব্রিটেনেরই চুড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু তৎকালীন ব্রিটিশ তেল কোম্পানি তেলের হিসাব নিকাশের ক্ষেত্রে অসাধুতা অবলম্বন করে ইরান সরকারকে ন্যায্য রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত করে। এর প্রতিবাদে রেজা শাহ্ ১৯৩২ সালে অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানির সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল ঘোষণা করলে দু পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার পারস্য উপসাগরে যুদ্ধ জাহাজ পাঠায়।
যাইহোক, পাহলভী রাজবংশের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রেজা শাহের উদ্ধত আচরণ এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে এবং জনগণ তার বিপক্ষে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। তিনি ধীরে ধীরে জার্মানীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এমতাবস্থায় ইরানের ওপর নিয়ন্ত্রন আরো জোরদার করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন আরো তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯৪১ সালের আগস্টে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মিত্রশক্তির পক্ষ থেকে ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরান আক্রমণ করে। ব্রিটিশ ও সোভিয়েত শক্তির প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ইরানের সশস্ত্রবাহিনী পরাজিত হয়। ব্রিটেন রেজা শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে তারই পুত্র মুহাম্মদ রেজা শাহকে ক্ষমতায় বসায়।
মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর ক্ষমতাগ্রহণ ইরানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল। মুহম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর ধীরে ধীরে জনগণের ওপর প্রভাব বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তি সময়ে ইরানে অনেক তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এসব তেলক্ষেত্রে ব্রিটেন নিয়ন্ত্রণ নিতে উঠে পড়ে।
যদিও সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাবিরোধী সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে মুহাম্মদ রেজা শাহের সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল, তবুও তিনি সরকার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করেন। তিনি নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। এই সময়ে ১৯৪১ সালে ডঃ মোসাদ্দেক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ইরানের তেলক্ষেত্রসমূহে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণ বিরোধী ছিলেন এবং তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এবং অল্প সময়ে তুদেহ পার্টি ইরানে ব্যপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ অবস্থায় ১৯৪৯ সালে মুহাম্মাদ রেজা শাহকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সোভিয়েতপন্থি কমিউনিস্ট রাজনৈতিক দল ‘তুদেহ পার্টি’কে সকল ধরণের রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা থেকে নিষিদ্ধ করেন।
মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্রসমূহ এবং ইরানের তেল শিল্প জাতীয়করণে ডঃ মোসাদ্দেকের ভূমিকা
১৯৫১ সালে তেল জাতীয়করণের প্রস্তাব সংসদে পাশ হলে মোসাদ্দেকের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ইরানি মজলিস তেল জাতীয়করণ আন্দোলনের নেতা ড. মোসাদ্দেককে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন। ইরানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং জাতীয়তাবাদী দল সহ বিভিন্ন গোষ্ঠী তেল শিল্পের জাতীয়করণকে সমর্থণ করেছিল। ফলে ইরানের শাহ বাধ্য হয়ে তেল জাতীয়করণ আইনে স্বাক্ষর করেন।
এতে সবচেয়ে বেশি অসুবিধার মুখে পড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। জাতীয়করণ করলে এই দুই দেশকে তেল দ্বিগুণ অর্থ দিয়ে কিনতে হবে। যার ফলে মোহাম্মদ মোসাদ্দেক তাদের রোষানলে পড়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ১৯৫২ সালে তিনি মুহাম্মদ রেজা শাহের সাথে দ্বন্দ্বে পদত্যাগ করলেও অব্যবহিত পরেই আবার দায়িত্বে আসীন হন জনগণের দাবির মুখে। ব্রিটিশ এম্বাসির এক নথিতে দেখা যায়, ব্রিটিশরা মোসাদ্দেককে ইরানে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের হুমকি হিসেবে দেখছে। তারা খুব দ্রুত আমেরিকা-ব্রিটেনের হস্তক্ষেপ চাচ্ছে মোসাদ্দেককে মোকাবেলা করতে।
মোসাদ্দেককে সরাতে নীল নকশা অনুযায়ী কাজ শুরু করে আমেরিকা-ব্রিটেন। প্রণীত হলো অপারেশন ‘এ্যাজাক্স’ এর নীল নকশা। পরিকল্পনা অনুযায়ি সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মোসদাদ্দেককে সরানো হলো। কিন্তু পরের দিনই কাউন্টার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু দুদিন পর আবার পাল্টা অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেকের চুড়ান্ত পতন ঘটানো হয়। ঠিক এই সুযোগটিই যেন গ্রহণ করেন মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৫ আগস্ট সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ব্রিটেনের সমর্থনে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ইরানে তার অপশাসনের চূড়ান্ত রূপ স্বৈরতান্ত্রিক শাসন নীতি নিয়ে আসেন।
মুহম্মদ রেজা শাহ স্বৈরতান্ত্রিক শাসননীতি
১৯৫৩ সাল থেকে যদিও মুহাম্মদ রেজা শাহ নতুন করে আমেরিকা-ব্রিটেনের মদদে ক্ষমতায় আসেন, তিনি ১৯৬০ থেকেই তিনি বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়াতে কুখ্যাত স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেন। ওই সময় থেকেই তিনি রাজনৈতিক সমস্ত ক্ষমতাকে তিনি নিজ হাতে কুক্ষিগত করতে সচেষ্ট হন। কিছুক্ষেত্রে সীমিত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ তার উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল বুর্জোয়া ও সামন্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে ইরানের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ধর্ম নিরপেক্ষতার আদল বদলে দিতে চেয়েছেন, নিয়েছেন নানা পদক্ষেপ। যেমনঃ ১৯৬৩ সালে মুহাম্মদ রেজা শাহ ইরানে অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক পুণর্গঠনকে ঘিরে ছয়দফা সম্বলিত শ্বেত অভ্যুত্থানের প্রবর্তন করেন। তিনি ইরানকে বৈশ্বিক শক্তিতে রূপান্তর করার চেষ্টা ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্প-কারখানার আধুনিকীকরণ এবং মহিলাদের ভোটাধিকার চালু করেন। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে তিনি বেশকিছু পন্থা অবলম্বন করেন। পরবর্তিতে এসব পদক্ষেপের ফলশ্রুতিতে ইরানে ইসলামী বিপ্লবকে ডেকে আনে। পদক্ষেপগুলো নিম্নরূপঃ
একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা
সাধারণত যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হয়ে থাকে সেই পন্থা অবলম্বন না করে স্বীয় কার্যসিদ্ধির তাগিদে অত্যন্ত চতুরতার সাথে কৃত্রিমভাবে শাহ নিজের অনুচরদের দ্বারা “মিল্লিয়ুন” ও “মারদুন” নামে সরকারি ও বিরোধী দল গঠন করেন। তবে এটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় শাহ মিল্লিয়ুন দলের স্থলে “ইরান নোভিন দল” গঠন করেন। কিন্তু শুধুমাত্র যেন এর বাহ্যিক আবরণটাই পাল্টে ফেলা হয়েছিল বাকি কার্যক্রম ছিল একই রকমের। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে এ দল অধিকাংশ আসন লাভ করলেও এটি ছিল প্রহসনমূলক। ১৯৭৫ সালের ২ মার্চ তারিখে শাহ এক দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
গোয়েন্দা সংস্থা গঠন ও নির্যাতনমূলক দমননীতি গ্রহণ
ক্ষমতার লোভ যেন মুহম্মদ রেজা শাহকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল। স্বীয় ক্ষমতার প্রতি সামান্যতম হুমকি কঠোরভাবে দমন করার জন্য বর্তমান শতাব্দীর অন্যতম ঘৃণিত নির্যাতনধর্মী গোয়েন্দা সংস্থা “সাভাক” গঠন করেন। সামান্য সন্দেহের অযুহাতে যে কোনো নাগরিককে গ্রেফতার ও নির্যাতন চালানোর কাজে এ সংস্থা দক্ষতা অর্জন করে। এক্ষেত্রে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ গোপনে মদদ দান কার্যক্রম তো অব্যাহত ছিলই। এ সংস্থার প্রধান শাহের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে কাজ করতেন। এ সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিনাশ ঘটানো।
উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফা নীতি কি? প্যারিস শান্তি সম্মেলনে তার ইচ্ছা কতখানি পূরণ হয়েছিল?
বিভিন্ন বিতর্কিত নীতি গ্রহণ, সমাজতান্ত্রিক দল তুদেহ পার্টি নিষিদ্ধকরণ করে তদস্থলে ‘রিসার্জেন্স পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। রিসার্জেন্স পার্টি প্রতিষ্ঠার পরই শাহ হয়ে ওঠেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার , সংবাদপত্রের উপর কঠোর বিধিনিষেধ, বিরুদ্ধমতকে প্রতিহত করা, রাজনৈতিক কারণে গুম ও খুনের ঘটনা ইত্যাদি যেন সাধারণ মানুষের মাঝে এক আতঙ্কের কারণ হয়ে দাড়ায় যা পরবর্তীতে রূপ নেয় আন্দোলনের।
ইরানের অর্থনীতি ব্যক্তিগতকরণ
রেজা শাহের সময় তেল ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও দিন দিন যেন বেকারত্বের সংখ্যা দ্রুত হারে বেড়েই চলছিল। যে কোনো দেশের জন্যই বেকার সমস্যা এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। মুহম্মদ রেজা শাহের আমলেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও শাহ তার পরিবারবর্গের ও তার উপর নির্ভরশীল উচ্চ বুর্জোয়াদের হাতে রেখেছিলেন। তেল সম্পদ হতে অর্জিত এক উল্লেখযোগ্য অংশ তিনি নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত করেন। পাশ্চাত্যের একটি সংবাদপত্রের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়-
- ৯৭ টি ব্যাংক ও বীমা কোম্পানীর বৃহৎ অংশের মালিক পাহলভী বংশের সদস্যবৃন্দ। ইরানের তৃতীয় বৃহৎ বীমা কোম্পানীর ৮০% মালিকানাও তাদের।
- গৃহ নিরূমাণের সরঞ্জাম প্রস্তুতের ১০টি কোম্পানীতে তাদের শেয়ার ছিল।
- দেশের বৃহৎ সিমেন্ট কারখানায় তাদের ২৫% অংশ ছিল।
- ২৫ টি ইস্পাত ও লৌহ কারখানার মালিকানাও ছিল তাদের।
- খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও বাজারজাতকরার ৮ টি কোম্পানী ছিল তাদের হাতে।
- ২৩ টি খাদ্য কারখানা তাদের মালিকানায় পরিচালিত হত।
পরিসংখ্যানগতভাবে ইরানের অর্থনীতির চাকাকে সচল দেখালেও মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ভোগদখল করে সম্পদ বৃদ্ধির পায়তারা ইত্যাদির কারণে অর্থনীতির চাকা মূলত অচল হবার পথেই এগিয়ে যেতে থাকে। এছাড়াও ১৯৬৩ সালের শ্বেত অভ্যুত্থানের নানান নীতি ইরানের আর্থ-সামাজিক ঐতিহ্য বিরোধী ছিল।
আমেরিকার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন
শাহ তার ক্ষমতার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার জন্য ডঃ মোসাদ্দেকের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। অপরদিকে আমেরিকাও স্বার্থ হাসিলের জন্য শাহকে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বাগদাদ চুক্তির মাধ্যমে এ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠানিক রুপ লাভ করে। কিন্তু ১৯৫৮ সালে ইরাকের সামরিক অভ্যূত্থানের পর এ চুক্তি অর্থহীন হয়ে যাওয়ায় ১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে পুনরায় দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে শাহ মার্কিন সফরে যান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানকে অস্ত্র ক্রয়ের জন্য ২০০ মিলিয়ন ঋণ প্রদান করার কথা ঘোষণা করেন। এর প্রতিদানে শাহ ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর ইরানে কর্মরত মার্কিন নাগরিকদের বিভিন্ন সুযোগ প্রদানের জন্য মজলিসে এক আইন প্রণয়ন করেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনঃ যুক্তফ্রন্টের গঠন, বিজয় ও মুসলিম লীগের পরাজয়
পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রচলন ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ
মার্কিনীদের সাথে মুহাম্মদ রেজা শাহের সুসম্পর্কের সুবাদে ইরানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে যা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বিভিন্ন অনৈসলামিক কার্যকলাপ ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সূচনা ঘটায়। তার অনৈসলামিক কার্যাবলী হলোঃ
- নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে তিনি ১৯৭৬ সালে ইসলামী ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে শাহী ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করেন।
- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওয়াকফ সম্পত্তি রাষ্ট্রয়াত্তকরণ করেন।
- পাশ্চাত্য পোশাকের প্রবর্তন করেন। নারীদের অবাধ চলাফেরা তথা পর্দা প্রথা হ্রাস করেন যা ইরানের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে।
- পাঠ্যসূচি থেকে ধর্মীয় প্রথা হ্রাস করেন।
- সাভাক বাহিনী কর্তৃক ধর্মীয় নেতৃবেন্দের উপর চালানো নির্যাতন প্রভৃতি কারণে বিভিন্ন শ্রেণী মুহাম্মদ রেজা শাহের বিরোধিতা করতে থাকে।
মোল্লাহ শ্রেণীর আন্দোলন
“মোল্লাহ শ্রেণী” ইরানের রাজনীতিতে যার প্রভাব ছিল ব্যাপক। রাষ্ট্রীয় যে কোনো ব্যপারে তারা হস্তক্ষেপের অধিকার ছিল তাদের। কারণ ১৯০৬ সালের সংবিধানে বলা হয়েছিল যে, ওলামাদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে শাহ ইসলামী আইন-কানুন রুপ দান করবেন। কিন্তু মুহাম্মদ রেজা শাহ তাদের সাথে কোনো পরামর্শ ছাড়াই ইসলাম বহির্ভূত আইন তৈরী করায় মোল্লাহ শ্রেণীর বিরোধিতার সম্মুখীন হন।
উদারপন্থী ও গণতান্ত্রিক মহল
সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত এই শ্রেণী সংসদীয় গণতন্ত্রের বিপক্ষে ছিল। তাই তারা মুহাম্মদ রেজা শাহের শাসনকে স্বৈরাচারী মনে করে এর অবসানের চেষ্টা চালাতে থাকে। এই শ্রেণীর প্রধান প্রতিভূ ছিলেন ডঃ মোসাদ্দেক ও তার সৃষ্ট ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টি।
বাজারিদের সাথে শাহের সংঘর্ষপূর্ণ সম্পর্ক
বাজারে অবস্থিত ছোট ও মাঝারি দোকানের মালিকরা সাধারণত বাজারি নামে পরিচিত। তাদের সাথে মুহম্মদ রেজা শাহের সংঘর্ষ চলতেই থাকে। তারা ধর্মীয় প্রভাবে এবং বিরাজমান অর্থনৈতিক দুরাবস্থার ফলে শাহী শাসনের বিরোধিতা করতে থাকে।
প্রতিবাদী ছাত্র সমাজ
শাহ শাসনের বিরুদ্ধে এক বড় ধরনের হাতিয়ার হলো এই ছাত্র সমাজ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তারা সদা প্রস্তুত এক সৈন্যদল। সে সময় নানা ধরনের অন্যায়মূলক কার্যের পাশাপাশি শাহের অন্যতম দুর্বল দিক ছিল বেকারত্বের অবসানে গুরুত্ব না দেওয়া।
রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে ছাত্র সমাজ বহুধাবিভক্ত থাকলেও প্রায় প্রতিটি ছাত্র দলই শাহ শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। এই বিক্ষোভের প্রধান কেন্দ্র ছিল তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়।
শ্রমিক সমাজ
ইরানে শ্রমিক সমাজ রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ছিল। তৈল সম্পদে নিয়োজিত ছিল প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক । শাহের স্বৈরাচারী আচরণ, দমনমূলক কার্যক্রম, সাভাক বাহিনীর নির্যাতন ও পাশ্চাত্য প্রভাব সম্পর্কে তারা অবগত ছিল। তাই নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নয় বরং জাতির এই দুর্দিনে একতাবদ্ধ হয়ে শাহ বিরোধী আন্দোলন শুরু করে।
রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুধুমাত্র ১৯৭৮ সালেই অন্যায়ভাবে প্রায় ২,২০০ রাজনৈতিক কর্মীকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল রেজা শাহের নির্দেশে। এছাড়াও ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরতে শাহ প্রচার মাধ্যমগুলোর সাহায্যে নিজেকে অতি মানবিক গুণে গুণান্বিত করে প্রচার করতে থাকেন। তিনি বর্তমান যুগের “মহান সাইরাস” এবং “আর্য-সূর্য” দাবি করে সগৌরবে প্রচার করতে থাকেন। তেল বিক্রির টাকায় ইরানকে ওই অঞ্চলের প্রতাপশালীতে পরিণত করার চেষ্টা মুহাম্মদ রেজা শাহ কম করেন নি। তিনি ইরানের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পূর্ণ বদলান। কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষবাদী মুসলিম হিসেবে তিনি শিয়াদের সমর্থন হারানোসহ শ্রমিক শ্রেণী, বাজারী নামে পরিচিত ব্যবসায়ীদের সাথে সংঘর্ষ, ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা , দূর্নীতিতে শাসকগোষ্ঠীর জড়ানোয় তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডঃ ব্রিটিশ সভ্যতার নৃশংস উপহার
শাহের ব্যক্তিগত আচরণ, অভ্যাস আর পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রচলন দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধীরে ধীরে বিক্ষুদ্ধ করে তোলে। এই বিক্ষোভই অগ্নিগর্ভে রূপ নেয় ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে। সেসময় তেহরান শহরে কোন পাবলিক বাসে কোন ধর্মীয় লেবাসধারী মানুষ উঠলেই কনট্রাকটর টিটকারী করে বলতো, “আমরা আলেম আর বেশ্যাদের বাসে চড়াই না।” রাস্তায় রাস্তায় গড়ে উঠেছিল মদের দোকান। শহর ও শহরতলীতে শত শত নাইটক্লাবে চলতো। সারারাত ব্যাপী ডিস্কো পার্টির নামে মদ্যপান, জুয়া আর অবাধ যৌনাচার চলতো। শাহ নিজেও ছিলেন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। তার স্ত্রী, সন্তানরাও পশ্চিমা ধাঁচে চলতেন। শাহ এবং তার স্ত্রী সকল রাজকীয় অনুষ্ঠান এবং দেশী বিদেশী সরকারী অনুষ্ঠান সমূহে পশ্চিমাদের পোশাক পড়তেন। এসব কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ দিনকে দিন ফুঁসে উঠতে থাকেন। মূলত মুহাম্মদ রেজা শাহের এইধরণের পাশ্চাত্যপন্থী ও পাশ্চাত্যনির্ভর শাসন নীতিই ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পটভূমি রচনা করে।
ইসলামী বিপ্লবে ইমাম খোমেনীর ভৃমিকা
১৯৬১ সাল থেকে শুরু হয় ইমাম খোমেনীর আপোষহীন সংগ্রামের বিরামহীন অধ্যায়। ১৯৬৩ সালের শ্বৈত বিপ্লবের সময় বিভিন্ন সংস্কারের বিরুদ্ধে মোল্লা শ্রেণী আয়াতুল্লাহ খোমেনী ও আয়াতুল্লাহ তেলেখানী এর নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এ সময় শাহ খোমেনীকে বন্দি করেন। ফলে তেহরানে এক গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। শাহ সাময়িক পরিস্থিতি আয়ত্বে এনে খোমেনীকে দেশ থেকে বের করে দেন। দীর্ঘ ১৫ বছরের মতো ইরাকে নির্বাসন দেওয়া হয়। ফলে জনগণ আরো বেশি সোচ্চার হয়ে উঠে। বিদেশ থেকেও ইমাম খোমেনী মুহাম্মদ রেজা শাহ বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যান।
১৯৭৮ সালের ৭ জানুয়ারি এই আন্দোলন মারাত্মক রুপ ধারণ করে। সেদিন এক সরকারপন্থী পত্রিকা ‘ইত্তিলিয়াত’ খোমেনিকে “বিদেশীদের মদদপুষ্ট বিশ্বাসঘাতক” বলে অভিহিত করে। আর তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে খোমেনির কিছু সংখ্যক অনুসারী রাস্তায় নামে। স্বৈরাচারী শাসক মুহাম্মদ রেজা শাহ চরম এক ভুল করে বসলেন। অল্প সংখ্যক মানুষই সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সহজ কোনো উপায়ে তা দমন না করে তিনি কঠিন পন্থা অবলম্বন করলেন, সাধারণ মানুষগুলোর আন্দোলনে গুলি করে, লাঠিপেটা করে দমন করার চেষ্টা করলেন। যা পরবর্তীতে আরো প্রবল আকার ধারণ করলো। ৩/৪ সেপ্টেম্বর তারিখে বিক্ষুব্ধ জনতা এক শোভাযাত্রা করলে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে খন্ডযুদ্ধ হয়।
ব্ল্যাক ফ্রাইডে
সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে ওই মাসেরই ৮ সেপ্টেম্বরে তেহরানের জালেহ স্কয়ারে জনসমাবেশ হয়। আগের রাতে তেহরানসহ আরো ১১টি শহরে জারি করা সামরিক আইন সম্পর্কে হয় এই জনসমাগম জানত না অথবা সামরিক আইনের প্রতিবাদে জড়ো হয়েছিল। জালেহ স্কয়ারে সেদিন হাজার হাজার লোকের সমাবেশ হয়। সমাবেশ ভঙ্গ করতে ব্যর্থ হয়ে সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি শুরু করে। গুলিতে অসংখ্য লোক নিহত হয়। ফ্রান্সের মিশেল ফোকাল্টের হিসেবে ওইদিন কমপক্ষে ২ থেকে ৪ হাজার লোক নিহত হয়েছে কিন্তু বিবিসিসহ অন্যান্যরা দাবি করে করেছে ৮০ থেকে ১০০ জন লোক নিহত হয়েছেন ওইদিনে। এজন্য ইতিহাসের পাতায় এই দিনটা কুখ্যাত ব্ল্যাক ফ্রাইডে (Black Friday) বা কালো শুক্রবার নামে পরিচিত। তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ এজেন্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে রিপোর্ট করেন যে, ৮ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর মুহাম্মদ রেজা শাহের শাসন ক্ষমতা এতোটাই সূদৃঢ় হয়েছে যে, আগামি ১০ বছরে বিরোধী পক্ষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না!
পাহলভী রাজবংশের পতন ও ইসলামী বিপ্লবের চুড়ান্ত সফলতা
এই হত্যাকান্ডের পর খোমেনী ঘোষণা দেন এই ৪০০০ জন নিরপরাধ প্রতিবাদীর মৃত্যুর পর আর কোন কিছু নিয়ে রেজা শাহের সাথে আলোচনা হতে পারেনা। হত্যাকান্ড ও তার পরবর্তি পরিস্থিতে স্বয়ং রেজা শাহ ঘাবড়ে যান এবং পরবর্তি কোন বিক্ষোভ দমন না করতে সিদ্ধান্ত নেন। ৯ সেপ্টেম্বর থেকেই সারাদেশব্যাপী শ্রমিকরা টানা কর্ম বিরতিতে অংশ নেয়। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে রেজা শাহ ইরাকের সরকারের সাথে আলোচনা করে খোমেনীকে ফ্রান্সের প্যারিসে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে জনগণ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ৪/৫ নভেম্বর সরকারী বাহিনীর সাথে এক মারাত্মক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
খোমেনী ফ্রান্স থেকেই নির্দেশনা দিতে থাকেন। কিছুদিন পর নভেম্বরে ন্যাশনাল ফ্রন্টের করিম সানজাবি খোমেনীর সাথে ফ্রান্সে সাক্ষাত করে “ইসলামী গণতান্ত্রিক সরকার” গঠনে আপোষ করে। এদিকে ইরান জুড়ে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সহ বিক্ষুব্ধ জনতারা সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করে। পশ্চিমা আদর্শের সব স্থাপনা, চিহ্ন প্রভৃতি ভাংচুর করে। ব্রিটিশ ও আমেরিকা এম্বেসি সহ নানান জায়গা ভাংচুরসহ আগুনে পুড়িয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। পুলিশ, সেনাবাহিনী সঠিক নির্দেশনার অভাবে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং মুহাম্মদ রেজা শাহও সাহস পায়নি কোনভাবে পরিস্থিতি দমন করার।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৬ নভেম্বর রেজা শাহ সরকার ভেঙে দিয়ে নতুন করে গুলাম রেজা আযহারীর নেতৃত্বে সামরিক সরকার গঠন করে এবং রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ইরানীদের কাছে ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে ভাষণ দেয়। কিন্তু রেজা শাহের এই আবেগকে ইরানীরা প্রশ্রয় দেয়নি। উপরন্তু খোমেনি ইরানীদের কোনরূপ আপোষ না করে সরকার পতনের আহবান জানায়।
আন্দোলন চলতে থাকে সর্বত্রই। শিয়াদের পবিত্র মাস মহররমেও বিপ্লবের আগুন জ্বলতে থাকে সারা ইরান জুড়ে। সামরিক সরকারের রাস্তায় বিক্ষোভে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ২ ডিসেম্বর থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে সরকার বিরোধীতায়। শাহের সরকার প্রথমে এই বিশাল বিক্ষোভকে মোটেই গুরুত্ব না দিলেও দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকলো। রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষুদ্ধ মুসলমানেরা নেমে আসলো। মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর পদত্যাগ ও খোমেনীর ইরানে প্রত্যাবর্তনের দাবীতে সারা দেশ জুড়ে বিক্ষোভ চলতেই থাকে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ৬০ থেকে ৯০ লক্ষ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে মুহাম্মদ রেজা শাহ করিম সানজানিসহ ১২০ জন বিরোধী দলীয় নেতাকে মুক্তি দেয়। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশই হাতের নাগালের বাইরে চলে যায় মুহাম্মদ রেজা শাহের।
১০ ও ১১ ডিসেম্বরে প্রায় ৬০ থেকে ৯০ লক্ষ লোক গোটা ইরান জুড়ে রেজা শাহ বিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কমপক্ষে ইরানের ১০% লোক ইরানের ইসলামী বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে। ১১ ও ১২ তারিখে জনগণ তিন আদর্শের সমন্বয়ে “আল্লাহ, ইরান ও খোমেনী” সবুজ বর্ণের পতাকা নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ শোভাযাত্রা করে। বিক্ষোভ শোভাযাত্রায় প্রায় ৫১ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। ১১ ডিসেম্বরে ডজন খানেক সৈন্য নিহত হয় বিপ্লবীদের সাথে সংঘর্ষে। এমন অবস্থায় রেজা শাহ আমেরিকা-ব্রিটেনের সাথে দেন দরবার শুরু করে। কিন্তু আমেরিকা ধারণা করে খোমেনী হয়ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তাই তারা মুহাম্মদ রেজা শাহের পরিবর্তে খোমেনীকে সহায়তা না করলেও বাঁধা হয়ে দাড়ায়নি।
ইসলামী ঐতিহ্য কুব্বাত আস-সাখরার স্থাপত্য শৈলী
২৮ ডিসেম্বরে মুহাম্মদ রেজা শাহ ন্যাশনাল ফ্রন্টের আরেক নেতা শাহপুর বখতিয়ারের সাথে আপোষে রাজি হয় যে, শাহপুর বখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী হবে আর মুহাম্মদ রেজা শাহ তার পরিবার নিয়ে দেশ ছাড়বে এবং তিনমাস পর গণভোট হবে যে ইরানে রাজতন্ত্র থাকবে নাকি গণতন্ত্র আসবে। শাহ বখতিয়ায়ের সরকারের সমর্থণের আশায় দেশ ত্যাগে দেরি করে। এসময় ন্যাটোর ডেপুটি কমান্ডার রবার্ট হুউসার ইরানে সামরিক বাহিনির সাথে আলোচনা করতে আসে এবং সেনাবাহিনী ও বিরোধী দলগুলোর সাথে আলোচনা করতে সফল হয়। রেজা শাহ হুইসারের এই আলোচনা কার্যক্রমে বুঝতে পারেন আমেরিকা তাকে আর ক্ষমতায় চায়না। ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি বখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান এবং মুহাম্মদ রেজা শাহ দেশ ছেড়ে মিশরে চলে যান।
ইমাম খোমেনীর দেশে প্রত্যাবর্তন
মুহাম্মদ রেজা শাহ সরকারের পতন ঘটলে ইরানের জনগণ উৎসবে মেতে ওঠেন। বখতিয়ার ইরানের ‘সাভাক’ বাহিনীকে বিলুপ্ত করে দেন এবং সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দেন। তিনি সব ধরণের বিক্ষোভ, মিছিল, মিটিং করার অনুমতি দেন এবং বিপ্লবীদের একটি ঐক্যের সরকার গঠনের আহবান জানান। তিনি ইমাম খোমেনীকে দেশে ফেরার আহবান জানান। ১৯৭৯ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারী আয়াতুল্লাহ খোমেনী ফ্রান্সের একটি চার্টার্ড বিমানে করে দেশে ফেরেন। তার দেশে প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে সেদিন কমপক্ষে ৭০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল।
দেশে ফিরে আয়াতুল্লাহ খোমেনী শুধুমাত্র ইসলামী বিপ্লবের একজন নেতা নন, তিনি ইরানের আধ্মাতিক নেতায় পরিণত হন। দেশে ফিরে তিনি বখতিয়ারের সরকারকে অস্বীকার করেন এবং জাতির চাওয়ার ভিত্তিতে নতুন সরকার গঠনের অঙ্গিকার করেন।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা
৫ ফেব্রুয়ারী খোমেনী মেহেদী বাজারগানের নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করেন এবং ইরানীদের সরকারের প্রতি আনুগত্য করার নির্দেশ দেন ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে। খোমেনী সরকার গঠন করলে বখতিয়ারের সরকারের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থার সুত্রপাত ঘটে। খোমেনি তার সরকারের সমর্থনে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহবান জানান এবং আমেরিকান এম্বাসিকে বখতিয়ারের প্রতি সমর্থন বন্ধ করার আহবান জানান। বখতিয়ার একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়েন।
৯ই ফেব্রুয়ারি খোমেনী-সমর্থক ‘দোশান তাপে এয়ার বেজে’ বিদ্রোহ করেন। তার সাথে ধীরে ধীরে অন্যান্যরাও যোগ দিতে শুরু করে। তারা অস্ত্রাগার লুট করেন এবং পুলিশ স্টেসন সহ নানা স্থাপনা দখল করা শুরু করেন।
প্রাচীন গৌড়ে মুঘল আমলের স্থাপত্যকর্ম
১১ ফেব্রুয়ারিতে বখতিয়ারের সরকারের চুড়ান্ত পতন নিশ্চিত হয় যখন ইরানের সেনাবাহিনী নিজের পক্ষতাতিত্বহীন নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করে ঘোষণা দেয়। এরপরপরই খোমেনী সমর্থকরা সরকারি বিল্ডিং সহ নানা স্থাপনা দখল করে নেয় এবং রাজবংশের শাসনের সমা[প্তি নিশ্চিত করে। ১১ ফেব্রুয়ারী বখতিয়ার পদত্যাগ করে আত্মগোপন করেন। সমগ্র ইরান ইমাম খোমেনীর জয়ধ্বনিতে মেতে ওঠে। ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়। তবে ১১ ফেব্রুয়ারিকে ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
ইমাম খোমেনী ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম যার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লব যা ছিল ইরানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এ আন্দোলন ছিল রেজা শাহের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ, কুখ্যাত সাভাক বাহিনীর নির্যাতন ও ইরানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদারী রাষ্ট্রে পরিণত করার বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সংগ্রাম। এই বিপ্লব সর্বাত্মকভাবে ধর্মীয় না হলেও এর সূচনাটা কিন্তু ধর্মীয় কারণেই হয়েছিল, যে কারণে অনেকে একে ধর্মীয় বিপ্লব মনে করে থাকেন। এই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ সাধারণ জনতা ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে অত্যন্ত শক্তিশালী পাহলভী বংশের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। ইরান পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সম্পর্কিত আর্টিকেল
কোন আর্টিকেল খুঁজছেন?
আমাদের অনুসরণ করুন
এক নজরে এই আর্টিকেলে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে…
সাম্প্রতিক আর্টিকেল
শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলাই কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধাবে?
পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত, ও সীমান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
আদালত কী? আদালত কত প্রকার ও কি কি?
আদালত হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই বৈধ প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধের বিচার ও আইনি অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) কী? ইক্যুইটির ম্যাক্সিম সমূহ কী কী?
ইক্যুইটি বা ন্যায়বিচার (Equity) হল সাধারণ আইন (Common Law) এর শর্তের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া একটি স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থা
আব্রাহাম চুক্তিঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, এবং ফিলিস্তিনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
আব্রাহাম চুক্তি হলো ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সহ আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য একাধিক চুক্তির সমষ্টি।
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ডঃ ফিলিস্তিনের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের বুলি!
পশ্চিমা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখলে মনে হয়, গাজায় কোনো মানুষ নিহত হয় না—শুধু "হামাস মেম্বার" হয়! আর ইউক্রেনের গমের ক্ষেত ধ্বংস হলে "হিউম্যানিটি ক্রাইম" হয় ।